মৌলবাদ ও জঙ্গী সন্ত্রাসী শক্তির উত্থান এবং জাতীয় নিরাপত্তা- মে. জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম
সাধারণভাবে জাতীয় নিরাপত্তা শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে একটি জাতির ইতিহাস, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক শক্তি বিন্যাস এবং আলোচ্য সময়ে ধর্মীয় ও জাতিগত অবস্থার কথা মনে উদয় হয়।
নিরাপত্তার প্রতি হুমকিগুলো এইসব উপাদান থেকেই বা এইসব উপাদানের প্রভাবের কারণেই উদয় হয়। এগুলো অবশ্য বড় বড় তাত্ত্বিক আলোচনার উপজীব্য বিষয়। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা মানে হলো তার কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় সে নিজে নিরাপদ অনুভব করে কিনা অথবা তার দৈনন্দিন জীবন কার্যক্রম পচিালনার জন্য রাস্তায় নিরাপদভাবে চলাচল করতে পারে কিনা? নিজে নিজেই সে বেড়ে উঠতে পারে কিনা? সাধারণভাবে এমন একটি তুলনামূলক উদাহরণ দেয়া যায় যেমন : নিরাপত্তা হলো একটি চারাগাছকে তৃণভোজী জন্তু থেকে রক্ষার জন্য দেয়া একটি ‘বাঁশের বেষ্টনী’ আর প্রকৃতির বৃষ্টি, বাতাস, মাটি ও আলোর সাহায্যে চারাটি নিজেই বেড়ে উঠে ফুলে ফলে বিকশিত হওয়াটা হলো, প্রকৃতির ঐ একই উপাদান দিয়ে মানুষের নিজেই বেড়ে ওঠার এবং বিকশিত হওয়ার কার্যক্রম। এই বিকশিত হবার কার্যক্রমকে নির্বিঘ্নে চলার ব্যবস্থাই হলো নিরাপত্তা। তবে মনে রাখতে হবে উপরে বর্ণিত একটি জাতির ইতিহাস, কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, সামাজিক শক্তি বিন্যাস জাতিগত অবস্থার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার প্রতি হুমকির উত্থান এবং সেটা থেকে পরিত্রাণের পথও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।পরিবর্তনশীল জাতীয় নিরাপত্তা
’৯০ দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বিশ্বের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সকল কৌশলগত অস্ত্র, গোয়েন্দা কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোসালিস্ট রিপাবলিক (টঝঝজ)। সোভিয়েত রিপাবলিকের পতনের পর হতে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র (টঝঅ)। যদিও ওই সময়ে বিশ্বে মৌলবাদ বা জঙ্গী-সন্ত্রাসী শক্তির উত্থান অতটা স্পষ্ট হয়ে উঠেনি, কারণ তখনো যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে পড়েনি, স্পেনের মাদ্রিদ ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি, ল-ন আন্ডারগ্রাউন্ড (পাতাল রেল)-এর পতন হয়নি এবং ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপে বোম্বিংয়ের হত্যাকাণ্ড ঘটে উঠেনি। কিন্তু বিন-লাদেন, আল-কায়েদা, তালেবান এবং সেই সঙ্গে তাদের দীক্ষায় দীক্ষিত ‘আঞ্চলিক মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠন’গুলো শত ফুলের মতো বিকশিত হয়ে বিশ্ব দখলের প্রতিপক্ষ হওয়ার আলামত একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের নেতৃবৃন্দ এই মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী শক্তির উত্থানকে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে প্রতিহত করার কৌশলগত দিকগুলো পুনর্নির্ধারণ করতে শুরু করেন। বিশ্ব তখন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ থেকে মৌলবাদ ও জঙ্গী-সন্ত্রাসী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যুগে ধাবিত হয়।
বাংলাদেশ কেমন নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি
প্রায় ৪১ বছর পূর্বে বাংলাদেশের জন্ম হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ এবং নয় মাসব্যাপী বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। একটি নতুন জাতি হিসাবে বিশ্বে অভ্যুদয়ের পর চারটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপাদান আমাদের বিবেচনায় নিতে হয়। এক, ভৌগোলিকভাবে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত এ কারণে এই বিশাল দুইটি এশিয়া অঞ্চলের স্থলপথে বাণিজ্যের প্রধান চলাচলের পথ এবং এই সঙ্গে তার নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ দুই একইভাবে সমুদ্রকূলবর্তী দেশ হিসেবে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরের জলপথে বাণিজ্যের পথগুলো এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারটি আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে বর্তমানে এই অঞ্চলে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে, বাণিজ্য চলাচলের নিরাপত্তা বিষয়ে এই মুহূর্তে কোন হুমকি প্রতীয়মান নয় তবে ইদানীং গণচীন বিশ্ব শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের কারণে মার্কিন নৌ-বহরের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কারণে কিছুটা উত্তেজনা অদূর ভবিষ্যতে অবিসম্ভাব্য হয়ে উঠেছে। তিন, বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারত একটি প্রধান আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং বিশ্ব শক্তিধর দেশ হিসাবে স্বীকৃতির আশা করছে। ভৌগোলিক অবস্থানে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ-পূর্বে মাত্র ২০০ মাইল সীমান্ত ছাড়া বাকি সকল দিকেই বাংলাদেশ ভারতের ভূখ- দ্বারা বেষ্টিত (যদিও এর কারণে ভারত নিজেও দ্বীখ-িত হয়ে পড়েছে)। ভূকৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের নিরাপত্তা আপাতদৃষ্টিতে ভারতের সঙ্গে তুলনামূলক অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভারসাম্যে তারতম্য থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ পররাষ্ট্রনীতি অর্থাৎ গণতন্ত্রের, ধর্ম নিরপেক্ষতার, বাঙালী জাতীয়তাবাদের, সম্পদের সুষম বন্টনের অঙ্গীকার, বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ, মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী শক্তি উত্থানে বিরোধী অবস্থান এবং সর্বোপরি আমাদের জাতীয় সংগ্রামে ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্ধুপ্রতিম ভারতের দৃঢ় অবস্থান, সকল বিষয় মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সেতুবন্ধন রচনা হয়েছে। এই বিশাল সীমান্ত এলাকায় স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে আর্থ সামাজিক কর্মকা-ের কারণে দ্বন্দ্ব সংঘাত, এর কারণে উত্তেজনাপূর্ণ স্থানীয় সীমান্ত অবস্থা এবং সেটি থেকে সীমান্ত রক্তপাত এবং সীমান্ত সংঘাত ছাড়া, ‘পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র সংঘাত’ (যুদ্ধ) এমনকি সীমিত লক্ষ্যের সশস্ত্র সংঘাত (সীমিত যুদ্ধ)এর অদূর ভবিষ্যতে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ব্যবসা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের ইচ্ছা এবং সুদূরপ্রয়াসী বন্ধুত্ব রক্ষার সদিচ্ছা বাংলাদেশে যে কোন সঙ্কটকালের সময় ভারত প্রমাণ দিয়ে চলেছে। চার. জাতিগতভাবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সমপ্রকৃতির অংশ নিয়ে গঠিত বা সমজাতীয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শান্তিপূর্ণ ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মচর্চা সম্দ্ধৃ মুসলমান, তবে নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য, কৃষ্টি আগলে রাখতে বদ্ধপরিকর। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর হুমকি কোন ধরনের শক্তি দ্বারা কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে পারে? উত্তর হয়ত হবে; সেই ৯০ দশকের প্রথম দিকের বিশ্ব নেতৃবৃন্দের যে মাথাব্যথার কারণ, যেটি তখন অস্পষ্ট কিন্তু উদীয়মান ছিল এবং এখন পূর্ণরূপে বিকশিত; সেটি হলো বিশ্ব মৌলবাদ ও জঙ্গী-সন্ত্রাসী শক্তির উত্থানের ছায়ায় এবং ধারায় সংগঠিত ‘আঞ্চলিক ও স্থানীয় মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের উম্মুক্ত ও গোপন কার্যক্রম।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকির উত্থান
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এই বছরগুলোতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার দেশ পরিচালনা করে। বিশ্বে মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু কার্যকরভাবে বাংলাদেশে পৌঁছে উঠতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, যে কোন মৌলবাদ সংগঠনের সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির একটি ফ্রন্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় এবং ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টিকারী হৃদয়গ্রাহী একটি নামেরও প্রয়োজন হয়। এই সময়কালে ধর্মীয় নামীয় রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী (বাংলাদেশ), ছাড়া পরবর্তীতে আলোচ্য আঞ্চলিক স্থানীয় মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কোন নামকরণ তখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে হয়ে ওঠেনি। তবে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাভিত্তিক সম-চিন্তাধারার কারণে জামায়াতে ইসলামীর সখ্যতার ছায়ায় সংগঠিত হবার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য তারা পূর্ণ বিকশিত হবার পূর্বেই ১৯৯৬-এ গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা এবং মধ্য পথ অবলম্বনকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, যার কারণে জামায়াতে ইসলামসহ কোন মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। কিস্তু সন্ত্রাসী নাশকতামূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে তাদের অবস্থানের প্রকাশ পাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এদেরকে দমনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং সেই সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আত্মহননকারী শতধাবিভক্ত ‘কমুনিস্ট আন্দোলন’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু টেকসই চূড়ান্ত শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ হবার পূর্বেই ২০০১ সালে তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
২০০১ থেকে ২০০৬ যুগপৎভাবে বিশ্ব অঙ্গনে কিছু ঘটনার উৎপত্তি হয়, যে ঘটনাগুলো আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পরিবেশের ওপর প্রচ- প্রভাব সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বেশ বড় ব্যবধানে জয়ী হয় এবং পুনরায় সরকার গঠন করে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দল জামায়াতে ইসলামী (বাংলাদেশ) তাদের সম্ভবত বোঝাতে সচেষ্ট হয় জনগণের জাগতিক ভোটের কারণে এবার বিএনপি জয়ী হলেও, জামায়াতে ইসলামী (বাংলাদেশ)-এর ‘আধ্যাতিক’ আশীর্বাদও জয়ের একটি বড় সহায়ক উপাদান ছিল! এই বিশ্বাসে বিএনপি বিশ্বাস স্থাপন না করলেও একটি সুদূরপ্রসারী ভিন্ন চিন্তাধারার কারণে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পূর্ণ সখ্যতা গড়ে তোলে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামের জন্য তাদের উত্থানের পথ সুগম করতে এই সখ্যতাটি একটি দৈব সুযোগ এনে দেয়। ইতোমধ্যে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কয়েকটি যুগান্তকারী ধ্বংসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি হয়। আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়, স্পেনের মাদ্রিদ শহর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে, ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বোমার আঘাতে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, লন্ডন পাতালরেল ধসে পড়ে। আফগানিস্তান জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। আফগানিস্তানের তালেবান ও বিন-লাদেনের আল-কায়দা সংযুক্ত হয়, শুরু হয় আল-কায়েদার এবং তার ছায়ায় এবং ধারায় সংগঠিত ‘আঞ্চলিক ও স্থানীয় মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠন’গুলোর সরব উত্থান। এইবার পাকিস্তান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তার ঢেউ এসে লাগে। নতুন ক্ষমতাধর, কিন্তু বিশ্ব মূল রাজনীতির ধারায় অপরিপক্ব এবং অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ জাতীয়তাবদাী দল (বিএনপি) সরকার এই মৌলবাদ জঙ্গী-সন্ত্রাসী উত্থানকে ধর্মীয় সংগঠন জামায়াতে ইসলামের মাধ্যমে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয়। তাদের ধারণা ছিল পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিএনপির এই মেয়াদকালে অর্থাৎ পরবর্তী পাঁচ বছরের জঙ্গী-সন্ত্রাসী উৎপীড়নে দুর্বল এবং নিশ্চিহ্ন প্রায় হয়ে যাবে যার প্রেক্ষিতে পাঁচ বছর পর, পরবর্তী নির্বাচন তাদের জন্য সুনিশ্চিত জয় বয়ে আনবে। একদিকে বিএনপির পরবর্তী নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের অপচিন্তা অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামের জনপ্রথিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের আকাঙ্খায় দৈবপ্রাপ্ত সুবিধার অনৈতিক ব্যবহার এই-দুই ভিন্ন ধারণার অপমিশ্রণ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এবং জনজীবনে পরবর্তী পাঁচ বছরে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিবেশ সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠন ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠতে শুরু করে। ইতোপূর্বে বিজাতীয় কিন্তু তৎকালীন সরকার ও জামায়াতে ইসলামী পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিশ্ব মৌলবাদী জঙ্গী-সন্ত্রাসী সংগঠনের স্থানীয় সংস্করণ দলগুলো যেমন জামিয়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (লসন), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (যঁল-র), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (লসল-ন), শাহাদাত-ই-আল হিকমা (ংযরধয), লস্কর-ই তৈয়বা (বাংলাদেশ), হিজবুত তাহরীর (বাংলাদেশ) ইত্যাদি বাংলাদেশের মাটিতে কোন ধরনের আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া গর্বভরে তাদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে চলে। বাংলাদেশের পথ-ঘাট, গ্রামগঞ্জ, শহর-শহরতলী; ‘ঢাকা-ইসলামাবাদ-কাবুল চলো’ স্লোগানের মিছিলে এবং আফগানিস্তান, তালেবান, আল-কায়দার সাফল্যের উদ্দীপনাময় ছবিতে, পোস্টারে, দেয়াল লিখনে সারাদেশ পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই সংগঠনগুলো রাজনৈতিক পরিচয়ে বলীয়ান হয়ে দেশজুড়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আল্লাহর রাজত্ব কায়েমের উম্মাদনার আবহ সৃষ্টি করে হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর নিকট থেকে নিয়ন্ত্রণ অধিগ্রহণ শুরু করে। শহরে ভীতি সঞ্চারক বোমার আঘাত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মঘাতী হত্যা ছাড়াও বিচারিক কাজে কর্মরত বিচারকের ওপর আক্রমণ ঘটতে থাকে। এই সকল ঘটনাকে জনসম্মুখে আনার চেষ্টা করলে বা প্রতিবাদ-প্রতিহত করার উদ্যোগ নিলে সেই সংগঠন বা ব্যক্তিকে বিরোধী দলের পদলেহী বা ঘটনাগুলোকে বিরোধী দলের সাজানো নাটক বা সরাসরি কাল্পনিক বলে আখ্যায়িত হতে থাকে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা প্রশাসন বিভাগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মনোভাব বুঝতে পেরে সকল ঘটনাকে আড়াল করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে এবং কে কতখানি সত্যকে আড়াল করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে শত শত জীবন-হরণকারী ঘটনার কারণে শান্তি বিঘ্নিত হতে থাকে; ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে, চলমান জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। সেই ‘চারাগাছের’ নিরাপত্তা বেষ্টনী টি রাষ্ট্র জীবন থেকে হঠাৎ করেই কর্পুরের মতো উবে যায়। এই মৃত্যু-হত্যার নানা বীভৎস দৃশ্যের ছবি প্রকাশ এবং দীর্ঘায়িত অরাজকতার খবর দেশ-ছেড়ে বিদেশে প্রচার মাধ্যমগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। বিদেশী প্রচার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সঙ্গে সমার্থক হিসেবে প্রচার শুরু করে দেয়। প্রায় চার বছর কাল এই অনিয়ন্ত্রিত জঙ্গী-সন্ত্রাসী উত্থানে পরোক্ষ সহযোগিতা ও তার নেতিবাচক ফল ভোগের পর সরকার নিজেদের ভ্রান্ত নীতির রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করে। (বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
No comments