বছরের পর বছর ঝুলে থাকে পুলিশ প্রতিবেদনের অপেক্ষায়- পুলিশের বিরুদ্ধে নালিশি মামলার সুরাহা হয় না
রাজধানীর রমনা থানার হাজতে ২০১০ সালের ৪ মার্চ মো. জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী শিল্পী বেগম বাদী হয়ে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিবলী নোমানসহ দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় তদন্ত করে পুলিশ কোনো প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়নি।
এক লাখ টাকা ঘুষ না দেওয়ায় একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার জনসন রোডের এম আজমল খানকে মারধর করা হয়—এই অভিযোগে তিনি পুলিশের ওয়ারী বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার তৌফিক মাহবুব চৌধুরী, সূত্রাপুর থানার তখনকার ওসি মো. হানিফসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে নালিশি মামলা করেন। আদালত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। এরপর তিন বছর পার হলেও পুলিশ প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েনি।আদালত সূত্র জানায়, এ রকম নানা অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে নালিশি মামলা হলেও, সেসব মামলার তদন্ত আর এগোয় না। আদালতে প্রতিবেদনও দেওয়া হয় না। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আদালত সংশ্লিষ্ট মামলাটি গ্রহণ করা না-করার বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে ভুক্তভোগীরা আদালতে যান বলে জানা গেছে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সারা দেশে ২৬টি নালিশি মামলার হদিস পাওয়া গেছে, যেগুলো বছরের পর বছর ঝুলে আছে। এর মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে গত আট বছরে দায়ের হওয়া ১৩টি নালিশি মামলার খোঁজ মিলেছে। এর প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ নালিশি আবেদনের সন্ধান দিতে পারেনি আদালতের নেজারত শাখা।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতের নাজির মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আদালত এ ধরনের নালিশি আবেদন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। আদেশের সঙ্গে ওই সব নালিশি আবেদনও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পুলিশ প্রতিবেদন না এলে ওই সব আবেদনেরও হদিস কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি জানান, এর মধ্যে চারটির পুলিশ প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।
অবশ্য চারটির মধ্যে একটি মামলায় বাদীর সঙ্গে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা আপসরফা করেছেন। বাকি নয়টির পুলিশ প্রতিবেদন আদালতে জমা পড়েনি।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী অবশ্যই পুলিশকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে হবে। তিনি দাবি করেন, যাদের বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে, অতীতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কার কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটা তিনি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।
আবার আদালতের নালিশি আবেদনের মধ্যে যে কয়টার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে, তাতে অভিযুক্ত পুলিশদের রেহাই দেওয়ার উদহারণই বেশি। ২০১১ সালের ৬ জুলাই বিএনপির ডাকা হরতালে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে মারধরের অভিযোগে তিনি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশীদ (বর্তমান লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার) ও সহকারী কমিশনার বিপ্লব কুমার রায়ের (বর্তমান তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার) বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি মামলা করেন। মহানগর হাকিম ঘটনাটি পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তাকে দায়মুক্তি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। অথচ ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়েছেন, তা তখন বিভিন্ন টেলিভিশনের খবরে দেখানো ও সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নেতা আমিরুল ইসলামকে শাহবাগ থানা হাজতে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম ও উপপরিদর্শক নাসিমউদ্দিনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি মামলা হয়। তখনকার পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বর্তমানে একই বিভাগের বর্তমান উপকমিশনার। তিনি দাবি করেন, আমিরুলকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। থানা হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। তবে এ মামলায় আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে কি না, তা তিনি মনে করতে পারছেন না।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে করা নালিশি মামলাগুলোর তদন্তভার পুলিশকে দেওয়া হয়। তাই সঠিক তদন্ত হয় না। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথাও বলা আছে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে আইন সুরক্ষিত থাকে।
প্রসঙ্গত বহুল আলোচিত চট্টগ্রামের সীমা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে বিচারক ভবিষ্যতে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত পুলিশকে দিয়ে না করানোর সুপারিশ করেছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনের দণ্ডনীয় অনেক অপরাধের অভিযোগ ওঠে। অনেক ঘটনা গণমাধ্যমেও প্রকাশ পায়। যদিও বাড়তি হয়রানি বা নতুন করে বিপদের আশঙ্কায় বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে যান না। গেলেও থানায় পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করেন। থানায় ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ আদালতে নালিশি মামলা করেন। এরপর আদালত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষকেই তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু পুলিশ বছরের পর বছর এসব তদন্ত ঝুলিয়ে রাখে। যেসব বাদীর ধৈর্য ও তদবির করার সামর্থ্য আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো একপর্যায়ে পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
এর বাইরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও খুব বেশি প্রতিকার পাওয়া যায় না। ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর রাতে বাসায় ফেরার পথে মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক এস এম নুরুজ্জামানকে আদাবর থানার কয়েকজন পুলিশ আটক ও মারধর করেন। নুরুজ্জামান জানান, তিনি এ বিষয়ে মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাড়তি ঝামেলার আশঙ্কায় তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেননি বলে জানান।
No comments