আওয়ামী লীগ-বিএনপি-বামপন্থীদের ঐক্য! by আবদুল মান্নান
পাঠক, আমার লেখার শিরোনাম দেখে অবাক হবেন ঠিক, আমি নিজেও সংবাদটি পড়ে ততোধিক তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে। এটি ছিল আগের দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি নির্বাচনের খবর।
শিরোনাম ছিল ‘জাবি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা’। সংবাদে বলা হয়েছে, এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একাংশ, বিএনপি ও বামপন্থীদের নিয়ে গঠিত ‘সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ’ প্যানেল ১৫টি পদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছে আর আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল শুধু সহ-সভাপতি ও তিনটি সদস্য পদ পেয়েছে। এমন একটি অদ্ভুত ঐক্য ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে হয়েছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় ইসলামী ছাত্র শিবিরকে যৌথভাবে মোকাবেলা করার জন্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছুদিন ধরে নানা খবরের জন্ম দিচ্ছে। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে অচল ছিল। সম্মিলিতভাবে অপসারণের এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশ, বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা। সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় দলীয়করণ করছেন। সরকার উপাচার্যকে তার দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আনোয়ার হোসেনকে নিয়োগ দেয়। তাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুমুল আপত্তি ছিল। তারা ধারণা করেছিলেন, আন্দোলনকারীদের একজনকে হয়ত নতুন উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হবে। না দেয়াতে তারা অপমান বোধ করেছেন। এখন কথা হচ্ছে, পূর্বের উপাচার্য যদি এতই দলীয়করণ করে থাকেন তাহলে তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এই নির্বাচনে গেল কোথায় এবং তারা যদি থেকে থাকে তাহলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে আওয়ামীপন্থীদের এই হাল হলো কেন? তাহলে তিনি কি কিছু সুবিধাবাদীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন শুধু নিজ দল ভারি করার জন্য?কিছুদিন আগে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে দেশের রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হলো। উচ্চ শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে আলোচনা হতেই তিনি অকপটে স্বীকার করলেনÑএক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় সমস্যা ছিল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত আর বর্তমানে সরকারের জন্য বড় সমস্যা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নাম বেচে খাওয়া কিছু শিক্ষক। তার সঙ্গে দ্বিমত করার কোন অবকাশ নেই। এমন আওয়ামীলীগারদের যোগাযোগমন্ত্রী বন্ধুবর ওবায়দুল কাদের নামকরণ করেছে ফরমালিনযুক্ত আওয়ামী লীগার হিসেবে যারা উইপোকার মতো দলের ভেতরে থেকে দলের সর্বক্ষণিক ক্ষতি করেন। যখন সেই নেতার সঙ্গে কথা হয় তখন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের নিয়ে উপাচার্য উৎখাত আন্দোলনে লিপ্ত। এই শিক্ষকদের মাঝে আবার সব মতাদর্শের শিক্ষক ছিলেন। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ইবি’র উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল কারণ তিনি ছাত্রলীগ নামধারীদের দেয়া তালিকা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের খালি পদে সকলকে নিয়োগ দিতে পারেননি। সুতরাং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে অপ্রত্যাশিতভাবে শিক্ষকদের একাংশও জড়িত হয়ে পড়লেন। আন্দোলনকারীরা শুধু উপাচার্যের অপসারণ দাবি করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষেরও অপসারণ দাবি করেছে। এই দাবি অনুযায়ী ইতোমধ্যে সরকার উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে তাদের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দিয়েছে। এটি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মনে হয় প্রধান দায়িত্বই হয়ে উঠেছে উপাচার্য উৎখাত এবং এই সব তথাকথিত আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহারকারী কতিপয় শিক্ষক এবং এর ফলে বিব্রত হচ্ছে সরকার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষাজীবন। ক’দিন আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হলো এবং সেই নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি পন্থী শিক্ষকরাই জয়ী হলেন। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি করতে গিয়ে এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক’টি নির্বাচনে প্রগতিশীল শিক্ষকদের পরাজিত করা হয়েছে। একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বুয়েটে কিছুদিন আগে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন সূত্রপাত করল শিক্ষকরা। কিছুদিন না যেতেই তাদের এই আন্দোলনে তারা শামিল করল শিক্ষার্থীদের। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছল যেখানে এক শ্রেণীর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করলেন নিজের শরীরের রক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে উপাচার্যের দফতরের সামনে ঢালতে। এটি একটি ভয়ঙ্কর কর্মকা- আর কাজটিতে ইন্ধন যুগিয়েছেন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অপরিণামদর্শী শিক্ষক। শিক্ষকদের দাবি অনুযায়ী, উপ-উপাচার্যকে তার দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এটি একটি মন্দ নজির। কারণ কিছুসংখ্যক শিক্ষক যদি ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় জিম্মি করে দাবি আদায় করতে পারে তাহলে কোন সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব নয়।
সর্বশেষ শিক্ষকদের বঙ্গবন্ধুর নামে বিভাজনের রাজনীতির শিকার করার একটি অপচেষ্টা করা হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচ- এক বৈরী পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ধারণ করা নয় তা বিস্তৃত করার নিরলস পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু এখানেও ইদানীং দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে এই ক্যাম্পাসেও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা শুরু হয়েছে। এই বিভ্রান্তিকর বিভাজনের ফলে প্রথমবারের মতো ২০০৩ সালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিধিবদ্ধ পর্ষদ ও শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে প্রগতিশীল শিক্ষকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং এই ফরমালিনযুক্ত আওয়ামী লীগ প্রেমীদের বদৌলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতে চলে যায় । সম্প্রতি ডিন, সিন্ডিকেট ও শিক্ষক সমিতি নির্বাচনেও একই প্রচেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সাধারণ শিক্ষকদের সচেতনতায় তারা এবার সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে বিভ্রান্তির রাজনীতি করা যে তারা বন্ধ করবে তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। এসব অপকর্মই করা হয় কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে এবং অনেকের ধারণা এই কাজে তারা জামায়াত-বিএনপির ইন্ধন পান। বাংলাদেশে বর্তমানে এটি একমাত্র সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় যেটিতে সব পর্ষদেই প্রগতিশীল শিক্ষকরাই শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। এটি সম্ভব হয়েছে সাধারণ শিক্ষকদের সচেতনতার ফলে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও যদি এমনটি হতো তাহলে সরকারের একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল নেতা বলতে বাধ্য হতেন না যে বর্তমানে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোতে শিক্ষকরাই বেশিরভাগ সমস্যার সৃষ্টি করেন। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে এই বিভ্রান্তি ও বিভাজনের রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে এবং সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আরও সতর্ক হতে হবে ।
শুক্রবার দেশের প্রথমসারির ইংরেজী দৈনিক ‘দি ডেইলি স্টার’ মহাজোট সরকারের গত এক বছরে রাষ্ট্র পরিচালনা, জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং বর্তমানে নির্বাচন হলে কোন্ দলকে ভোট দেবে এই মর্মে একটি চমৎকার জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এটি যেহেতু মহাজোট সরকারের এই মেয়াদের শেষ বছর সেহেতু এই জরিপ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই কাজটি তারা প্রতিবছর করে থাকে। তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। এবারের জরিপে দেখা যাচ্ছে যারা এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছে তাদের ৪২ শতাংশ বলেছে এই মুহূর্তে ভোট হলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন এবং ৩৯ শতাংশ উত্তরে বলেছে তারা বিএনপিকে সমর্থন করবেন। জামায়াতের পক্ষে রায় দিয়েছেন এক শতাংশ আর জাতীয় পার্টির ভাগ্যে পড়েছে ৫ শতাংশ। এই জরিপের ফলে হয়ত আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কিছুটা হলেও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন । কিন্তু শতাংশের হিসেবে ভোট বেশি পাওয়া আর অধিকসংখ্যক সংসদ আসনে বিজয়ী হওয়া এক কথা নয়। বাস্তবতা তত মধুর নাও হতে পারে যদি আওয়ামী লীগ আগামী এক বছরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নজর না দেয়। প্রথমে তাদেরকে তাদের সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে এখন হতেই সচেতন হতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু গণমাধ্যম এই সব সম্ভাব্য প্রার্থীদের উস্কানি দিয়ে মাঠে নামানোর তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৫টি আসনে হেরেছিল বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে এবং ৩৭টিতে হেরেছিল কারণ বিএনপি তলে তলে জাতীয় পার্টি, জামায়াত আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে আঁতাত করেছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়ী হয়ে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করেছিল । ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় এক শ’ প্রার্থী পরাজিত হয়েছিল দলীয় কোন্দল আর বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে। সঙ্গে তো বিএনপি-জামায়াতের প্রকাশ্য আঁতাত ছিলই। আর ছিল লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণীত আওয়ামী লীগকে হারানোর নীলনক্সা ।
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ছাত্রলীগ নামধারীদের আধিক্য দেখলেই তা আঁচ করা যায়। সরকারে যদি আওয়ামী লীগ না থাকে এই নামধারীদের আর খোঁজ মেলে না। সুতরাং এখন হতেই সতর্ক না হলে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় নিত্যনতুন সম্ভাব্য প্রার্থীর উদয় হবে এবং তারা দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে দলের বারোটা বাজানোর চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ‘সালাম দেয়ার’ পোস্টারে ছেয়ে গেছে। কিছুদিন পর ‘চরিত্র ফুলের মতো পবিত্রতার’ আসবেন। এর ফলে সাধারণ সমর্থকদের মাঝেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। এখন হতেই এই ব্যাপারে সতর্ক না হলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পড়তে পারে যেমনটি হয়েছিল ১৯৯১ আর ২০০১ সালে । এখনও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আশা করেন বর্তমান সরকারের বাকি সময়টা ভালয় ভালয় কাটুক, ফরমালিনযুক্ত আওয়ামী লীগারদের থেকে দল নিরাপদ দূরত্বে থাকুক এবং দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে পুনরায় তারা ক্ষমতায় ফিরে আসুক।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। জানুয়ারি ৪, ২০১৩
No comments