ব্যয়বহুল জেনেভা শহর
৩০ নবেম্বর, সোমবার। রাতভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টি এখনও থামেনি। বরং সকাল থেকে চাপ কিছুটা বেড়েছে। ভাগ্যিস সুইস দূতাবাসের সিনিয়র কাউন্সিলর রেজাউল করিম সাহেবের পরামর্শমতো ঢাকা থেকে ছাতা নিয়ে এসেছিলাম।
সেটাই এখন কাজে দিচ্ছে। তিনি কয়েক দিন আগেই জেনেভা থেকে ফিরেছেন। সে অভিজ্ঞতার আলোকেই জেনেভায় আসার আগে কি প্রস্তুুতি নিতে হবে তার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শ এখন খুবই কাজে লাগছে। তাঁর পরামর্শমতো ল্যাপটপ ব্যাগের সঙ্গে সব সময় একটি গরম কাপড়ের ব্যাগ নিয়েছি। তাতে ছাতা, মাঙ্কি ক্যাপ, মাফলার, সু্যয়েট ারসহ প্রয়োজনীয় গরম কাপড়গুলোও ভরে নিয়েছি। কারণ বাইরে প্রচ- ঠা-া। কিনত্মু ঘরের ভেতর গরম। ব্যাগ নেয়ার কারণে ঘরের ভেতর ঢুকে অতিরিক্ত গরম কাপড়গুলো তাঁকে ভরে চলাফেরা করতে সুবিধে হচ্ছে।সকালে প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীরা একসঙ্গেই দৃক হোটেল থেকে বের হলাম। সকাল সাড়ে ১০টায় ডবিস্নউটিও হেডকোয়ার্টারে সার্ক মন্ত্রীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রীর বৈঠক আছে। ওটার খবর নিয়ে কনভেনশন সেন্টারে গিয়ে ঢাকায় নিউজ পাঠিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কভার করব। হোটেল থেকে বের হতেই প্রথম আলোর মাসুম বলল, কিভাবে যাব, বৃষ্টিতে তো ভিজে যাব। আমি বললাম, ছাতা বের করম্নন। সে সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল, ছাতা পাব কোথায়? আমি তাঁকে আশ্বসত্ম করে বললাম, ভয় নেই আমরা ঢাকা থেকে ছাতা কিনে নিয়ে এসেছি। আমি ছাতা বের করে তাঁর হাতে দিয়ে দিলাম। সেটা দিয়েই দু'জনে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগলাম। অন্যরাও ঢাকা থেকে ছাতা নিয়ে আসায় তাই মাথার ওপর মেলে ধরে হাঁটছে।
জেনেভা শহর একেবারেই সাদামাটা। বেশ কিছু উঁচু ভবন আছে, যেগুলো জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধান কার্যালয়। এ ছাড়া সব পুরনো ভবন। জেনেভা লেকের তীরে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদর দফতর অবস্থিত। শীতের কারণে লেক মৃতপ্রায়। নৌ ভ্রমণের বোটগুলো সব তীরে বাঁধা। লোকজন নেই। অথচ গ্রীষ্মে আলোর ঝলকানিতে এই লেকই প্রাণবনত্ম হয়ে ওঠে। হাজার হাজার পর্যটক ও জেনেভাবাসী গভীর রাত পর্যনত্ম এই লেকের তীরে নানা উৎসবে মেতে থাকে। এই লেকের ওপারে জেনেভা শহরের অভিজাত এলাকা। বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধির বাসভবনও ওই পাড়েই। ওই এলাকার পর শুরম্ন হয়েছে ফ্রান্স। জেনেভা শহর ফান্ডের সীমানত্মবর্তী শহর। ফলে এখানকার ভাষা হচ্ছে ফরাসী। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর হওয়ার কারণে প্রতিদিন সকালে ফ্রান্স থেকে নয় হাজার গাড়ি প্রবেশ করে এখানে। সন্ধ্যায় কাজ শেষে আবার তাঁরা ফ্রান্সে ফিরে যায়। সকল সেবার জন্যই এখানে ফ্রাঙ্ক খরচ করতে হয়। প্রস্রাব করার জন্য ব্যয় করতে হয় তিন ফ্রাঙ্ক। এক ফ্রাঙ্ক সমান প্রায় বাংলাদেশের ৭০ টাকা। এতেই বোঝা যায়, জেনেভা শহর কতটা ব্যয়বহুল।
আগের দিন সন্ধ্যায় এ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নেয়ার সময় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদর দফতরে এসেছিলাম। তখন ভালভাবে দেখা হয়নি। দিনের বেলায় দেখতে পেলাম। জেনেভা শহর উঁচু নিচু। এটি একটি পাহাড়ী এলাকায়। তার মধ্যেই রাসত্মঘাট ও বাড়িঘর তৈরি করা হয়েছে। শহরের গণ পরিবহন হচ্ছে বাস ও ট্রাম। এ ছাড়া ট্যাঙ্ িআছে। বাসগুলো খুবই আধুনিক।
বিশ্ববাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটির সদর দফতর একেবারেই সাদামাটা। পুরনো ভবন। ভেতরে ঢুকে বাঁয়ের মিটিং রম্নমের দিকে গেলাম। প্রচ- গরম লাগছে। গায়ের গরম কাপড় খুলে ব্যাগে রাখলাম। মিটিং রম্নমগুলোর লাউঞ্জে দেখা মিলল সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মোস্তুাফিজুর রহমান এবং ডবিস্নউটিও সেলের ডিজি অমিতাভ চক্রবতর্ীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই সার্ক মন্ত্রীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। মন্ত্রী কোথায় জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, মিটিং রম্নমের ভিতরে। হঠাৎ দেখলাম আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারম্নক খান বেরিয়ে এসেছেন। দূর থেকে দেখেই কাছে এগিয়ে গেলাম। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললাম, চলে এসেছি আপনার অনুষ্ঠান কভার করতে। তিনি খুশি হলেন এবং জানালেন এই দুই দিনে তিনি কি কি করেছেন। ঢাকা থেকে রিপোর্টাররা ডবিস্নউটিও মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক কভার করতে এসেছে দেখে তিনি এতটাই খুশি যে বললেন, ঢাকায় গিয়ে তিনি সম্পাদকদের ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দেবেন।
জনাব ফারম্নক খান বিদায় নিয়ে সার্ক মন্ত্রীদের সঙ্গে মিটিং করতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। প্রফেসর মোসত্মাফিজুর রহমান কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ভেতরেই কফি শপ আছে। ওখান থেকে আগে টাকা দিয়ে কফি কিনে খেতে হয়। সেখানেই লাইন। সকালে অনেকেই কফি ও স্ন্যাকস খাওয়ার জন্য লাইন দিয়েছে। কফি খেতে খেতে পরিচয় হলো; বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয় পর্বের পর তিনি পহেলা ডিসেম্বর তাঁর বাসায় দাওয়াতের আমন্ত্রণ জানালেন। কফি খেয়ে দ্রম্নত বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, এখানেই মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হবে। পরে শুনলাম, এখান থেকে একটু দূরে আনত্মর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে সম্মেলন হবে।
রাসত্মায় বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। কোন্ দিকে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি ম্যাপ দেখে আমাদের কোন্ বাসে যেতে হবে এবং লোকেশন কোন্ দিকে তা বলে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস চলে এলো। জাতিসংঘ সদর দফতরের উল্টো দিকে এই কনভেনশন সেন্টার। জাতিসংঘ সদর দফরের সামনে বিশাল আকৃতির একটি চেয়ার। তার একটি পা নেই। সেখানে গিয়ে নামতেই দূরে চোখে পড়ল কনভেনশন সেন্টার। সামনে কড়া পুলিশ পাহারা। রাসত্মার উল্টো দিকে একটি মাঠে তাঁবু গেড়ে বিশ্বায়নবিরোধীরা অবস্থান নিয়েছে।
ঝাঁকে ঝাঁকে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা কনভেনশন সেন্টারে ঢুকছে। এখানেও সব কাপড় খুলে, স্ক্যানার দিয়ে তবেই ভেতরে ঢুকতে হলো। এখান থেকে বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি হলো- ল্যাপটপও খুলে আলাদা বঙ্ েকরে স্ক্যান করতে হলো। দ্রম্নত ভেতরে গিয়ে মিডিয়া সেন্টার খুঁজলাম। আন্ডার গ্রাউন্ডে মিডিয়া সেন্টার। মাঝারি মানের। তবে পাশের রম্নমেও ব্যবস্থা রেখেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীদের জন্য আলাদা স্থানে ব্যবস্থা করেছে। কিনত্মু সমস্যা দেখা দিল ল্যাপটপে ইন্টারনেট চালু নিয়ে। ঢাকা থেকে টুইন পস্নাক আনতে ভুলে গেছি। এখানে সব টুইন পস্নাক সিস্টেম। নিউএজ উপরে কিনতে গেল, দাম ৩৬ ফ্রাঙ্ক। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আড়াই হাজার টাকা। মাসুম ঢাকা থেকে এ পস্নাক নিয়ে এসেছে। দামের কারণে তার পস্নাক দিয়েই দু'জনে শেয়ার করার সিদ্ধানত্ম নিলাম। কিনত্মু সমস্যায় পড়লাম ওয়াইফাই সিস্টেমের সংযোগ নিয়ে। কিছুতেই ওয়াইফাই সংযোগ পাচ্ছি না। এখানে সর্বক্ষণিক আইটি বিশেষজ্ঞ থাকার কথা। কিনত্মু কোথাও খুঁজে পেলাম না। উপরে ইনফরমেশনে গিয়ে খোঁজ করা হলো। নানা চেষ্টা চালিয়েও আমাদের কেউই ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ করতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর দু'জন আইটি বিশেষজ্ঞ এলো। তাদের একজন্য ব্যর্থ হলে অন্যজন আমার ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ করে দিতে সমর্থ হলো। ফলে স্বস্তুি ফিরে এলো। কারণ ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া ঢাকায় নিউজ পাঠাতে পারব না।
দ্রম্নত নিউজ লিখতে বসলাম। ঢাকার সঙ্গে এখানকার সময়ের পার্থক্য ছয় ঘণ্টা। ঢাকার সময় ধরতে হলে এখানকার দুপুর দুটোর মধ্যে নিউজ পাঠাতে হবে। অথচ ৩টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। বাংলাদেশের কর্মকা- এবং পিছনের কথা দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরম্নর নিউজ লিখলাম। এ সময় শুনলাম বাইরে বিশ্বায়নবিরোধীরা বিক্ষোভ শুরম্ন করেছে। আমার দেশের দিলালকে পাঠালাম তথ্য সংগ্রহের জন্য। আমাদের ইলেক্ট্র্রনিক মিডিয়ার কর্মীরাও ছুটল। শেষ পর্যনত্ম বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরম্নর নিউজ লিখে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম। তারপর মনোযোগী হলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখার জন্য। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছ'টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো বাংলাদেশ সময় তখন রাত ১২টা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাটকীয় কিছু না থাকায় দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য কিছু আর পাঠালাম না। হোটেলে ফিরে এলাম। পরে স্থানীয় বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট রাজমনিতে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ এর সভাপতি মাহবুবুর রহমানের নৈশভোজে যোগ দিলাম। সবাই মিলে হৈচৈ করে রাতে হোটেলে ফিরলাম।
_কাওসার রহমান
No comments