জনকণ্ঠ রিপোর্টের কল্যাণে
২১ ডিসেম্বর। সোমবার। বেলা প্রায় একটা। সেলফোনে বেজে ওঠে অপরিচিত নম্বর। রিসিভ করতেই অপর প্রানত্ম থেকে পুরম্নষকণ্ঠ। নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন নাম আবু সুফিয়ান।
ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সিকদার মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের একানত্ম ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। আরও জানালেন চেয়ারম্যান মহোদয় এক্ষুনি শহীদ জায়া বাসনত্মী রানী দাসের সাথে কথা বলতে চান। ঘন কুয়াশার কারণে মফস্বল শহরটিতে তখনও দিনের কাগজ আসেনি। তবে জনকণ্ঠের মফস্বল সম্পাদক অশোকেশ দা'র সুবাদে আগেই জেনেছি এদিন শেষ পাতায় আমার পাঠানো বাসনত্মী রানী দাসের ওপর করা ফিচারটি ছাপা হয়েছে। পরে আরও কয়েকজন পাঠক ঢাকা থেকে ফিচারটির প্রশংসা করে ফোন করেছেন। এক ফাঁকে ওয়েবসাইটেও দেখে নিয়েছি। ফিচারটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন সময়ে পাক হানাদার ও রাজাকাররা কতটা নির্মম ভাবে বাসনত্মী রানী দাসের স্বামী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শানত্মিরঞ্জন দাসকে হত্যা করেছে এবং স্বাধীনতাপরবর্তী দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেয়া একখানা চিঠি আর শহীদ স্বামীর এক জোড়া জুতো কীভাবে আগলে রাখছেন। কি করে দারিদ্র্যের বিরম্নদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করছেন। তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।আবু সুফিয়ানের তাগাদায় বেশ বিপদে পড়ি। চাইলেই যে বাসনত্মী রানী দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করাতে পারছি না। তিনি তা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না। প্রথমত বাসনত্মী রানী দাস উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে থাকেন। দ্বিতীয়ত তাঁর ছোট ছেলের একটি সেলফোন নম্বর থাকলেও সেটি বার বার কল করেও বন্ধ পাচ্ছি। অন্য কয়েকজনকে দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। গ্রামের বাড়িতে লোক পাঠিয়েছি। কিন্তু কেউ খুঁজে বের করতে পারেননি। আবু সুফিয়ান কিছুতেই এসব কারণ শুনতে চাইছেন না। দু'চার মিনিট পর পরই তিনি ফোন করছেন। তাঁর এক কথা। স্যার এক্ষুনি কথা বলতে চাইছেন। এক পর্যায়ে তাঁর তাগাদায় অস্থির হয়ে উঠি। শেষ পর্যনত্ম পেটে ক্ষুধা নিয়ে দৈনিক যায়যায়দিনের প্রতিনিধি মাসুদুর রহমানের সঙ্গে ভাড়ার মোটরসাইকেলের পিঠে চড়ে বসি। শহীদ জায়া বাসনত্মী রানী দাসের গ্রামের বাড়ি যখন পেঁৗছি, তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটা। কিন্তু সেখানে পেঁৗছেও হতাশ হতে হয়। তিনি গ্রামের বাড়ি নেই। সেখান থেকে আরও প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে উলানিয়া বন্দরে তিনি তাঁর আরেক ছেলের বাসায় আছেন। একদিকে মিনিটে মিনিটে আবু সুফিয়ানের তাগাদা। তার ওপর বাসনত্মী রানীকে না পেয়ে মন-মেজাজ কিছুটা বিগড়ে যায়। কিন্তু কি আর করা। উপায় নেই। আবার ছুটে চলি উলানিয়ার উদ্দেশে। সেখানে পেয়ে যাই তাঁকে। কথা বলিয়ে দেই ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক জয়নুল হক সিকদারের সঙ্গে। পরিচালক মহোদয় দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলেন বাসনত্মী রানীর সঙ্গে। কথা শুনে বুঝতে পারি উভয়েই আবেগ আপস্নুত হয়ে পড়েছেন। চোখ দিয়ে বার বার জল গড়িয়ে পড়ে বাসনত্মী রানীর। ফোনের ও প্রানত্ম থেকে বাসনত্মী রানী দাস এক পর্যায়ে সহায়তার আশ্বাস পেলেন। দেনায় দেনায় জর্জরিত হলেও তিনি নগদ অর্থকড়ি কিছুই চাইলেন না। শুধু চাইলেন এসএসসি পাস বেকার ছেলেটির একটি চাকরি। ছেলে ধনঞ্জয় দাসের বয়স প্রায় ৩৯ বছর।
শেষ পর্যনত্ম বাসনত্মী রানী দাসের কাছ থেকে যখন বিদায় নিই তখন বিকেল গড়িয়ে রাতের অাঁধার নামতে শুরম্ন করেছে। চারদিক ক্রমেই ঢেকে যায় আঁধারে। তীব্র শীত হুল ফোটায়। কাঁপন ধরায় শরীরে। দ্রম্নতগতির মোটরসাইকেল কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। রাত দশটার দিকে ঢাকাগামী গাড়িতে বসে সেলফোনে ধনঞ্জয় দাস জানান, ব্যাংক থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে কম্পিউটার সেকশনে তাঁর চাকরি হবে। বেতন কম করে হলেও ১৬/১৭ হাজার টাকা।
একটি শহীদ পরিবারের এমন সুখবরে মন ভাল হয়ে যায়। সারাদিন অভুক্ত আর দৌড়াদৌড়ির কারণে শরীরে ক্লানত্মি ভর করলেও ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফিরি। মাঠের সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হয়। একটি রিপোর্টের কারণে একটি শহীদ পরিবার পেয়েছে নিশ্চিনত্মে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। এর চেয়ে এ মুহূর্তে আর বড় কোন সুখবর থাকতে পারে না।
_শংকর লাল দাশ, গলাচিপা
No comments