মোশারফ-চেটিয়ার বৈঠকের খবরে তোলপাড়- এমন বৈঠকের প্রমাণ আছে সৈয়দ আশরাফ
স্টাফ রিপোর্টার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে 'ঢাকায় পারভেজ মোশারফ ও অনুপ চেটিয়ার বৈঠক' সম্পর্কে চ্যাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস নিয়ে পুরো দেশেই রীতিমতো তোলপাড় চলছে।
সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এ নিয়ে চলছে চ্যালেঞ্জ, পাল্টাচ্যালেঞ্জ । আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুলের এমন বোমা ফাটানো তথ্য ফাঁসের পর এখন চরম বেকায়দায় বিএনপি। সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা বিষয়টির সত্যাসত্য নিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করলেও সেটি এড়িয়ে যাওয়া জনমনে এ নিয়ে সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছে। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন অভিযোগটির তথ্য-প্রমাণ প্রদর্শনের দাবি জানালে রবিবার সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, এমন বৈঠকের প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে।প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের জন্য রবিবার রাতে দিলস্নীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তাঁর ভারত সফরের প্রাক্কালে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁসের ঘটনায় দেশ-বিদেশে রীতিমতো আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। ভারত জুজুর ভয় দেখিয়ে বিএনপি ও তাদের সমমনা কয়েকটি সাম্প্রদায়িক ইসলামিক দল যখন নানা আন্দোলন-সংগ্রামের হুমকি দিচ্ছে, ঠিক তখনই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে অবাধ বিচরণ এবং খোদ ঢাকায় পাকিসত্মান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী এক নেতা সরকারের সহযোগিতায় বৈঠক করার সুযোগ দেয়ার ঘটনা ফাঁস করে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ।
গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনাসভায় এই গোপন তথ্যটি ফাঁস করে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পারভেজ মোশাররফ (পাকিসত্মানের সাবেক প্রেসিডেন্ট) দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় আসেন। অনুপ চেটিয়া (ভারতের অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার প্রথম সারির নেতা) তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখান থেকে অনুপ চেটিয়াকে শেরাটন হোটেলে নিয়ে আসা হয় এবং পারভেজ মোশারফের সঙ্গে অনুপ চেটিয়া প্রায় দেড় ঘন্টা বৈঠক করেন।
সৈয়দ আশরাফ ওই অনুষ্ঠানে আরও বলেন, "চট্টগ্রামে আটক হওয়া ১০ ট্রাক অস্ত্র বাংলাদেশের জন্য আনা হয়নি। আনা হয়েছিল ভারতে ব্যবহারের জন্য। বগুড়ার প্রায় এক লাখ গুলি পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলোও ভারতের ভূখ-ে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল। তালেবান, আল-কায়েদার প্রতিনিধি ও তথাকথিত মুজাহিদরা ওই সময় বাংলাদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার একজন কর্মকর্তা এদের অভ্যর্থনাও জানান। এ রকম আরও উদাহরণ দিতে পারব।"
সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন ৰমতাধর এই রাজনীতিকের রীতিমতো বোমা ফাটানো এ তথ্য ফাঁসের পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে সারাদেশে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের ভূখ- বিনা বাধায় ব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। উলফাসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী, পাকিসত্মানের উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়বা কিংবা হরকত-উল জিহাদের বড় বড় নেতার ঢাকায় যাতায়াত, বিভিন্ন সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তদনত্মের এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের ভয়াল গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত হরকত-উল জিহাদের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে জোট সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের দহরম-মহরমের কথা আটককৃত জঙ্গীরাই আদালতে জবানবন্দী দিয়ে স্বীকার করেন। কিন্তু পাকিসত্মানের একজন প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের চাঞ্চল্যকর তথ্যটি নিয়ে শুধু দেশেই নয়, আনত্মর্জাতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে বিশেস্নষণ শুরম্ন হয়েছে।
বিশেষ করে সৈয়দ আশরাফের অভিযোগ আঙ্গুল সোজা বিএনপির শীর্ষ ব্যক্তিদের দিকে। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্পর্কে সে সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়াকে তাঁর সরকারের সময় পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট ও উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার বৈঠকের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সাংবাদিকরা বার বার এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও তিনি এ বিষয়ে কোন জবাব দেননি। উল্টো তিনি বিশ্বের স্বাধীনতাকামী গণতান্ত্রিক প্রতিটি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতে বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন স্বাধীন ভূমির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কার এলটিটি, ভারতের মাওবাদী, পাকিসত্মানের তালেবানসহ বেশ কয়েকটি নিষিদ্ধ সংগঠনও কথিত স্বাধীনতার নামে নাশকতামূলক কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। বিরোধী দলীয় নেত্রী স্বাধীনতাকামী বলতে কী এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের পৰে অবস্থান নিয়েছেন? সাংবাদিক সম্মেলনের পর এসব বিতর্কও চলছে বেশ জোরেশোরেই। সর্বশেষ বিএনপির চ্যালেঞ্জের পাল্টাচ্যালেঞ্জ হিসেবে সৈয়দ আশরাফ তাঁর হাতে তথ্য-প্রমাণ থাকার বিষয়টি উলেস্নখ করলে রীতিমতো চুপসে যান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
তবে খালেদা জিয়া কোন জবাব না দিলেও তাঁর মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে দিয়ে অভিযোগটি খ-নের চেষ্টা করেন। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এই স্পর্শকাতর বৈঠকের তথ্য-প্রমাণ সৈয়দ আশরাফকে দেখানোর দাবি জানান। তিনি বলেন, 'তথ্য আছে বললে চলবে না। থাকলে জাতির সামনে তা উপস্থাপন করতে হবে।' সৈয়দ আশরাফের ওই বক্তব্যেকে দায়িত্বজ্ঞানহীন উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ওই বৈঠকের কোন প্রমাণ তাঁর কাছে থাকলে তা জানাতে হবে। সরকারের একজন দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে দায়িত্বহীনভাবে কথা বলা উচিত নয়।
বিএনপির মহাসচিবের এমন বক্তব্যেরও জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। রবিবার সাংবাদিকদের এ সংক্রানত্ম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "পারভেজ মোশারফের সঙ্গে অনুপ চেটিয়ার বৈঠকের তথ্য-প্রমাণ তাঁদের কাছে অবশ্যই আছে। প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের কথা বলিনি। প্রমাণ ছাড়া কোন বিদেশী সম্পর্কে কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না।"
এখানেই শেষ নয়। রবিবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ এ সম্পর্কে আরও বেশ কিছু অভিযোগের তীর ছোড়েন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছর এবং পরবতর্ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছর মিলিয়ে এই সাতটি বছর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল ছিল না। পাঁচটি বছর খালেদা-নিজামীর সরকার ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে ওই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করতে দিয়েছে। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র ও বগুড়ার বিপুল গোলাবারম্নদের গনত্মব্যও ছিল ভারত। এসব ঘটনায় ওই সাতটি বছর ওপরে ওপরে সম্পর্ক থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মোটেও ভাল ছিল না। প্রধানমন্ত্রী বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসের সম্পর্ক জোরদার করার জন্যই ভারত সফরে যাচ্ছেন। সৈয়দ আশরাফের নতুন এ অভিযোগ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কোন নেতা মুখ খুলতে রাজি হননি।
উলেস্নখ্য, উলফার প্রথম সারির নেতা অনুপ চেটিয়া প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে কারাবন্দী হয়ে রয়েছেন। বর্তমান সরকার সম্প্রতি ৰমতায় আসার পর উলফার আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ভারতের নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। বিএনপির অভিযোগ, এসব উলফা নেতাকে ভারতে নয়, বাংলাদেশে গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে বর্তমান সরকার। তবে বাংলাদেশ বরাবরই তা অস্বীকার করেছে। ভারত সরকারও স্বীকার করেছে, বাংলাদেশের সীমানত্মের ভারত ভূখ- থেকেই উলফার এসব শীর্ষ নেতার গ্রেফতার করা হয়েছে।
No comments