একুশ শতক- ডিজিটাল বাংলাদেশ ও তার চার বছর by মোস্তাফা জব্বার
[ডিজিটাল বাংলাদেশ ও তার চার বছর নিয়ে এর আগে আমার লেখার পাঁচটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। সেইসব পর্বে আমি বিস্তারিতভাবেই নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছি।
বিশেষ করে চার বছরে আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছি সেটি চিহ্নিত করা একটি বড় কাজ ছিল। এটি এই পর্যায়ের শেষ পর্ব।] ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার ৪ বছর পর যদি আমরা একটু সাধারণ মূল্যায়ন করি তবে এটুকু একবাক্যে বলতেই হবে যে, বাংলাদেশ এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন পরিচয় অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এই কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে একটি লক্ষ্যও স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। একটি জাতির অগ্রগতির জন্য এমন একটি স্বপ্ন দেখতে পারা অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। জাতি হিসেবে মাত্র চার দশকের ইতিহাস নিয়ে আমরা সামনে চলার জন্য যে নির্দেশনা নির্ধারণ করেছি তা অবশ্যই এই জাতির জন্য অনুসরণীয়। কেউ কেউ একথা বলতেই পারেন যে, আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে যত দ্রুত সামনে যাওয়া উচিত ছিল সেই গতিতে যেতে পারিনি। একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ ও ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র নিয়ে সামনে যাওয়াটা যে দুরূহ সেটিও আমাদের মনে রাখতে হবে। চার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে একটি বড় বিষয় চিহ্নিত করা গেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, দেশের সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্মের বাঙালীরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অসামান্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছে। পক্ষান্তরে আমলাতন্ত্রের শীর্ষে সেই আগ্রহ বা সচেতনতা নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝামাঝি স্তর বা তৃণমূলেও সেই সচেতনতা গড়ে ওঠেনি।ঘ. সর্বজনীন সংযুক্তির প্রসার : দেশে কেবলের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের পাশাপাশি এখন ৪র্থ জেনারেশনের ইন্টারনেট সেবা বা ওয়াইম্যাক্স রয়েছে। অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা, বিভাগীয় শহর ও কোন কোন জেলা শহরে এই সেবা প্রদান করছে। মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। প্রায় তিন কোটি মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে যার পৌনে তিন কোটিই মোবাইল ব্যবহার করে। তবে এই হার আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে যখন আমরা থ্রিজি বা ৪জি মোবাইলের যুগে পৌঁছাব। ২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে থ্রিজি চালু হয়েছে। থ্রিজির ব্যবহারও বাড়ছে। যদিও বহু আগেই থ্রিজি চালু হবার কথা ছিল তবুও আশা করা হচ্ছে যে, এই বছরের মাঝেই থ্রিজির লাইসেন্স প্রদান করা হবে। পরিকল্পনা অনুসারে ২০১৩ সালে থ্রিজি পুরোপুরি চালু হবার কথা। এর ফলে সার্বজনীন সংযুক্তির বিষয়ে দেশ চূড়ান্ত সফলতার দিকে যেতে পারবে। বিশেষ করে মোবাইল ব্রডব্যান্ড প্রচলনের ফলে দেশের ডিজিটাল রূপান্তর একটি সফল পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারবে।
ঙ. কর্ম পরিকল্পনা : সার্বিকভাবে বারো বছর মেয়াদী একটি মহাযজ্ঞের সূচনা হিসেবে ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে কেবল প্রকৃষ্ট বললেই যথেষ্ট বলা হবে না বরং এই সময়ের মাঝে একটি সভ্যতার রূপান্তরের জন্য প্রাথমিক ভিত রচনায় পাওয়া গেছে অভাবনীয় সফলতা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই সফলতা কি ধরে রাখা যাবে? প্রথমত এই মুল্যায়ন করা প্রয়োজন যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আগামী দিনের পরিকল্পনাগুলো কি সঠিক রয়েছে। দ্বিতীয়ত একটি শঙ্কা সকলের মাঝেই কাজ করছে যে, আগামীতে যদি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না আসতে পারে তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর কি হবে।
প্রথমত সরকারের পরিকল্পনার কথাই বলতে হয়। আমি মনে করি এখন পর্যন্ত যে ধরনের কাজ করা হয়েছে তার মাঝে সার্বিক সমন্বয় খুব জরুরী ছিল না। বিগত দিনে মোটামুটিভাবে সকলে মিলেই প্রাথমিক কাজগুলো এমনকি আলাদা আলাদাভাবেই করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ এর মাধ্যমে এক ধরনের পরিকল্পনা সরকারের সকলের সামনেই উপস্থাপিত হয়েছিল। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ২০১১ সালের শেষের দিকে কাজ করা শুরু করলেও প্রথমে সৈয়দ আবুল হোসেনের দায়িত্ব পাবার ফলে একটি বিপর্যয় ঘটে। তিনি যে কয়েক মাস এই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন সেটি ছিল প্রায় দায়সারা গোছের। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তিনি যে বদনাম কুড়ান তার ফলে এই মন্ত্রণালয়ের ওপরও এর ছাপ পড়ে। তিনি নিজেও সম্ভবত এই মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন না। মন্ত্রণালয়ের অবকাঠামোও সঠিক ছিল না। এরপর মোস্তফা ফারুক মোহম্মদ দায়িত্ব নেবার পরও মন্ত্রণালয়ের কাজে সেই গতি আসেনি যেটি আসা উচিত। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই তাদের মতো করে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর কাজ এককভাবে করে যাওয়ায় এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। তারা তাদের মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সেটি বাস্তবায়ন করে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এটুআই-এর কাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না। এটুআই-এর কাজের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও সমন্বয় নেই। ফলে শিক্ষার রূপান্তর এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার বিস্তারে সঠিক সমন্বয় হচ্ছে না। এসব বিষয়ে নীতি নির্ধারণেও ভিন্ন মত দেখা যায়।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আগামীতে সরকারী কাজের সমন্বয়টি আরও পরিকল্পিত হতে হবে। সরকার এরই মাঝে আইসিটি মন্ত্রণালয় গড়ে তুলেছে। ফলে সমন্বয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত তৈরি হয়েছে। যদি এই মন্ত্রণালয়কে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজটির সমন্বয় করতে দেয়া হয় তবে আলগা আলগা কাজ করার বিষয়টি সমন্বিত হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই থেকে সরকারকে ডিজিটাল করার যেসব প্রচেষ্টা এককভাবে করা হচ্ছে সেটি যদি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে করা হয় তবে সার্বিকভাবে কাজের অগ্রগতিও বেশি হবে। এমনকি আইসিটি মন্ত্রণালয় গড়ে তোলার সার্থকতাও তখন খুঁজে পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে একটি দুর্বলতার কথা স্পষ্ট করে বলা উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিকে রাজনৈতিকভাবে যতটা সম্প্রসারিত করা উচিত ছিল সেটি তেমনভাবে করা হয়নি। এজন্য রাজনৈতিকভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচী, এর ধারণা, কাজের গতি, পরিকল্পনা ও নীতিমালাসমূহ রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। অথচ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনগুলো বিগত ৪ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা, কর্মসূচী ও এর প্রয়োগ নিয়ে কোন ধরনের সভা-সমাবেশ বা সাংগঠনিক কাজকর্ম করেনি। ফলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে তেমন ধারণা বিরাজ করে না।
সরকারের একটি বড় ধরনের সফলতা ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০০৯ প্রণয়ন করা। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১০০ দিনের মাঝে সরকার এই নীতিমালা প্রণয়ন করে। কিন্তু এটির নবায়নের কাজ ২০১১ সালে শুরু করেও ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সম্পন্ন করা হয়নি। প্রচ- দুর্বলতা বিরাজ করছে এই কাজটি সম্পন্ন করতে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি সাধারণ অভ্যাস হলো ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনায় মুখর থাকা। শেখ হাসিনার সরকার সম্পর্কেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কলঙ্কসহ ছাত্রলীগের কিছু কিছু কাজ নিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। টেলিভিশনের রাতের টক শো বা পত্রিকার পাতার সম্পাদকীয়-উপ সম্পাদকীয়তে এসব প্রসঙ্গে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। কদাচিত সরকারের সফলতার কথা বলা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রফতানি ও বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সংবিধানের পরিচ্ছন্নতা, ডিজিটাল রূপান্তর এসব আলোচনাতে আসেই না।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার সময় আমরা কেবল সফলতার কথাই বলছি না। এই অনুচ্ছেদেই আমি এই কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ের অভাবের কথা বলেছি। একই সঙ্গে এই কথাটি বলা দরকার যে, চার বছরে সরকারকে ডিজিটাল করার জন্য খুব বড় ধরনের কাজ তেমন হয়নি। এখনও বাংলাদেশ সচিবালয় পুরোপুরি এনালগ যুগেই আছে। সরকারের ছোট ছোট সেবা ডিজিটাল হলেও ভূমি, বিচার, পুলিশ এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই বলা যায়। শিক্ষাকে ডিজিটাল করার ছোট ছোট পদক্ষেপ নেয়া হলেও বড় কাজগুলো পুরোই বাকি। পরীক্ষামূলকভাবে থ্রিজি চালু হলেও ডিসেম্বর অবধি থ্রিজির লাইসেন্স দেয়া হয়নি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক অগ্রগতির বিপরীতে একটি শঙ্কার কথা আমরা প্রায়ই শুনি। আমরা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের বিষয়টি পর্যালোচনা করি তবে দেখব যে আওয়ামী লীগের সময়কালে যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সেটি পরবর্তী সরকার (কাকতালীয়ভাবে বিএনপি) ক্ষমতায় আসার পরই বন্ধ করে দেয়। আমরা ২০০১ সালের খালেদার সরকারের কর্মকা- পর্যালোচনা করলে এই বিষয়টি খুবই স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারব। আওয়ামী লীগ সেই সময়ে আইসিটির উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল তার সবই বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ না জেতে এবং বিএনপি যদি সরকার গঠন করে তবে এখনকার সচল চাকাটিও অচল হয়ে যাবে এবং ২০২১ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছি সেটি হয়ত অপূর্ণই থেকে যাবে। এজন্য সরকারের একটি ধারাবাহিকতা তৈরি হতে হবে যাতে অগ্রগতির চাকাটি থেমে না যায়।
পাঁচ ॥ একুশের আগেই : স্বাধীনতার চার দশক পর বাঙালী জাতি তার যে স্বপ্নটাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ নামাঙ্কিত করেছে মহাজোট সরকার তাকে যথাসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর আগে আর কখনও এমন সময় আসেনি যখন এমনভাবে সমাজের ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। যেমনি করে সরকার বিষয়টিকে সামনে তুলে এনেছে তেমনি করে বেসরকারী খাতেও এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। এরই মাঝে আমাদের সফটওয়্যার ও সেবা খাতের রফতানি বেড়েছে। তৈরি হয়েছে আউটসোর্সিং নামক একটি নতুন সম্ভাবনাময় খাত।
আশা করা যায়, আমরা হয়ত ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব না, হয়ত তার আগেই আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
ঢাকা, ০৫ জানুয়ারি ২০১৩ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচির প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, www.bijoyekushe.net
No comments