বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি এবং তার মহানায়ক by নিয়ামত হোসেন
যাঁরা দেখেননি তাঁরা বুঝতে পারবেন না বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি ব্যাপারটা কী রকম ছিল! ইতিহাসের অনেক গুরম্নত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে আমরা বইয়ের পাতার মাধ্যমে জানতে পারি।
তাতে ঐ অধ্যায় তথা ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় ঠিকই, তবে যাঁরা ঐ ঘটনার প্রত্যৰদশর্ী তাঁরা দেখেন ঘটনার সম্যক রূপ, বুঝতে পারেন সে সম্পর্কে খুঁটিনাটি সবকিছু। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি সম্পর্কেও একই কথা খাটে। যাঁরা সেদিন ঢাকা শহরে ছিলেন তাঁরা চোখের সামনে ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় প্রত্যৰ করেছেন। বাংলাদেশের যে যেখানে ছিলেন তাঁরা তো বটেই, সারা দুনিয়ার লোক এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরোৰ সাৰী হয়েছেন। কারণ ঘটনাটি সম্পর্কে শুধু বাংলাদেশের মানুষই উদ্বিগ্ন ছিল না, উদ্বিগ্ন এবং আগ্রহী ছিল দুনিয়ার মানুষ। গতকাল পার হলো সেই ১০ জানুয়ারি, ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি। এবারের ১০ জানুয়ারির বাহাত্তরের হাজার হাজার ১০ জানুয়ারি প্রত্যৰ দশর্ীকে সেদিন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অধ্যায়টি নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।সেদিন একজন মানুষকে ঘিরে সবকিছু। স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রম্নমুক্ত হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচার, স্বসত্মির নিশ্বাস ফেলার অবকাশ তখন হয়েছে স্বাধীন দেশের সব মানুষের। আনন্দও ব্যাপক। কিন্তু পূর্ণ আনন্দ তখনও হয়নি। স্বাধীনতা এসেছে, মুক্তি এসেছে, সবই ঠিক, কিন্তু একজন নেই। একজন মানুষের অভাব দেশের অবালবৃদ্ধবনিতা সবার। সে মানুষটির জন্য সবাই চিহ্নিত, সবাই উদ্বিগ্ন, কোথায় তিনি, কেমন আছেন তিনি, প্রত্যেক মানুষের মনে সেই প্রশ্ন। খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই চাচ্ছে তিনি ভাল থাকুন, সুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অতিদ্রম্নত সবার মধ্যে ফিরে আসুন, সবার সেই একই আকুল প্রত্যাশা। একদিন অকস্মাৎ খবর পাওয়া গেল পাকিসত্মানের এক কারাগারে শেষ কারাজীবনের অবসান হয়েছে তাঁর। তিনি আসছেন। খবরটা শোনা মাত্র সারাদেশ আনন্দে উদ্বেল! মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তখনও অস্ত্র। খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে শুরম্ন হলো তাদের আনন্দ, আকাশে গুলি করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল তাঁরা, সে কী আনন্দ, ঢাকার আকাশে সেদিনের সে সন্ধ্যায় মুহুমর্ুহু গুলির শব্দ। তিনি আসছেন! মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে গুলি ফোটাচ্ছে আকাশে। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। যিনি তখন খবরটা শোনেননি, তিনি আকস্মিক এই আনন্দের গুলির উৎসবের কারণ জেনে গেলেন। সারা শহরে সারা দেশে সবাই জেনে গেল মহাআনন্দের এই খবরটা। খবরটা হলো, তিনি আসছেন। তিনি দেশের প্রতিটি মানুষের পরমপ্রিয় একজন মানুষ। তিনি পাকিসত্মানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এখন আসবেন স্বাধীন দেশে। মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এক কথায় বঙ্গবন্ধু। এই নাম দেশের মানুষের দেয়া ভালবাসার নাম। সেদিন জানা গেল, তিনি আসছেন। এরপর জানা গেল, আসার আর দেরি নাই। ১০ তারিখে আসছেন।
সেই ১০ তারিখ ঢাকা শহর লোকে লোকারণ্য। সারা শহরে মানুষ আর মানুষ। শহরের মানুষ ভেঙ্গে পড়েছে রাসত্মায়। সারা দেশের আনাচ-কানাচ থেকে লোক ছুটে এসেছে। ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে বিমান থেকে নামবেন। সেখান থেকে তখনকার রেসকোর্স, আজকের সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে তাঁকে নিয়ে আসা হবে। সারা রাসত্মায় উপচে পড়ছে লোক। রাসত্মার দু'ধারে মানুষ। সারা দেশের মানুষ যেন জমা হয়েছে ঢাকায়। এসেছে সব বয়সের মানুষ। শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা। শত শত গোটা পরিবার এসেছে রাসত্মায় বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখতে। তাঁর নাম অনেক আগে থেকেই কিংবদনত্মি হয়ে গেছে। এখন তিনি দুনিয়ার সব দেশেই পরিচিত। বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত একজন দেশনায়ক। সেদিন মানুষের সমুদ্র যেন রাসত্মায়। বেলা একটু একটু করে বাড়ছে। কখন আসবেন, কখন আসবেন। এই দুশ্চিনত্মার মধ্যে মাঝে মাঝে খবর আসছে। সে সব খবরে উলস্নসিত হচ্ছে মানুষ। উদ্বেলিত হচ্ছে, এই তো এসে পড়বেন। আর দেরি নাই। সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। কখন উড়োজাহাজের শব্দ শোনা যায়। এরপর এক সময় দেখা গেল উড়োজাহাজ। তিনি এলেন ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের একটি বিমানে। বিমান অবতরণ করার পর এলেন ইতিহাসের সেই ময়দানে_ সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে। ওখানে একাধিকরার ভাষণ দিয়েছেন তিনি। ৭ মার্চও ভাষণ দিয়েছেন ওখানেই। ঐ ময়দানেই পাকিসত্মানী বাহিনী সারেন্ডার করেছে। আরও অনেক ঘটনার সাৰী ঐ মাঠ। ঐ মাঠে এলেন তিনি। মাঠে তখন মানুষ আর ধরে না। উপচে পড়েছে আশ- পাশের রাসত্মায়। সারা শহর তখন মানুষে মানুষে সয়লাব। সবার মুখে আনন্দ। সবাই নিশ্চিনত্ম হলো বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। ভাষণ দিলেন লাখো মানুষের সামনে। তাঁকে পেয়ে, তাঁর মুখের কথা শুনে নয় মাস ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা দুশ্চিনত্মার পাথর সরে গেল সবার মন থেকে। সেদিনের ঘটনার যাঁরা প্রত্যৰদশর্ী, যাঁরা সাৰী তাঁরা এমন এক ইতিহাসের ঘটনা সেদিন প্রত্যৰ করেছেন যে ধরনের ঘটনা সচরাচর ঘটে না, মাঝে মাঝে ঘটে। সবার দেখার সৌভাগ্য হয় না। ইতিহাসের সেই দিনটি গতকাল পার হয়েছে। বাহাত্তরের সেই ১০ জানুয়ারি অমস্নান হয়ে রয়েছে ইতিহাসে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরম্নর সবুজ সঙ্কেত দিয়ে ঢাকা থেকে কেটে পড়লেন। শুরম্ন হলো এদেশে মানুষের বিরম্নদ্ধে অপারেশন। ব্যাপক আক্রমণ চালালো পাকিসত্মানী বাহিনী পিলখানার রাইফেল বাহিনীর সদরদফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিৰকদের বাড়ি, ছাত্রাবাসসহ শহরের সর্বত্র। কামান, মর্টার, রাইফেল, বোমা নিয়ে চললো আক্রমণ। পোড়ানো হলো ঘরবাড়ি, বসত্মি। সারা শহর যেন নরককু-ে পরিণত করল তারা। শুধু লাশ আর লাশ, ধ্বংস আর ধ্বংস। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল তারা তাদের দেশে। ইয়াহিয়া ঢাকা থেকে নিজেদের দেশে গিয়ে যে ভাষণটি দিলেন তাতে তিনি সবকিছুুর দায় চাপালেন বঙ্গবন্ধুর ওপর। ইয়াহিয়ার বক্তব্য_ এই মানুষটিই সবকিছুর জন্য দায়ী। মানুষটি পাকিসত্মানের এক নম্বর শত্রম্ন। কঠোর শাসত্মি দেয়া হবে তাকে। ইয়াহিয়া ৰমতা কেড়ে নিয়েছিলেন আইউব খানের হাত থেকে। সেই আইয়ুব খানও বিরাট হুমকি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করার পর তিনি বলেছিলেন, অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দেয়া হবে। ওরা বরাবরই অস্ত্রের ওপর নির্ভর করেছে। অস্ত্র দিয়েই রাজনীতির অঙ্গনে ঢুকে পড়ে বারবার অস্ত্রের ভয় দেখিয়েছে। আইউবের কাছ থেকে ৰমতা কেড়ে আরেক অস্ত্রের 'লোক' ইয়াহিয়া এল ৰমতায়। অনেক টালবাহানার পর দেয়া হরো নির্বাচন। '৭০ সালের নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে গোটা দেশের মানুষ একবাক্যে সমর্থন জানান আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুকে। তারপর একের পর এক ঘটনা। এক দিন হঠাৎ ঘোষণা এল এ্যাসেম্বলি অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। বাঁশের লাঠি হাতে লাখ লাখ মানুষ নেমে পড়ল রাসত্মায়। এমনি সব ঘটনা। অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ। উপায় নাই দেখে কৌশলে আলোচনার জন্য এলেন ইয়াহিয়া। গোপনে চলল সৈন্য ও অস্ত্রবল বৃদ্ধির কাজ।
সে সময়ের ছোট্ট একটি খবর। এটা থেকেও বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের সঙ্গে কতখানি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। দেশের প্রতিটি মানুষও তাঁকে নিজের মানুষ, নিজের নেতা মনে করত। সে সময় ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন। আলোচনা হবে। ঠিক হয়েছিল বঙ্গবন্ধু তাঁর লোকজন নিয়ে সেখানে যাবেন, সেখানেই আলোচনা হবে। সে সময় এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে কৌতূলবশে জিজ্ঞেস করেছিল, ইয়াহিয়া আপনার বাড়িতে আসছেন না। আপনারা ওঁর বাড়িতে আলোচনার জন্য যাচ্ছেন কেন? মুহূর্তে বিলম্ব না করে বঙ্গবন্ধু হেসে বলেছিলেন, 'এদেশের সব বাড়িই তো আমার বাড়ি!'
বঙ্গবন্ধু পাকিসত্মানী শাসকদের চোখে ছিলেন সে দেশের এক নম্বর শত্রম্ন। বহুবার তাঁকে জেলে পোরা হয়েছে। শেষ বার পাকিসত্মানের জেলে থাকার সময় তাঁর ফাঁসি সুনিশ্চিত_ এই ভেবে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিসত্মান রাষ্ট্রের বিরম্নদ্ধে তিনি এক নম্বর আসামি। এই মানুষটিকে দেশের আপামর জনতা একবাক্যে নিজেদের প্রিয় নেতা হিসেবে বরণ করে নেয়। দেশের মুক্তির জন্য, দেশের সাধারণ গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য কোন কিছুকেই তিনি কষ্ট মনে করেননি, মৃতু্যভয়কেও জয় করেছিলেন। সেই মানুষটিকে '৭৫ সালে হত্যার পর তাঁর সম্পর্কে শুরম্ন হয় বিরূপ সমালোচনা। স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রধান মানুষটিকে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়ার কত ধরনের চেষ্টা যে হয়েছে তার তুলনা দুনিয়ার অন্য কোন দেশে নেই। স্বাধীনতার ইতিহাস পাল্টানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে এই স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থান না দিয়ে তাঁর নামে নানা অপপ্রচার চালানো হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর কোন ভূমিকা নেই_ এইসব মিথ্যা কথা কতভাবেই না লেখা হয়েছে। এসবের লৰ্য একটাই_ বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা, তাঁর অবদানকে খাটো করা। বছরের পর বছর এই জঘন্য ব্যাপার দেশের মানুষ অবাক হয়ে বেদনার সঙ্গে লৰ্য করেছে। এসব চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুকে বিন্দুমাত্র খাটো করা সম্ভব হয়নি। যারা এসব কাজ করেছে সেই কাজের মধ্য দিয়ে তাদেরই খাটোত্ব প্রমাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে মানুষ ভালবাসে না, তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে- একথাও বহুবার বহুদিন বলা হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে যে দলটির অসত্মিত্বই জড়িয়ে রয়েছে সেই দলটিকেই মানুষ বিপুলভাবে সমর্থন করেছে_ সেই দলের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটকে ভোটে জয়ী করে তাদের হাতে দায়িত্ব দিয়েছে দেশ পরিচালনার।
বঙ্গবন্ধুর নামে অনেক কিছুর নাম রাখা হয়। এটাকে কেউ কেউ ঠিক নয়, এটা বাড়াবাড়ি মনে করেন। এই কাজের সমালোচনা করেন, ব্যঙ্গ করেন। এই কাজটাকে বাড়াবাড়ি বলে মেনে নিলেও সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রশ্ন কি করা যায় না_ বঙ্গবন্ধু দেশের আপামর মানুষের প্রিয় নেতা, আমাদের অনেক জনপ্রিয় শ্রদ্ধেয় নেতা আছেন। সবাইকে দেশের মানুষ ভালবাসে, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারটা আলাদা। তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা। দেশের জন্য তাঁর অবদানের তুলনা হয় না, দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য তাঁর ত্যাগ, ভালবাসার তুলনা হয় না। এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দায়িত্ব তো সব দলের, সব সরকারের। কিন্তু কখনও কি দেখা গেছে, অন্য কোন পার্টি বা দল বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাঁর নামে কোন কিছু স্থাপনার নাম রেখেছে? কেন, তাঁর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দায়িত্ব তো সবারই! অত্যনত্ম পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে এই ঔদার্যটুকুও মানুষ এখনও দেখতে পায়নি। তবে একটা বিষয় খুব ভালভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে, ইতিহাস উল্টোপাল্টা করলেও সঠিক ইতিহাস একদিন প্রকাশিত হবেই। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের নাম ইতিহাস থেকে বাদ দিলেও তা হয় সাময়িক, বই থেকে তাঁর নাম মুছে দেয়া যায় বটে, তবে ইতিহাস থেকে সরানো যায় না কখনও।
No comments