মহাজোট সরকারের চার বছর
আজ ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের চার বছর পূর্ণ হলো; পদার্পণ করল পঞ্চম অর্থাৎ শেষ বছরে। দু’বছরের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরাজনীতিকরণের এক অনিশ্চিত পরিবেশের প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে এই জোট বিপুল জনসমর্থন পেয়ে বিজয়ী হয়।
মহাজোটের নেত্রী হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন চার বছর আগে, আজকের এই দিনে। চারটি বছর একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য কম সময় নয়; বিশেষ করে সরকারের মেয়াদ যখন পাঁচ বছর নির্ধারিত, সেখানে চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার অর্থ নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। এরই প্রেক্ষিতে নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায়, বিগত চারটি বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের সাফল্যের পরিমাণই বেশি। এই সরকারের একটি যুগান্তকারী সাফল্য হলো, নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। আন্তর্জাতিক মানের দুটি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পরিচালিত এই বিচার শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে। এই বিচার সম্পন্ন হলে জাতি দীর্ঘ চার দশকের এক কলঙ্কিত অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে; জাতির আলোকিত ইতিহাসে তা হবে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও এ সরকারের অনেক সফলতা চোখে পড়ার মতো। ক্রমপ্রসারমাণ ভয়াবহ জঙ্গীবাদ দমন, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বিদ্যুত, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা, জনশক্তি রফতানি, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের প্রাথমিক প্রস্তুতি, দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেয়া, গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন, তথ্যপ্রযুক্তির তৃণমূলভিত্তিক সম্প্রসারণ ইত্যাদি কাজ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আগের সরকারের আমলের ভঙ্গুর বিদ্যুত ব্যবস্থাকে এই সরকার দ্রুত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এজন্য দ্রুত বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। বীজ, সার, কীটনাশক যথাসময়ে সরবরাহসহ উন্নততর ও আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার ফলে কৃষি উৎপাদন ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ধানের বাম্পার ফলনের ফলে খাদ্য ঘাটতির অপবাদ ঘুচিয়ে দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্য খুবই প্রশংসনীয়। একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন শুরু, বছরের প্রথমেই মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত, বহুসংখ্যক প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ, শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি পদক্ষেপ শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
মালয়েশিয়ায় ৫ লাখ কর্মী রফতানির ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর এ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সরকারী ব্যবস্থাপনায় জনশক্তি রফতানির ফলে এই খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা বিদেশী প্রভাবশালী ম্যাগাজিনেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকটি সবার সামনে নিয়ে এসেছে। আমাদের দেশের অতীত সরকারগুলোর আমলে দেখা গেছে নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষ করে সরকারের নেকনজরে থাকা ব্যক্তিবর্গ দুর্নীতি করলেও তাদের টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা ছিল না তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের। সেসব নেপথ্য দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটিতও হতো না। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলেই প্রথমবারের মতো সরকারের মন্ত্রী, দলীয় লোক কিংবা অন্য প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে। ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি বা যুবকের প্রতারণাপূর্ণ এমএলএম কারবার ইত্যাদি জনস্বার্থবিরোধী কাজ সরকার শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষাপটে সরকার যে দৃঢ়তাপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এখনও এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা জাগ্রত রেখেছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
তবে কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা যে নেই, তা নয়। নিত্যপণ্যের বাজার সর্বক্ষেত্রে সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি। বারবার জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হতে পারে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গুম, অপহরণ এখন অনেকটা কমলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
সরকারের হাতে এখনও একটি বছর রয়েছে অনিষ্পন্ন কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য। এ সময়ের মধ্যে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করে সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদার মর্যাদা রাখবে সেই প্রত্যাশা দেশবাসীর।
No comments