কেন বাংলা ভাষার এই - হীরালাল বালা- মাতৃভাষা
রাষ্ট্রভাষা, আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ বাংলাভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের যেমন শেষ নেই, তেমনি এ-ভাষার অমর্যাদা ও হতদশা দেখে আমাদের আক্ষেপেরও সীমা নেই।
প্রতিবছর মহান ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা যেন জেগে উঠি, বইমেলাসহ ভাষার জন্য অনেক কিছু করি ও বলি। একুশে ফেব্রুয়ারি তো আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ গুরম্নত্বপূর্ণ দিন। সারা জাতি এই দিনের জন্য অপো করে, গর্ববোধ করে। ঢাকায় শহীদ মিনারে আবাল-বৃদ্ধবনিতাসহ জনতার ঢল নামে। এই দিনে আমরা ভাষা শহীদের আত্মত্যাগ, জীবনদান প্রভৃতি স্মরণ করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য জাতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। বইমেলায় নতুন নতুন বই আসে, দৈনিক কাগজে, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় ভাষা সম্পর্কে অনেক তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ, ভাল ভাল কবিতা, উপন্যাস বের হয়। কিন্তু তাতে বাংলাভাষার সৌষ্ঠব ও গৌরব কতটা বৃদ্ধি পায় তা জানতে আবার আগ্রহ না থাকলেও সমাজ ও ভাষা সচেতন ব্যক্তিদের যে আগ্রহের ঘাটতি তাও বোঝা যায়।পণ্ডিত ও গবেষকদের মতে, বর্তমানে বাংলাভাষার যথেষ্ট অমর্যাদা করা হচ্ছে, বানান, উচ্চারণ ও শব্দ ব্যবহারের খামখেয়ালীর কারণে। কোন কোন ক্ষেত্রে এই খামখেয়ালিপনা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। এদিকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে ভাষা শিা ঠিকমতো হচ্ছে না। সেটা বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষার েেত্রই প্রযোজ্য। সেখানে ব্যাকরণ ঠিকমতো শেখানো হচ্ছে না বলে তারা বাংলা ও ইংরেজী ভাষা ঠিকমতো লিখতে, পড়তে ও বলতে পারছে না। বাংলা উচ্চারণের তো কোন বালাই নেই। বাংলাদেশে অঞ্চলভিত্তিক উচ্চারণ প্রথা এমনভাবে চালু রয়েছে যে, সেখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিষয়টি একেবারেই উপেতি হচ্ছে। এখানে হাত দেয়া কারও পইে সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে বানানের ক্ষেত্রে শুদ্ধ নৈরাজ্য চলছে। বাক্য রচনায়ও তারা পারদশর্ী হতে পারছে না। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে যদি একটা কিছু শুদ্ধভাবে লিখতে না পারে, তবে তাদের ভবিষ্যত কী হবে? বাংলা ব্যাকরণের শিক নেই, ইংরেজীরও নেই। ফলে ভাষা শুদ্ধরূপে লেখার শিা ছেলেমেয়েরা কোথায় পাবে? আর একটা কারণ হচ্ছে উদাসীনতা। ছাত্র-শিক কেউই ব্যাকরণ শিখতে চায় না, পড়তে ও পড়াতে চায় না। দ ও অভিজ্ঞ শিকের অভাব প্রকট। বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ সমস্যা বহুদিন যাবৎ বিরাজ করছে। এই সমস্যার সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কয়েকটি উদাহরণ দিলে বাংলা বানানের ক্ষেত্রে নৈরাজ্য দৃশ্যমান হবে। বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিণ কেন্দ্রে একটি বিশেষ বুনিয়াদী প্রশিণ কার্যক্রমে ৪৮ প্রশিণাথর্ীর মধ্যে ৩০জন 'বিশ্বসত্ম' শব্দটিকে ভুল করে লেখেন 'বিশ্বস্থ', 'আনুষঙ্গিক' শব্দটির অশুদ্ধ বানান লেখেন 'অনুসঙ্গিক' ও 'অনুষঙ্গিক' ৩০ জন; 'উচিত' শব্দটিকে অশুদ্ধভাবে 'উচিৎ' ও 'উচীত' লেখেন তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা। অধিকাংশ কর্মকর্তা (প্রশিৰণার্থী) 'সুষ্ঠু' শব্দটিকে লেখেন 'সুষ্ঠ' এবং এই বলে তর্ক করেন যে, ওই দুটো শব্দই নাকি শুদ্ধ। 'মূর্খ' ও 'মুখ্য' শব্দ দুটিকে অশুদ্ধ করে লেখেন 'মুর্খ' ও মূখ্য'। 'আকাঙ্া' শব্দটির বানান তারা লিখে থাকেন এভাবে- 'আকাংখা' বা 'আকাঙ্খা'। 'অঞ্জলি' শব্দটির বানান বিভ্রাট বহুদিন যাবৎ চলছিল। অধিকাংশ েেত্র -লী লেখা হচ্ছিল। বর্তমানে খবরের কাগজগুলো ইতঃপূর্ব বা ইতিপূর্ব (অশুদ্ধ) লিখছে 'ইতোপূর্ব' যা একেবারেই অশুদ্ধ।
অধিকাংশৰেত্রে বাংলাভাষী মানুষ ই, ঈ, উ, ঊ, ণ-ন, ষ, স, খ ও , ব, ড়, ত, ৎ, ,ি ী, ু, ূ প্রভৃতি বানান অশুদ্ধ করে ফেলেন। এই বানানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৎসম শব্দের বেলায় প্রয়োগ হয়। বিদেশী শব্দ ও তদ্ভব শব্দের বানানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছাড় দেয়া হয়েছে। তৎসম শব্দ গঠনে নত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান প্রভৃতিসহ আরও কিছু নিয়মকানুন জানা থাকলে বানানের সমস্যা হয় না। বিদেশী শব্দের বানানও যথেষ্ট সহজ করা হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ব্যাকরণ ভালভাবে পড়ালে ও শেখালে এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রণীত ও প্রবর্তিত বাংলা বানান পদ্ধতি অনুসরণ করলে বাংলা বানান লেখার েেত্র যথেষ্ট উন্নতিসাধিত হবে।
অন্যদিকে বাংলাভাষায় অনাবশ্যকভাবে ইংরেজী শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যা কারোই কাম্য নয়। এটা যেমন কথ্য ভাষায় এসেছে, তেমন সাহিত্যে, সংবাদপত্রে, সাময়িকীতে, রেডিও, টেলিভিশনে ঘটছে। অতিসম্প্রতি একটি বহুল প্রচলিত সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদের (লিড নিউজ) প্রথম অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যটি এভাবে লেখা হয়েছে, "দেশে জঙ্গী বেজড আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স তুঙ্গে।" কি অদ্ভূত ইংরেজী ও বাংলা শব্দের সংমিশ্রণ! যেন বেজড, আন্ডারগ্রাউন্ড, পলিটিক্স-এর কোন যুতসই বাংলা প্রতিশব্দ নেই? এই সংবাদটিতে আরও ইংরেজী শব্দ যেমন_ ট্রেনিংপ্রাপ্ত, ফমর্ুলা, লিডিং পর্যায়ে অনাবশ্যক ও দৃষ্টিকটুভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কী কারণে হচ্ছে, কী জন্যে হচ্ছে, তা আমাদির সকলেরই জানতে ইচ্ছে করে।
"নাউ আমরা চলে যাবে ছংয়ে, এখন শুনবেন ছংনাম্বার ফাইভ, সো লিসেনার্স এবার স্টে কড়ুন..." এই হচ্ছে নাকি ঢাকার এফএম বাংলা রেডিওর অনুষ্ঠান ঘোষণার ধরন। এই মহান ফেব্রম্নয়ারি মাসে এ কি শোনাচ্ছেন এফএম বাংলা রেডিও। আমাদের ছোট ছেলেমেয়েরা ওদের নিকট কী শিখবে, বাংলা না ইংরেজী, না জগাখিচুড়ি অন্য কিছু। আসলে আমরা আজকাল দৈনন্দিন কাজে, কথোপকথনে এবং লেখাপড়ায় অনাকাঙ্তিভাবে ইংরেজীনির্ভর হয়ে পড়ছি। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজী শব্দ যত্রতত্র ব্যবহার করছি। আমরা আমাদের কথাবার্তায় প্রায় সময়ই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ইংরেজী শব্দের দ্বারস্থ হচ্ছে। এই যেমন_ মর্নিংওয়াক, ব্রেকফাস্ট, একসিডেন্ট, লাইফ, লাইট, লেট্, লিডার, মরালিটি, ম্যাটারনিটি, সেন্ট্রাল, ম্যানেজমেন্ট, এডুকেশন, ইলেকশন প্রভৃতি হাজারো ইংরেজী শব্দ আমরা মুখে মুখে অনবরত বলে যাচ্ছি। অথচ এর প্রত্যেকটি শব্দের বাংলা যুতসই ও যথার্থ প্রতিশব্দ আছে যেগুলো শুনতে ভাল লাগে, বলতেও সহজ। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমরা অবলীলাক্রমে বাংলা ভাষাকে উপো করে, অমর্যাদা করে চলেছি। এতে বাংলা ভাষার চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। হয়ত একদিন এর শব্দ ভা-ার হ্রাসও পেতে পারে।
যারা বাংলা ভাল জানেন, তারা ইংরেজীও ভাল জানেন। আর ঝড়সব বাংলা, ঝড়সব ইংলিশ যারা করেন ও বলেন, তারা কোনটাই ভাল জনেন না। অথবা তারা অভ্যেসবশত এটা করেন। কিন্তু তারা যে নিজেকে ও নিজের মাতৃভাষাকে ফাঁকি দিচ্ছেন এবং প্রকারানত্মরে ভাষাকে অবজ্ঞা করেছেন, এটা ভুললে চলবে কি করে। উভয় ভাষায় পারদশর্ী ব্যক্তি এটা করবেন না, সেটাই আমরা আশা করি। কেউ কি ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা দিতে গেয়ে ভুলেও একটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করেন? তা হলে বাংলা ভাষায় বক্তৃতাকালে কেন এত ইংরেজী শব্দের ছড়াছড়ি। এটা কী এজন্য যে, বাংলায় যুতসই ও যথার্থ শব্দ পাওয়া যায় না। এ যুক্তি আমরা মানতে রাজি নই।
আজ এই মহান ভাষা-আন্দোলনের মাসে আমাদের শপথ নিতে হবে, আমরা যেন শুদ্ধরূপে বাংলা ভাষা লিখি, পড়ি ও বলি। আমরা যেন মনে রাখি, পৃথিবীর সকল ভাষাই মহান ও মর্যাদাপূর্ণ এবং তা পৃথিবীতে বসবাসরত কোন না কোন জাতির মাতৃভাষা। তার অমর্যাদা ও অসম্মান করা আমাদের কারও প েউচিত হবে না। এই ঔচিত্য বোধটা যেন, আমাদের মনে সকল সময় কাজ করে। মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে এই হোক আমাদের কামনা ও বাসনা।
লেখক : সাবেক সচিব ও কথা সাহিত্যিক
No comments