একান্ত সাক্ষাতকারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ॥ গতিশীল অর্থনীতি দেশকে অগ্রগতির দৃঢ় সড়কে পৌঁছে দিয়েছে- সাক্ষাতকার গ্রহণে ॥ স্বদেশ রায়
আজ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আশিতম জন্মদিন। বাংলাদেশের কেবিনেটের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ৮০ বছর বয়সে অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুদায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর এই আশিতম জন্মদিনের দুই দিন আগে তিনি বেশ কিছু খোলামেলা কথা বলেন। গত চার বছর ধরে বিশ্বমন্দা মোকাবেলা করে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে যে পঞ্চম স্থানে আছে তাতে তিনি জাতি ও দেশের জন্য জোরেশোরে তাঁর গর্ব প্রকাশ করেন। নির্বাচনের বছর তাকে মনে হলো চিন্তিত হওয়ার পরিবর্তে অতিশয় তৃপ্ত এবং নিঃশঙ্ক। তিনি বার বার বললেন, অর্থনীতি যে রকম গতিশীল তাতে অর্থনৈতিক বিবেচনাই এখন থেকে হতে যাচ্ছে দেশের মূল নিয়ামক শক্তি।যেহেতু তিনি অর্থমন্ত্রী, রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী, তাই তাঁর এ সাক্ষাৎকারে এসেছে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে নানান কথা। এসেছে তাঁর নিজের কিছু অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা। এবং তাঁর নিজের ইচ্ছাতেই এই আলাপচারিতা শুরু হয় একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়ের প্রসঙ্গ দিয়েই। যদিও বাদ যায়নি বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ। এই প্রথমবারের মতো তিনি বিশ্বব্যাংককে সময় বেঁধে দিয়েছেন, বলেছেন ভিন্ন খাতের কথা পদ্মা সেতু তৈরি প্রসঙ্গে। তাই সে বিষয়েও তিনি বলেছেন বিস্তারিত।
স্বদেশ রায় : আপনি মুক্তিযোদ্ধা, কেবিনেটে সব থেকে সিনিয়র, আপনার আশিতম জন্মদিনের মাত্র কয়েকদিন আগে দেশের বিচার বিভাগ সর্বপ্রথম একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণা করলÑএ অনুভূতিটি প্রকাশ করবেন কি?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : এটা আমার সৌভাগ্য, আমার আশিতম জন্মদিনের মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত বড় মাপের কাজ হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরা সৌভাগ্যবান। আমাদের ক্ষোভ ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের শাস্তি দিতে পারিনি। বরং তারা গাড়িতে রাষ্ট্রীয় পতাকা পর্যন্ত উড়িয়েছে। তাদের শাস্তির কথা আমরা শুরু থেকেই জোরেশোরে বলছি। তারা দেশবিরোধী কাজ করেছে। তারা মানবতার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। তাছাড়া গত নির্বাচনে আমরা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছি, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব।
আমাদের কথার বিপরীতে একটা মহল বলার চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধু তাদের মাফ করে দিয়েছিলেন। আমরা এর উত্তরে সব সময়েই বলে আসছি, বঙ্গবন্ধু সেটা করেননি। তিনি যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন সেখানে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধীদের কোন ছাড় দেননি। নির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগে ১১ হাজার আটক মানবতাবিরোধী অপরাধী ছাড়া পায়নি জেল থেকে। হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে ছিল তাদেরকে মাফ করা হয়নি। তাদেরকে মাফ করেন জিয়াউর রহমান, যখন তিনি যোগসাজশ আইন বাতিল করেন। কিন্তু তিনি বাতিল করতে পারেননি আমরা ১৯৭৩ সালে একটা আইন পাস করেছিলাম সেটা।
১৯৭৩ সালে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এ আইন পাস করা হয়েছিল। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় ঢাকায়। নোবেল-বিজয়ী নিল কিনকসহ অনেকেই এই সম্মেলনে ছিলেন। এই আইনটা সামরিক সরকাররা বাতিল করেনি। এই আইনের কিছু সংশোধন করে আমরা বিচার শুরু করলাম। তখন অনেক প্রশ্ন উঠেছিল, আমরা শেষ অবধি বিচার করতে পারব কিনা? অনেকেই এই নিয়ে নানান সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এই বিচারের রায় ঘোষণার ভিতর দিয়ে ওই সব প্রশ্ন শেষ হয়ে গেছে। আজ সারাদেশ উল্লাসিত। শুধুমাত্র দেখতে পাচ্ছি বেগম খালেদা জিয়ার দল এই নিয়ে খুশি নয়। বরং তারা কূট প্রশ্ন তুলছে। তারা মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কথা বলছে। আসলে বাংলাদেশে এখন খালেদা জিয়াই রাজাকারদের সব থেকে বড় রক্ষক। আর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সব থেকে বড় হন্তারক ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাই মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী ও রাজাকার রক্ষকদের কথার কোন মূল্য নেই। বরং বলব আমি অত্যন্ত খুশি, আমরা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিতে পেরেছি। আর আমাদের আশা হলো এই বিচার যেন আরও এগিয়ে নিতে পারি। কারণ যুদ্ধাপরাধ এমন একটা অপরাধ যার তথ্য-উপাত্ত ৬০-৭০ বছর পরও পাওয়া যায়। তাই এই বিচারের ধারা অব্যাহত থাকবে। এটা আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার।
আমি এখন জীবনের প্রান্ত সীমায় আছি। সাধারণত আমাদের দেশের মানুষ ৬০ থেকে ৭০ বছর বাঁচে। সে ক্ষেত্রে আমি আশিতে পা রাখলাম। তাই আমার অনুভূতি খুবই মধুর।
স্বদেশ রায় : যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি কোন পরিবর্তন হবে?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : অবশ্যই বড় পরিবর্তন হবে। ধর্ম ব্যবসার রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। আজ দেশে জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি আছে। আমার মনে হয় জামায়াত নিষিদ্ধ করার দরকার হবে না। এমনিতে জামায়াত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর এ দেশে জামায়াত ছিল না। আমার তখন মনে হয়নি এ দেশে আবার জামায়াত ফিরে আসবে। প্রতিবিপ্লবীদের ক্ষমতায় আসার পরে এ দেশে পুনরায় জামায়াতের জন্ম দেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। আর বুঝে হোক না বুঝে হোক এ দেশে প্রতিবিপ্লবীদের সংগঠিত হতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে জাসদ। তখন প্রতি বিপ্লবীরা অনেকেই জাসদে অবস্থান নেয়। যেমন আমার সিলেটের বর্তমান জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান যৌবনে জাসদ কর্মী ছিলেন। এই রকম অনেকেই সেদিন জাসদে ছিল।
স্বদেশ রায় : এই রাজনৈতিক প্রভাব কি আগামী নির্বাচনে পড়বে?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : নিশ্চয়ই পড়বে। এর প্রভাব অবশ্যই আমাদের নির্বাচনে পড়বে। কারণ এর মাধ্যমে তো আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়েছি। এটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটা উপায় বটে। ওই রকম অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে, গাড়িতে রাষ্ট্রীয় পতাকা ওড়াবে এটা সহ্য করার জন্য আইনের শাসন নয়। তাই আইনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করায় এটা একটি বড় পদক্ষেপ।
স্বদেশ রায় : আপনার সরকারের আর মাত্র নয় মাস আছে। এখন আপনার কী মনে হচ্ছে-যে অর্থনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে আপনারা যাত্রা শুরু করেছিলেন তার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্বিত যে প্রায় সবগুলো কাজ করতে সমর্থ হয়েছি। যেমন আমাদের অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও বিশ্বমন্দা মোকাবেলা। এটা আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এক নম্বর অগ্রাধিকারে ছিল। আমরা ক্ষমতায় আসার পর দ্রব্যমূল্য অনেক কমে। এর আগের বছর মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা ক্ষমতায় এসেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করি। প্রথম বছর ও দ্বিতীয় বছর দ্রব্যমূল্য ভাল ছিল। তৃতীয় বছর বিশ্বব্যাপী তাড়াতাড়ি মন্দা মোকাবেলা করার ফলে দ্রব্যমূল্য একটু বাড়ে। আরও একটি কারণ ছিল যে, আমরা অর্থনীতিতে সম্প্রসারণ নীতি অবলম্বন করি। যার ফলে সামগ্রিক একটু অসুবিধা হয়। তবে আমরা শক্ত হাতে অবস্থার মোকাবেলা করি। এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছে খাদ্য উৎপাদন। ১০-১১ সালে শিল্প উৎপাদনও ভাল হয়েছে। আমদানি নীতি ভাল কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সঙ্কোচনশীল নীতি নিয়েছে সেটাও ভাল কাজ করেছে। অবশ্য সম্প্রসারণ নীতির পরপরই সঙ্কোচনশীল নীতি চললে একটু অসুবিধা হয়, তবে তার আমরা উত্তম সমন্বয় করেছি। খাদ্য উৎপাদনে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। এর ফলে আমরা গ্রামীণ অর্থনীতি সুস্থ ও সবল রাখতে পেরেছি। দরিদ্র ও দুস্থদের আমরা নানান পথে খাদ্য দিয়েছি। বিভিন্ন কর্মসূচী ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য দিয়েছি। বিনা পয়সায় খাদ্য দিয়েছি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়ন। যোগাযোগ ও জ্বালানি ছাড়া সার্বিক উন্নয়ন হয় না। আমরা যে অবস্থায় দেশ বা অর্থনীতি পেয়েছিলাম সেটা ছিল একটা বিধ্বস্ত অবস্থা। বিএনপি বিদ্যুত উৎপাদন করেনি একটুও তাদের আমলে। গ্যাসের উত্তোলন বাড়ানোর চেষ্টা করেনি। তাই তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য আমরা দামী বিদ্যুত উৎপাদন করলাম। সহজ রাস্তা নিলাম। সেটা খুবই সফল হয়েছে। এখন ৫৪টি নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র বিদ্যুত উৎপাদন করছে। সেখান থেকে আমরা পাচ্ছি ৩৮৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এছাড়া আরও ২৭টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। এগুলো এ বছর থেকে ক্রমান্বয়ে উৎপাদনে যাবে। এগুলো দীর্ঘ মেয়াদী বড় মাপের কেন্দ্র ও কম দামে বিদ্যুত উৎপাদন করবে। এই ২৭টি থেকে ২০১৬-এর ভিতর আমরা পাব ৫৪৩৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এর ভিতর আগামী মাসে একটি বিদ্যুতকেন্দ্র উৎপাদনে যাচ্ছে। সেখান থেকে প্রথম পর্যায়ে আমরা প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাব, পরে আরও ৭৫ মেগাওয়াট যোগ হবে।
স্বদেশ রায় : ছোট ছোট যে বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো করেছেন, এগুলো স্বল্প মেয়াদী। কিন্তু এই বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে অনেক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। অনেক গৃহস্থালিতে বিদ্যুত কানেকশন দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বড় বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো চালু হবার আগেই তো এদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আপনাদের সিদ্ধান্ত কি?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : ছোট বিদ্যুতকেন্দ্র কিছু কিছু এক্সটেনশন দিচ্ছি। এখন এক্সটেনশন দেয়া সহজ। তুমি আমাকে বিদ্যুত দেবে আমি তোমাকে পয়সা দেব। এই ভিত্তিতে এটা হবে। কয়েক দিন আগেও একটিকে এক্সটেনশন দিয়েছি। আমাদের চিন্তা আরও দু’বছর এই মেয়াদ বাড়ানো। আর এই ফাঁকে আমরা পুরনো প্লান্টগুলো সংস্কার করছি।
স্বদেশ রায় : আপনারা এই যে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এখন তো বিএনপি বলছে তারা এসে এগুলো বন্ধ করে দেবে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত : প্রথমত বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না। আমরাই আবার আসব। তারপরও বিএনপি বুঝতে পারছে না গত চার বছরে দেশের কী পরিবর্তন হয়েছে। এই চার বছরে অর্থনীতি মোট এক-চতুর্থাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক নাগাদ উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখতে আমার এখন পৃথিবীতে ৫ম দেশ। গত চার বছরে চায়নার অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪০%, ভারতের ৩৫%-এর মতো, তুরস্কের ৩০ থেকে ৩১%, নাইজেরিয়া ২৯% আর বাংলাদেশ ২৫.৫০%। এটা সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে, আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আমরা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। অন্য অনেক দেশ আছে যারা এক বছর ভাল করেছে তো পরের বছর অনেক খারাপ করেছে। কিন্তু আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল গত অর্থবছরের আগের বছর ৬.৭%, গত অর্থবছরে ৬৩%। এ বছর ৭-এর কাছাকাছি থাকবে। এই ধারাবাহিকতা আমাদের অর্থনীতি বদলে দিয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় এখন যা ইচ্ছে তাই করা সম্ভব নয়।
স্বদেশ রায় : আমার জানা মতে, বিএনপি ২০০১-এ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ৯৯টি ও ৫৪টি বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী নয়, একজন অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে আমার প্রশ্নÑএর ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কী ক্ষতি হয়েছে ?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : এর ফলে কমপক্ষে বার্ষিক ২ বা ১.৫% প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে দেশের। আজকের এই জ্বালানি ক্রাইসিস দেশে হতো না। বাস্তবে তারা নির্বোধের মতো কাজ করেছিল। সরকার বদলাল বলে তুমি ওই সরকারের নেয়া প্রকল্প বন্ধ করে দিতে পার না। প্রয়োজনে কিছু মোডিফাই করতে পার। কিন্তু বাতিল করতে পার না। যেমনÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেসব কার্যক্রম বা প্রকল্প শুরু করে আমরা সেগুলো বজায় রেখেছি। কিছু মোডিফাই করেছি। সরকার পরিচালনা একটি ধারাবাহিক কাজ। আগের সরকারের প্রকল্প বন্ধ করা একেবারে বোকামি।
স্বদেশ রায় : এবার পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে আসি। আপনি এই প্রথম বলেছেন, বিশ্বব্যাংক এক মাসের মধ্যে অর্থছাড় করতে রাজি না হলে আপনারা অন্য উৎস থেকে এ সেতু করবেন? আপনার পরিকল্পনাটা দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার করবেন কি?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : আমি সব সময়ে বলেছি, বিশ্বব্যাংকের বাতিল করার সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল না। তারা তখন বলেছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্র চলছে। তারা নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারল না। তারা যা বলল সেটা ক্রেডিবেল এভিডেন্স না। পরে এক্সটারনাল প্যানেল এসে অতিরিক্ত অভিযোগের তথ্য দিল। কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে চিঠিপত্র লেনদেনের বিষয়টি পাওয়া গেল। সেটা পাবার পর দুদক চার্জশিট দিতে পারল। কিন্তু এ সবের সঙ্গে আমরা চেয়েছি সেতুর কাজটি শুরু হোক। টোকিওতে আমি তাদেরকে বলি, তোমাদের কথা মতো যারা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে তাদেরকে আমরা সরিয়ে দিয়েছি। এখন তোমরা দ্রুত কাজ কর। আমার আশা ছিল তারা তাড়াতাড়ি এগোবে এবং রিপোর্ট দেবে। আমরা শুষ্ক মৌসুমে কাজটি শুরু করতে পারব। কিন্তু সেখানে তারা দেরি করল। তাছাড়া চিঠি লেখালেখিতে দেরি হচ্ছে। এই মাসের মধ্যে আমি বলেছি এ জন্য যে, সেতুটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। অন্য উপায় বলতে আমি বলেছি আমাদের আরও তিনজন দাতা আছে। তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা বলছি। তারা বলছে, সেতুটা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত হলেই তারা কাজ শুরু করতে পারে। যেমন ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিঙ্ক রোড তৈরি করবে। যে মূল সেতু হচ্ছে এটা নিশ্চিত হলেই এখনই কাজ শুরু করতে পারে। সে কারণে আমি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটা সাক্ষাত চেয়েছি। তিনি নতুন। তাই আমি মনে করি তাকে সব বিষয় বলা উচিত। আমাদের জন্য বিষয়টি দেরি হয়ে যাচ্ছে সেটা বলা দরকার। আগামী মাসে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাব বলে একটা প্রস্তুতি আছে। আমাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর, আমাদের প্রতিনিধি, কথা বলছেন। অর্থাৎ ডায়ালগ চলছে।
তাছাড়া আমি মনে করি টেন্ডার প্রক্রিয়া যেখানে থেমে আছে সেখান থেকেই কাজ শুরু করা যায়। কারণ এই ধরনের সেতু বানানোর দক্ষতা পৃথিবীতে নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির আছে। নতুন করে টেন্ডার করলেও তারাই নির্বাচিত হবে। তার শর্ট লিস্ট আমাদের আছে। তাই সেখান থেকেই শুরু করা যায়। নতুন টেন্ডারের প্রয়োজন নেই।
এছাড়া আমি তখনও বলেছি এখনও বলছি পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হবার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাংক যখন প্রথম ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বলল, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হচ্ছে, তারা কানাডার কোম্পানির কথা বলল। আমরা তখনই বলেছিলাম কানাডিয়ান কোম্পানিকে ব্লাক লিস্টেড করে দিচ্ছি। তাই এখনও বলছি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হবার কোন সুযোগ নেই।
স্বদেশ রায় : আপনি দীর্ঘদিন সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে, দুই বার মন্ত্রী হিসেবে এবং বর্তমান কেবিনেটের অনেক দায়িত্ব পালন করার ফলে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তাছাড়া আপনার জীবন দীর্ঘ। আপনি এবার ৮০ বছরে পা দিচ্ছেন। আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দিয়ে বলবেন কি এই সরকার কতটা স্বচ্ছ?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : আমি যেহেতু সরকারে আছি তাই আমার মূল্যায়নে কিছুটা পক্ষপাত থাকবে। তবে এটা সত্য, উচ্চ পর্যায়ে বা বড় বড় যে দুর্নীতি হয় সেটা সম্ভব নয়। আমরা দুর্নীতির সামান্য গন্ধ পেলেই কাজ বন্ধ করে দেই। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট নির্মাণ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তুরস্কের একটা কোম্পানিকে কাজ দেবার প্রস্তাব হয়েছিল, দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে আমরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।
যেটা সচরাচর হতো যে আগে কমিশন ঠিক না হলে কোন টেন্ডার হবে না; এখন এগুলো নেই। এখন স্বাভাবিক টেন্ডার হচ্ছে। যার ফলে জেনারেল ইলেকট্রিক বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
আমাদের দেশে নিচের দিকে অনেক দুর্নীতি হয়। যেমন একটা সার্টিফিকেট নিতে গেলে দুর্নীতি হয়। এগুলো ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে অনেক দূর করেছি। আদালত ও পুলিশের ডিজিটালাইজেশনের কাজ হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে বিচারপতি খায়রুল হক এজন্য একটা বড় পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। আমি তার পুরো অর্থ বরাদ্দ দিই। তবে সম্ভব হয়নি ভূমি ডিজিটালাইজেশন। যা হলে ৭০ শতাংশ দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে।
স্বদেশ রায় : এ বছর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা খুব বেশি হবেÑযা অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলবে বলে বলা হচ্ছে?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই, হবে না। যাদের জনসমর্থন নেই তারা হরতাল ডাকতে পারে। কিন্তু এখন দেশের মানুষ হরতাল চায় না। তাই মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে হরতাল করা, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
স্বদেশ রায় : আপনার ৮০তম জন্মদিন। এই জন্মদিনে আপনার অনুভূতি?
আবুল মাল আবদুল মুহিত : খুবই স্বস্তিতে আছি। আমার সন্তুষ্টি অনেক। স্বাস্থ্য ভাল আছে। তাছাড়া জীবন সায়াহ্নে এসে এমন একটা কাজের সুযোগ পাওয়া অনেক বড় বিষয়। আমি সিভিল সার্ভিস থেকে, মন্ত্রিত্ব থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকবার পদত্যাগ করেছি। এবার চার বছর ধরে মন্ত্রিত্বে আছি। মহা আনন্দের বিষয়। আমি জানি, আমি যা চাই তার সব হবে না। তবে ডেমোক্র্যাসিতে অনেক আনন্দ। যেসব আশা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি সেটা ভালভাবে অর্জন করেছি। তাছাড়া আরও বড় বিষয় হলো ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি দিল্লীতে এক সেমিনারে সাউথ এশিয়ান কমনওয়েলথের কথা বলেছিলাম। মাননীয় মনমোহন সিং ও আমার নেত্রীর যৌথ ইশতেহার সাউথ এশিয়াকে সেই দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। বদলে দিচ্ছে। তাছাড়া ট্রানজিট হবে। ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশ বড় ইকোনমিক হাব হবে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটা অনেক বড় বিষয়।
তাছাড়া দেশে গত চার বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা ২৫%-এরও কম হয়েছে বলে আমি মনে করি। বস্ত্র ও অন্ন সমস্যা মোটামুটি সমাধান হয়েছে। শিক্ষাও এগিয়েছে। মেয়েদের স্বাধীনতা অনেক এগিয়েছে। তবে গৃহায়ণ সমস্যা আছে। এটা সমাধানে আরও সময় লাগবে। সত্যি কথা বলতে কি, যে অর্থনৈতিক মুক্তি এ দেশের দরকার এই সরকার তার সূচনা করেছে।
No comments