বিদায় হজ-এর অভিভাষণ
এই হজ উপলক্ষে হযরত যে কয়টি খোৎবা দান করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অশেষ পরিতাপের বিষয় এই যে, সম্পূর্ণ ও ধারাবাহিকরূপে ঐ খোৎবাগুলির উদ্ধার সাধন করা আজ অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে।
হাদিস, তফসির ও ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তকের বিভিন্ন অধ্যায়ে ঐ অভিভাষণগুলির বিভিন্ন অসম্পূর্ণ অংশ বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে। আমরা যথাসাধ্য যতœ করিয়া এক্ষেত্রে আমাদের আবশ্যক মত ঐ বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে নিম্নে একত্রে বিন্যস্ত করিবার চেষ্টা করিলাম। (মাওলানা আকরম খাঁ-এর ভূমিকা)‘করুমণাময় আল্লাহতাআলার মহিমা কীর্তন এবং তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পর হযরত সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন :
হে লোক সকল! আমার কথাগুলি মনোযোগপূর্বক শ্রবণ কর। আমার মনে হইতেছে, অতঃপর হজ তীর্থে যোগদান করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হইয়া উঠিবে না।
শ্রবণ কর। মূর্খতা-যুগের সমস্ত কুসংস্কার, সমস্ত অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকারের অনাচার আজ আমার পদতলে দলিত-মথিত অর্থাৎ রহিত ও বাতিল হইয়া গেল।
মূর্খতা-যুগের শোণিত-প্রতিশোধ আজ হইতে বারিত, মূর্খতা-যুগের সমস্ত কুসীদ আজ হইতে রহিত। আমি সর্বপ্রথমে ঘোষণা করিতেছি, আমার স্বগোত্রের প্রাপ্য সমস্ত সুদ ও সকল প্রকার শোণিতের দাবি আজ হইতে রহিত হইয়া গেল।
একজনের অপরাধের জন্য অন্যকে দ- দেওয়া যায় না। অতঃপর পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলিবে না।
যদ্যপি কোন কর্তিত-নাসা কাফ্রী ক্রীতদাসকেও তোমাদিগের আমির করিয়া দেওয়া হয় এবং সে আল্লাহর কেতাব অনুসারে তোমাদিগকে পরিচালনা করিতে থাকে, তাহা হইলে তোমরা সর্বতোভাবে তাহার অনুগত হইয়া থাকিবা। -তাহার আদেশ মান্য করিয়া চলিবা।
সাবধান! ধর্মসম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করিও না। এই অতিরিক্ততার ফলে তোমাদিগের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। স্মরণ রাখিও, তোমাদিগের সকলকেই আল্লœাহর সন্নিধানে উপস্থিত হইতে হইবে, তাঁহার নিকট এই সকল কথার ‘জওয়াবদিহি’ করিতে হইবে। সাবধান! তোমরা যেন আমার পর ধর্মভ্রষ্ট হইয়া যাইও না, কাফের হইয়া পরস্পরের রক্তপাতে লিপ্ত হইও না। দেখ, আজিকার এই হজ দিবস যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমাপূর্ণ, মক্কাধামের এই হরম যেমন পবিত্র;-প্রত্যেক মুসলমানের ধন-সম্পদ, প্রত্যেক মুসলমানের মানসভ্রম এবং প্রত্যেক মুসলমানের শোণিতবিন্দুও তোমাদিগের প্রতি সেইরূপ মহানÑ সেইরূপ পবিত্র। পূর্বোক্ত বিষয়গুলির পবিত্রতার হানি করা যেমন তোমরা প্রত্যেকেই অবশ্য পরিত্যাজ্য ও হারাম বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাক, কোন মুসলমানের সম্পত্তির, সম্মানের এবং তাহার প্রাণের ক্ষতিসাধন করাও তোমাদিগের প্রতি সেইরূপ হারাম, সেইরূপ মহাপাতক।
একদেশের লোকের জন্য অন্য দেশবাসীর ওপর প্রাধান্যের কোনই কারণ নাই। মানুষ সমস্তই আদম হইতে এবং আদম মাটি হইতে (উৎপন্ন হইয়াছেন)।
জানিয়া রাখ, নিশ্চয়ই এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভ্রাতা, আর সকল মুসলমানকে লইয়া এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ।
হে লোক সকল! শ্রবণ কর, আমার পর আর কোন নবী নাই, তোমাদের পর আর কোন জাতি (ওম্মৎ) নাই। আমি যাহা বলিতেছি, মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর, এই বৎসরের পর তোমরা হয়ত আমার আর সাক্ষাৎ পাইবে না- ‘এলেম’ উঠিয়া যাওয়ার পূর্বে আমার নিকট হইতে শিখিয়া লও।
চারিটি কথা, হ্যাঁ! এই চারিটি কথা বিশেষ করিয়া স্মরণ রাখিওÑ শেরেক করিও না, অন্যায়ভাবে নরহত্যা করিও না, পরস্ব অপহরণ করিও না, ব্যভিচারে লিপ্ত হইও না।
হে লোক সকল! শ্রবণ কর, গ্রহণ কর এবং গ্রহণ করিয়া জীবন লাভ কর। সাবধান! কোন মানুষের ওপর অত্যাচার করিও না! অত্যাচার করিও না! অত্যাচার করিও না! সাবধান, কাহারও অসম্মতিতে তাহার সামান্য ধনও গ্রহণ করিও না।
আমি তোমাদিগের নিকট যাহা রাখিয়া যাইতেছি, দৃঢ়তার সহিত তাহা অবলম্বন করিয়া থাকিলে তোমরা কদাচিৎ পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইতেছে -আল্লœাহর কেতাব ও তাঁহার রছুলের আদর্শ।
হে লোক সকল! শয়তান নিরাশ হইয়াছে, সে আর কখনও তোমাদের দেশে পূজা পাইবে না। কিন্তু সাবধান, অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলিয়া মনে করিয়া থাক, অথচ শয়তান তাহারই মধ্যবর্তিতায় অনেক সময় তোমাদিগের সর্বনাশ সাধন করিয়া থাকে। ঐগুলি সম্বন্ধে খুব সতর্ক থাকিবা।
অতঃপর, হে লোক সকল! নারীদিগের সম্বন্ধে আমি তোমাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছিÑউহাদিগের প্রতি নির্মম ব্যবহার করার সময় আল্লাহর দ- হইতে নির্ভয় হইও না। নিশ্চয় তোমরা তাহাদিগকে আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করিয়াছ এবং তাঁহারই বাক্যে তাহাদিগের সহিত তোমাদিগের দাম্পত্য স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। নিশ্চয়ই জানিও, তোমাদিগের সহধর্মিণীগণের ওপর তোমাদিগের যেমন দাবি-দাওয়া ও স্বত্বাধিকার আছেু-তোমাদিগের ওপরও তাহাদিগের সেইরূপ দাবি-দাওয়া ও স্বত্বাধিকার আছে। পরস্পর পরস্পরকে নারীদিগের প্রতি সদ্ব্যবহার করিতে উদ্বুদ্ধ করিবা। স্মরণ রাখিও এই অবলাদিগের একমাত্র বল তোমরাই, এই নিঃসহায়াদিগের একমাত্র সহায় তোমরাই।
আর তোমাদিগের দাসদাসীÑ নিঃসহায়-নিরাশ্রয় দাসদাসী! সাবধান! ইহাদিগকে নির্যাতিত করিও না, ইহাদিগের মর্মে ব্যথা দিও না। শুনিয়া রাখ, এছলামের আদেশ : “তোমরা যাহা খাইবে, দাস-দাসীদিগকেও তাহাই খাওয়াইতে হইবে। তোমরা যাহা পরিবে, তাহাদিগকে তাহাই পরাইতে হইবে। কোন প্রকার তারতম্য করিতে পারিবে না।”
যে ব্যক্তি নিজের বংশের পরিবর্তে নিজকে অন্য বংশের বলিয়া প্রচার করে, তাহার উপর আল্লাহর, তাঁহার ফেরেশতাগণের ও সমগ্র মানবজাতির অনন্ত অভিসম্পাত! আমি তোমাদিগের নিকট আল্লাহর কেতাব রাখিয়া যাইতেছি। যাবৎ ঐ কেতাবকে অবলম্বন করিয়া থাকিবা তাবৎ তোমরা পথভ্রষ্ট হইবে না। যাহারা উপস্থিত আছ, তাহারা অনুপস্থিতদিগকে আমার এই সকল ‘পয়গাম’ পৌঁছাইয়া দিবা। হয়ত উপস্থিতগণের কতক লোক অপেক্ষা অনুপস্থিতগণের কতক লোক ইহার দ্বারা অধিকতর উপকার প্রাপ্ত হইবে।’ হযরত এক-একটি পদ উচ্চারণ করিতেছিলেন, আর তাঁহার নকিবগণ বিভিন্ন কেন্দ্রে দ-ায়মান হইয়া অযুতকণ্ঠে তাহার প্রতিধ্বনি করিয়া যাইতেছিলেন। এইরূপে বিশাল জনসঙ্ঘের প্রত্যেক প্রান্তে হযরতের ‘পয়গাম’গুলি প্রচারিত হইয়া গেল। হযরতের বদনম-ল ক্রমশঃই স্বর্গের পুণ্য প্রভায় দীপ্ত এবং তাহার কণ্ঠস্বর সত্যের তেজে ক্রমশই দৃপ্ত হইয়া উঠিতেছে। এই অবস্থায় তিনি আকাশের পানে মুখ তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন : “হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছাইয়া দিয়াছিÑ আমি কি নিজের কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছি?” লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনি উঠিলÑ ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়!’ তখন হযরত অধিকতর উদ্দীপনাপূর্ণ স্বরে বলিতে লাগিলেন : ‘আল্লাহ!্্ শ্রবণ কর, সাক্ষী থাক: ইহারা স্বীকার করিতেছে। আমি আমার কর্তব্য পালন করিয়াছি। হে লোক সকল! আমার সম্বন্ধে তোমাদিগকে প্রশ্ন করা হইবে। তোমরা সে প্রশ্নের কি উত্তর দিবে জানিতে চাই। আরাফাতের পর্বত-প্রান্তর প্রতিধ্বনিত করিয়া লক্ষ কণ্ঠে উত্তর হইল : “আমরা সাক্ষ্য দিব, আপনি স্বর্গের বাণী আমাদিগকে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, নিজের কর্তব্য সম্পূর্ণরূপে পালন করিয়াছেন।” হযরত তখন বিভোর অবস্থায় আকাশের দিকে আঙ্গুলি তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন : “প্রভু হে! শ্রবণ কর, প্রভু হে! সাক্ষী থাক, হে আমার আল্লাহ! সাক্ষী থাক!”
No comments