সন্তোষ গুপ্ত- জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
১৯৮৯ সালে আমার রচিত স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে আমি জুন মাসে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ১৯৬০ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করার ফলে ঢাকার বিদগ্ধ সমাজের অনেকে সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ ছিল না।
বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁদের কয়েকজনের রাজনৈতিক নিবন্ধন ও সাহিত্য সম্পর্কিত রচনা আমি নিয়মিত পড়তাম। কারো কারোর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাঁদের আমন্ত্রণ জানাব বলে স্থির করেছিলাম। আমার পূর্ব-পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ এড়াবার জন্য বললেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থাৎ স্বৈরশাসনের আমলে যে খোলাখুলিভাবে অনেক কথাই বলা যাবে না। তারা ইঙ্গিতে বললেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি পুরোপুরিভাবে সচেতন নই।সন্তোষদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন তাও আমার জানা ছিল না। পরে জেনেছিলাম ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণিক কর্মীদের গোপন বৈঠক চলাকালে সরদার ফজলুল করিমসহ আরো অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের পূর্বে সন্তোষ গুপ্ত কলকাতায় আই.জি প্রিজনস্ অফিসে চাকরিরত ছিলেন। দেশ-বিভাগের পর ‘অপসন’ দিয়ে ঢাকায় আসার পর তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে চাকরিচ্যুত হন। এরপর তাঁকে বহুবার কারাবাস করতে হয়। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকা বার্তা বিভাগে সিনিয়র সহ-সম্পাদক পদে নিয়োজিত ছিলেন। তখন তিনি পত্রিকাটির সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি দৈনিক সংবাদের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা রাজনৈতিক নিবন্ধ পড়ে তাঁর বিদগ্ধ মনের পরিচয় পেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর তাঁর রচিত রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো থেকে বাঙালী জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আনুগত্য সহজেই বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি তাঁর কলমকে অসি হিসেবে ব্যবহার করতেন।
১৯৯০-র দশকের মাঝামাঝি দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, “দি অটোবায়োগ্রাফী অব এ্যান আননোন ইন্ডিয়ান”-এর যুক্তরাজ্যবাসী বাঙালী লেখক নীরদ চৌধুরীর কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমিক ভক্ত তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশে “নীরদ চৌধুরী অনুশীলন সমিতি” গঠন করার ঘোষণা প্রকাশ করেছেন। আমার “স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী” বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী নীরদ বাবুর বাংলাদেশ-বিরোধিতার খবর সন্তোষ গুপ্ত পড়েছিলেন। তাঁকে আমি বললাম, নীরদ বাবুর বাংলাদেশ-বিরোধিতা ও পাকিস্তান প্রেম সম্পর্কে লন্ডনের দি টাইমসে প্রকাশিত একটি চিঠি উদ্ধৃত করে তাঁর বাঙালী ভক্তদের চোখ খুলে দেয়ার জন্য আমি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে চাই। তিনি বললেন, আগামীকাল লেখাটি নিয়ে আসলে ছাপানোর ব্যবস্থা করবেন। লেখাটি সন্তোষ গুপ্তের সহযোগিতায় দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হওয়ার পর নীরদ বাবুর বাঙালী ভক্তরা প্রস্তাবিত সমিতি গঠন করা থেকে বিরত থাকেন।
সুকুমার শিল্প, সাহিত্য এবং রাজনৈতিক মতবাদ সস্পর্কে সন্তোষ গুপ্তের ঋজু দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর জ্ঞানের যে পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আজীবন তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে চাই। সন্তোষদাকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা।
No comments