রাজনীতি-বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলা by সুভাষ সাহা
খালেদা জিয়া কেন যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতকে ছাড়তে পারছেন না? আর শেখ হাসিনাই কেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে পাঠিয়ে ২০০৬ সালে ইসলামী কয়েকটি দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য ফতোয়া জারি করার অধিকারসহ কয়েকটি মৌলবাদী দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি
করার মতো দলের মৌলিক আদর্শবিরোধী অবস্থান নিতে গেলেন? অবশ্য ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তখন ওই চুক্তি বাতিল করতে হয়েছিল। চুক্তিটি বহাল থাকলে আখেরে আওয়ামী লীগ এবং এর নেত্রী শেখ হাসিনা উপকৃত হতেন কি-না আর খালেদা জিয়াই-বা যুদ্ধাপরাধীদের কালিমা নিজের গায়ে মেখে কী উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাচ্ছেন, তা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন।
এই উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। তারপরও এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমীকরণে তাদের গুরুত্ব দেওয়া রেওয়াজ বা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় দাঁড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো এবং আল কায়দা ক্লোন তালেবান অনেক সুসংগঠিত এবং শেষোক্ত সংগঠনটি আত্মঘাতী বোমা হামলা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী হলেও এসব মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্মিলিত জনসমর্থন দুই অঙ্কের ঘর পেরোবে না। তারপরও এসব মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনকে অস্বীকার করে পাকিস্তান চলতে পারছে না। অথচ পাকিস্তানের গেলবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলবাদী ইসলামী দলগুলো তাদের জনসমর্থনের জারিজুরি ফাঁস হয়ে পড়ার ভয়ে অংশগ্রহণই করেনি। তারা এবং তাদের ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতিসৃষ্ট জঙ্গিরা মুসলিম লীগ যেন জেতে সেই প্রত্যাশাই করেছিল; কিন্তু বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করার পরও গেলবার পাকিস্তানের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিজয়কে ঠেকানো যায়নি।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে অবশ্য তারা কিছুটা শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিল। সেটা সামরিক বাহিনীর আনুকূল্যের কারণে। জেনারেল মোশাররফের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা তখন নিজেদের ক্ষমতাকে জায়েজ করে নেওয়ার জন্য একদল সমর্থক খুঁজছিল। নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ও বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপির দ্বিমুখী চাপ মোকাবেলার জন্য এ ধরনের সমর্থন তাদের আবশ্যক ছিল। মোশাররফ এ জন্য সৌদি আরবের বাদশাহর শরণাপন্ন হলেন। তার ফলও মিলল হাতে হাতে। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামী দলগুলো মোশাররফের লোক দেখানো নির্বাচনকে ও সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ফতোয়ার জোর নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। বরাবরের মতো এবারও ইসলামী দলগুলো প্রমাণ করল তারাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক বিশ্বস্ত ত্রাতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ইসলামী দলগুলোর হ্যাপি ম্যারেজের নিট ফল হিসেবে জন্ম হলো পাকিস্তান তালেবানের। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগান তালেবানকে সহায়তা দিতে গিয়ে নিজ দেশেও এই জঙ্গি শক্তিকে আশকারা দিয়ে খাল কেটে কুমির আনার মতো বন্দোবস্ত করল। এতে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার যেমন বিপদ সৃষ্টি হলো, তেমনি খোদ পাকিস্তানে তালেবানি ধরনের শাসন কায়েমের বিপদ সৃষ্টি হলো। এই তালেবানি জঙ্গি শক্তি যদিও নির্বাচনের মাধ্যমে কখনোই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করে না, তবে তারা সামরিক বাহিনীর মধ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির মারফত সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতা করায়ত্ত করার স্বপ্ন দেখতেই পারে। অর্থাৎ উপমহাদেশে যে দেশটিতে মৌলবাদী ও ইসলামী জঙ্গি গ্রুপগুলোর সবচেয়ে শক্ত অবস্থান আছে বলে মনে করা হয়, সেই পাকিস্তানেও মৌলবাদী ও জঙ্গি ইসলামী দল এবং গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবেও নির্বাচনী রাজনীতিতে বিরাট কোনো ফ্যাক্টর নয়। তবে তারা অন্য কারও হয়ে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ইত্যাদি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালাতে সক্ষম। তারা কীভাবে এবং কাদের সহায়তায় পাকিস্তানে ব্যাপক জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে ফ্যাক্টর হয়ে টিকে রয়েছে সেটা পরে আলোচনা করা যাবে। এখন বাংলাদেশে এই মৌলবাদী ও ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর অবস্থাটা কেমন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশে প্রধান ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া চারদলীয় জোট এবং বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক অন্য কয়েকটি ইসলামী দল ভোটের রাজনীতিতে তেমন প্রভাব সৃষ্টিকারী না হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর গায়ে যুদ্ধাপরাধের কালিমা লেপ্টে থাকার পরও বিএনপি এই দলটিকে ছাড়তে কেন পারছে না সেটা অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না। অথচ জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত ভোটের পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশের বেশি হবে না। তাদের চেয়েও এক সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বেশি। তারপরও বিএনপি কি শুধু ইসলামী দলগুলোর ভোট পাওয়ার আশাতেই এখনও জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রয়েছে, নাকি এর পেছনে গূঢ় আরও কোনো উদ্দেশ্য যুক্ত রয়েছে? অথচ আগামী নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের কারণে জামায়াতের সঙ্গ বিএনপির ভোটের রাজনীতির জন্য কাল হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত বলে পরিচিত জুলফিকার আলি ভুট্টোর ১৯৭৪ সালে মৌলবাদী রাজনীতির কাছেই এক ধরনের নতজানু হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। তখন ভুট্টো সরকার পাকিস্তানে আইন করে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেন। আর এই অস্ত্রটি হাতে পেয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ সুনি্ন ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো ফের চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ পেল। সৌদি আরবের বাদশাহ এবং আল রাবিতার পরামর্শেই তিনি এ কাজটি করেছিলেন বলে এখন প্রমাণিত। জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো ১৯৭১ সালে তাদের ঘৃণিত ভূমিকার কারণে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ_ উভয় দেশেই উৎখাত হয়ে গিয়েছিল। ভুট্টো তাদের ফের মাথা তুলতে সাহায্য করলেন পাকিস্তানে আর জেনারেল জিয়া করলেন বাংলাদেশে। পাকিস্তানে ফের ইসলামী মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ শক্তি সঞ্চয় করার মওকা পেল এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আবার পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করার অবস্থায় পেঁৗছে গেল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও পেন্টাগন তখন হরিহর আত্মা। এভাবেই সৌদি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জীবন, ক্ষমতা ও পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে বলি দেওয়ার পাঠ চক্রাকারে ঘুরানোর পুরনো রাজনৈতিক খেলার অনুঘটক হিসেবে কাজ করলেন ভুট্টো। তাদের আশকারা দিলে কী অবস্থা দাঁড়ায় বর্তমানে জঙ্গি হামলায় বিদীর্ণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ভুট্টোর ভুলের পথ ধরেই জেনারেল জিয়া পাকিস্তানকে একটি গোঁড়া ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজটি সফলভাবে করে যান।
বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে লক্ষ্য করা যায়। তখন সরকারে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো অংশ নেয়। তখন সারাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। সে সময় ইসলামী জঙ্গিদের রাশ টেনে ধরার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কঠোর মনোভাব গ্রহণ না করলে আমাদের অবস্থা যে এতদিনে পাকিস্তানের মতো হতো না তা কে বলতে পারে! বর্তমান সরকারের আমলে এই মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তি অনেকটাই দিশেহারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে অনেকটাই কোণঠাসা। তবে তারা যে কোনো সময় আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কারণ তারা মধ্যপ্রাচ্যের মৌলবাদী ইসলাম প্রচারের ঝাণ্ডাধারী এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট। সম্ভবত সৌদি সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইসলামকে এক্সপ্লয়েট করার দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে তারা এখনও প্রয়োজনীয়। এর সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পুরনো স্ট্র্যাটেজি এখনও কার্যকর রয়েছে কি-না সেটাও ভুলে যাওয়া যায় না। ভালো খবর হলো, ভারত যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করবে না বলে ঘোষণা করেছে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হওয়ার পর কখনও যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে, তাহলে তারা তাকেও সমর্থন করবে কি? ভোল পাল্টে এখন যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছে। এরপর জামায়াত বা ইসলামী দলগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কি একই অবস্থান নিয়ে তাদের রক্ষা করতে চাইবে? মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মিসরের দিকে তাকালে আমরা একটা সম্ভাব্য উত্তর মনের মধ্যে গেঁথে নিতে পারি। তবে এটা নিশ্চিত যে, জনদাবি যদি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়, তখন একমাত্র রাজনৈতিক ইসলামের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব ছাড়া ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই তাদের রক্ষা করতে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসবে না।
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া কেউই মৌলবাদী দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে নিজ নিজ দল ও দেশের ক্ষতি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে উপকার করতে পারবেন না। এই মৌলবাদ উপমহাদেশে এখনও একেবারেই প্রান্তিক শক্তি। এখানে ইসলাম কখনও মৌলবাদকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়নি। তাই এখানে তালেবানি শাসন মুসলমান মনকে আকর্ষণ করে না। আর গণতন্ত্র বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হলো এই রাজনৈতিক ইসলাম। সুতরাং জামায়াতে ইসলামীকে পৃষ্ঠপোষকতা তাদের নিজেদের স্বার্থে বিদেশিরা করে করুক, আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল দেশের ও নিজেদের দলের স্বার্থেই তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। ভুট্টোর বিয়োগান্ত ঘটনা ও পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে উপনীত হওয়া থেকে আমাদের প্রধান প্রধান গণতান্ত্রিক দলের নেতা-নেত্রীদের অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
এই উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই ব্যাপক জনসমর্থন পায়নি। তারপরও এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমীকরণে তাদের গুরুত্ব দেওয়া রেওয়াজ বা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় দাঁড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো এবং আল কায়দা ক্লোন তালেবান অনেক সুসংগঠিত এবং শেষোক্ত সংগঠনটি আত্মঘাতী বোমা হামলা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে পারদর্শী হলেও এসব মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর সম্মিলিত জনসমর্থন দুই অঙ্কের ঘর পেরোবে না। তারপরও এসব মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনকে অস্বীকার করে পাকিস্তান চলতে পারছে না। অথচ পাকিস্তানের গেলবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলবাদী ইসলামী দলগুলো তাদের জনসমর্থনের জারিজুরি ফাঁস হয়ে পড়ার ভয়ে অংশগ্রহণই করেনি। তারা এবং তাদের ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতিসৃষ্ট জঙ্গিরা মুসলিম লীগ যেন জেতে সেই প্রত্যাশাই করেছিল; কিন্তু বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করার পরও গেলবার পাকিস্তানের নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিজয়কে ঠেকানো যায়নি।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে অবশ্য তারা কিছুটা শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিল। সেটা সামরিক বাহিনীর আনুকূল্যের কারণে। জেনারেল মোশাররফের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা তখন নিজেদের ক্ষমতাকে জায়েজ করে নেওয়ার জন্য একদল সমর্থক খুঁজছিল। নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ ও বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপির দ্বিমুখী চাপ মোকাবেলার জন্য এ ধরনের সমর্থন তাদের আবশ্যক ছিল। মোশাররফ এ জন্য সৌদি আরবের বাদশাহর শরণাপন্ন হলেন। তার ফলও মিলল হাতে হাতে। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামী দলগুলো মোশাররফের লোক দেখানো নির্বাচনকে ও সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ফতোয়ার জোর নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। বরাবরের মতো এবারও ইসলামী দলগুলো প্রমাণ করল তারাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক বিশ্বস্ত ত্রাতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং ইসলামী দলগুলোর হ্যাপি ম্যারেজের নিট ফল হিসেবে জন্ম হলো পাকিস্তান তালেবানের। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগান তালেবানকে সহায়তা দিতে গিয়ে নিজ দেশেও এই জঙ্গি শক্তিকে আশকারা দিয়ে খাল কেটে কুমির আনার মতো বন্দোবস্ত করল। এতে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার যেমন বিপদ সৃষ্টি হলো, তেমনি খোদ পাকিস্তানে তালেবানি ধরনের শাসন কায়েমের বিপদ সৃষ্টি হলো। এই তালেবানি জঙ্গি শক্তি যদিও নির্বাচনের মাধ্যমে কখনোই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করে না, তবে তারা সামরিক বাহিনীর মধ্যে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির মারফত সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে পাকিস্তানের ক্ষমতা করায়ত্ত করার স্বপ্ন দেখতেই পারে। অর্থাৎ উপমহাদেশে যে দেশটিতে মৌলবাদী ও ইসলামী জঙ্গি গ্রুপগুলোর সবচেয়ে শক্ত অবস্থান আছে বলে মনে করা হয়, সেই পাকিস্তানেও মৌলবাদী ও জঙ্গি ইসলামী দল এবং গোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবেও নির্বাচনী রাজনীতিতে বিরাট কোনো ফ্যাক্টর নয়। তবে তারা অন্য কারও হয়ে হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ইত্যাদি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালাতে সক্ষম। তারা কীভাবে এবং কাদের সহায়তায় পাকিস্তানে ব্যাপক জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিকভাবে ফ্যাক্টর হয়ে টিকে রয়েছে সেটা পরে আলোচনা করা যাবে। এখন বাংলাদেশে এই মৌলবাদী ও ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর অবস্থাটা কেমন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশে প্রধান ইসলামী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়া চারদলীয় জোট এবং বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক অন্য কয়েকটি ইসলামী দল ভোটের রাজনীতিতে তেমন প্রভাব সৃষ্টিকারী না হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর গায়ে যুদ্ধাপরাধের কালিমা লেপ্টে থাকার পরও বিএনপি এই দলটিকে ছাড়তে কেন পারছে না সেটা অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না। অথচ জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোর সম্মিলিত ভোটের পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশের বেশি হবে না। তাদের চেয়েও এক সময়ের স্বৈরশাসক এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বেশি। তারপরও বিএনপি কি শুধু ইসলামী দলগুলোর ভোট পাওয়ার আশাতেই এখনও জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রয়েছে, নাকি এর পেছনে গূঢ় আরও কোনো উদ্দেশ্য যুক্ত রয়েছে? অথচ আগামী নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের কারণে জামায়াতের সঙ্গ বিএনপির ভোটের রাজনীতির জন্য কাল হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী মৌলবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত বলে পরিচিত জুলফিকার আলি ভুট্টোর ১৯৭৪ সালে মৌলবাদী রাজনীতির কাছেই এক ধরনের নতজানু হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। তখন ভুট্টো সরকার পাকিস্তানে আইন করে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেন। আর এই অস্ত্রটি হাতে পেয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ সুনি্ন ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো ফের চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ পেল। সৌদি আরবের বাদশাহ এবং আল রাবিতার পরামর্শেই তিনি এ কাজটি করেছিলেন বলে এখন প্রমাণিত। জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো ১৯৭১ সালে তাদের ঘৃণিত ভূমিকার কারণে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ_ উভয় দেশেই উৎখাত হয়ে গিয়েছিল। ভুট্টো তাদের ফের মাথা তুলতে সাহায্য করলেন পাকিস্তানে আর জেনারেল জিয়া করলেন বাংলাদেশে। পাকিস্তানে ফের ইসলামী মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ শক্তি সঞ্চয় করার মওকা পেল এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আবার পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করার অবস্থায় পেঁৗছে গেল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও পেন্টাগন তখন হরিহর আত্মা। এভাবেই সৌদি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জীবন, ক্ষমতা ও পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে বলি দেওয়ার পাঠ চক্রাকারে ঘুরানোর পুরনো রাজনৈতিক খেলার অনুঘটক হিসেবে কাজ করলেন ভুট্টো। তাদের আশকারা দিলে কী অবস্থা দাঁড়ায় বর্তমানে জঙ্গি হামলায় বিদীর্ণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। ভুট্টোর ভুলের পথ ধরেই জেনারেল জিয়া পাকিস্তানকে একটি গোঁড়া ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজটি সফলভাবে করে যান।
বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে লক্ষ্য করা যায়। তখন সরকারে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো অংশ নেয়। তখন সারাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। সে সময় ইসলামী জঙ্গিদের রাশ টেনে ধরার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কঠোর মনোভাব গ্রহণ না করলে আমাদের অবস্থা যে এতদিনে পাকিস্তানের মতো হতো না তা কে বলতে পারে! বর্তমান সরকারের আমলে এই মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তি অনেকটাই দিশেহারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে অনেকটাই কোণঠাসা। তবে তারা যে কোনো সময় আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কারণ তারা মধ্যপ্রাচ্যের মৌলবাদী ইসলাম প্রচারের ঝাণ্ডাধারী এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট। সম্ভবত সৌদি সমর্থন এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইসলামকে এক্সপ্লয়েট করার দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে তারা এখনও প্রয়োজনীয়। এর সঙ্গে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পুরনো স্ট্র্যাটেজি এখনও কার্যকর রয়েছে কি-না সেটাও ভুলে যাওয়া যায় না। ভালো খবর হলো, ভারত যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করবে না বলে ঘোষণা করেছে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হওয়ার পর কখনও যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে, তাহলে তারা তাকেও সমর্থন করবে কি? ভোল পাল্টে এখন যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছে। এরপর জামায়াত বা ইসলামী দলগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কি একই অবস্থান নিয়ে তাদের রক্ষা করতে চাইবে? মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মিসরের দিকে তাকালে আমরা একটা সম্ভাব্য উত্তর মনের মধ্যে গেঁথে নিতে পারি। তবে এটা নিশ্চিত যে, জনদাবি যদি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়, তখন একমাত্র রাজনৈতিক ইসলামের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব ছাড়া ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই তাদের রক্ষা করতে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসবে না।
শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া কেউই মৌলবাদী দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে নিজ নিজ দল ও দেশের ক্ষতি ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে উপকার করতে পারবেন না। এই মৌলবাদ উপমহাদেশে এখনও একেবারেই প্রান্তিক শক্তি। এখানে ইসলাম কখনও মৌলবাদকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়নি। তাই এখানে তালেবানি শাসন মুসলমান মনকে আকর্ষণ করে না। আর গণতন্ত্র বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হলো এই রাজনৈতিক ইসলাম। সুতরাং জামায়াতে ইসলামীকে পৃষ্ঠপোষকতা তাদের নিজেদের স্বার্থে বিদেশিরা করে করুক, আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল দেশের ও নিজেদের দলের স্বার্থেই তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে পারে না। ভুট্টোর বিয়োগান্ত ঘটনা ও পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে উপনীত হওয়া থেকে আমাদের প্রধান প্রধান গণতান্ত্রিক দলের নেতা-নেত্রীদের অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments