বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৬০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম দুঃসাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত এলাকা থেকে দিনের বেলায় গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানের নেতৃত্বে মাধবপুরে রওনা হন একদল মুক্তিযোদ্ধা।
বেলা আনুমানিক দুইটার দিকে তাঁরা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছান। দিনটি ছিল ২৩ মে, ১৯৭১। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সড়কে চলাচলরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অ্যাম্বুশ করা। রেকি তথ্যের ভিত্তিতে হেলাল মোর্শেদ স্থান নির্বাচন করেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সেতুর পাশে নির্মিত সংযোগ সড়ক। সেখানে দুটি ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইন পেতে অপেক্ষায় থাকেন। তার পর সময় গড়ায়।
কিন্তু সেদিন পাকিস্তানিরা আসেনি। গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান এতে হতাশ হননি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাতে সেখানেই থাকেন। ওই রাতে বৃষ্টি হয়। তাঁরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে যান। সারা রাত বিনিদ্র অবস্থায় ছিলেন। সকাল হওয়ার পর পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে আবার অ্যাম্বুশস্থলে আসেন।
বেলা আড়াইটার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় আসে। জিপ, লরি ও পিকআপ মিলে কনভয়ে মোট ২২টি গাড়ি ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গাড়ি (জিপ) পার হয়ে যায়। মাইন বিস্ফোরিত হয়নি। চতুর্থটি (পিকআপ) পার হওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয়। সেটি উড়ে গিয়ে কয়েক গজ দূরে পড়ে। দ্বিতীয় গাড়িরও একই ভাগ্য ঘটে।
এ সময় গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানের সংকেতে সহযোদ্ধা সবার অস্ত্র গর্জে ওঠে। হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। অক্ষত পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। ২৫ মার্চের পর ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের যুদ্ধে তিনি আহত হন।
১৩ এপ্রিল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী ভৈরব মুক্ত ছিল। এর পর পাকিস্তানিরা আশুগঞ্জ-ভৈরব দখলের জন্য সড়কপথে ভৈরবে উপস্থিত হয়। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে হেলিকপ্টারে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের প্রায় এক কোম্পানি সেনা নামে। গানবোট ও অ্যাসল্ট ক্রাফটের সাহায্যে নদীপথেও সেনা আসে। এ সময় হেলাল মোর্শেদ একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আশুগঞ্জের দুই মাইল দক্ষিণে লালপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন।
১৪ এপ্রিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি বহর লালপুরের কাছে মেঘনা নদীতে অবস্থান নেয়। তারা অবতরণের স্থান পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করতে থাকে। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সংকেত বা নির্দেশ ছাড়াই উত্তেজনার বশে গুলি করে। এতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের প্রতিরক্ষা স্থান চিহ্নিত করে ফেলে এবং ট্যাংকের সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানি নৌবহর পিছু হটে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট তাঁদের অবস্থানে আকাশ থেকে গোলাগুলি শুরু করে। এর ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের প্রায় ঘেরাও করে।
হেলাল মোর্শেদ চরম বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধও করেন। কিন্তু জল-স্থল-আকাশপথের ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণে তাঁরা সেখানে টিকতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনিসহ অনেকে আহত হন। এ অবস্থায় তাঁরা পিছু হটে যান।
ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর হেলাল মোর্শেদ ৩ নম্বর সেক্টরের কলকলিয়া-বামুটিয়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আশুগঞ্জ (লালপুর), তেলিয়াপাড়া, মাধবপুর, শাহজীবাজার, মুকুন্দপুর ও বামুটিয়ার যুদ্ধ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২০।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর জেনারেল এবং বগুড়ায় জিওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জ (ঠিকানা আফজাল খান রোড) জেলায়। তবে স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকার বসুন্ধরা-বারিধারায় (বাসা ৩০২, সড়ক ৬)। তাঁর বাবার নাম গোলাম আরব আলী খান, মা আফরোজা খানম। স্ত্রী নাহিদ খান। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
কিন্তু সেদিন পাকিস্তানিরা আসেনি। গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান এতে হতাশ হননি। সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাতে সেখানেই থাকেন। ওই রাতে বৃষ্টি হয়। তাঁরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে যান। সারা রাত বিনিদ্র অবস্থায় ছিলেন। সকাল হওয়ার পর পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে আবার অ্যাম্বুশস্থলে আসেন।
বেলা আড়াইটার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় আসে। জিপ, লরি ও পিকআপ মিলে কনভয়ে মোট ২২টি গাড়ি ছিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গাড়ি (জিপ) পার হয়ে যায়। মাইন বিস্ফোরিত হয়নি। চতুর্থটি (পিকআপ) পার হওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরিত হয়। সেটি উড়ে গিয়ে কয়েক গজ দূরে পড়ে। দ্বিতীয় গাড়িরও একই ভাগ্য ঘটে।
এ সময় গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানের সংকেতে সহযোদ্ধা সবার অস্ত্র গর্জে ওঠে। হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। অক্ষত পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। ২৫ মার্চের পর ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের যুদ্ধে তিনি আহত হন।
১৩ এপ্রিল পর্যন্ত আশুগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী ভৈরব মুক্ত ছিল। এর পর পাকিস্তানিরা আশুগঞ্জ-ভৈরব দখলের জন্য সড়কপথে ভৈরবে উপস্থিত হয়। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে হেলিকপ্টারে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের প্রায় এক কোম্পানি সেনা নামে। গানবোট ও অ্যাসল্ট ক্রাফটের সাহায্যে নদীপথেও সেনা আসে। এ সময় হেলাল মোর্শেদ একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আশুগঞ্জের দুই মাইল দক্ষিণে লালপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন।
১৪ এপ্রিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি বহর লালপুরের কাছে মেঘনা নদীতে অবস্থান নেয়। তারা অবতরণের স্থান পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করতে থাকে। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর সংকেত বা নির্দেশ ছাড়াই উত্তেজনার বশে গুলি করে। এতে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের প্রতিরক্ষা স্থান চিহ্নিত করে ফেলে এবং ট্যাংকের সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ মোকাবিলা করেন। তাঁদের পাল্টা আক্রমণের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানি নৌবহর পিছু হটে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট তাঁদের অবস্থানে আকাশ থেকে গোলাগুলি শুরু করে। এর ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের প্রায় ঘেরাও করে।
হেলাল মোর্শেদ চরম বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও বিচলিত হননি। সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধও করেন। কিন্তু জল-স্থল-আকাশপথের ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণে তাঁরা সেখানে টিকতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনিসহ অনেকে আহত হন। এ অবস্থায় তাঁরা পিছু হটে যান।
ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর হেলাল মোর্শেদ ৩ নম্বর সেক্টরের কলকলিয়া-বামুটিয়া সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আশুগঞ্জ (লালপুর), তেলিয়াপাড়া, মাধবপুর, শাহজীবাজার, মুকুন্দপুর ও বামুটিয়ার যুদ্ধ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য গোলাম হেলাল মোর্শেদ খানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২০।
গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর জেনারেল এবং বগুড়ায় জিওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জ (ঠিকানা আফজাল খান রোড) জেলায়। তবে স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকার বসুন্ধরা-বারিধারায় (বাসা ৩০২, সড়ক ৬)। তাঁর বাবার নাম গোলাম আরব আলী খান, মা আফরোজা খানম। স্ত্রী নাহিদ খান। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments