কোন দিকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন! by গাজীউল হাসান খান

পূর্ব উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ শেষে জরুরি ত্রাণকাজের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল এতটুকু কমেনি। ২৮ অক্টোবর থেকে 'সুপার স্টর্ম স্যান্ডির' তাণ্ডবের কারণে দু-তিন দিনের ক্ষণিক বিরতির পর আবার যথারীতি পর্যায়ক্রমে শুরু হয়েছিল নির্বাচনী বিভিন্ন কার্যক্রম ও প্রচারণামূলক হৈচৈ।


বিভিন্ন পূর্ব উপকূলীয় রাজ্যে ঝড়ের কারণে ঘটে যাওয়া প্রাণহানি, সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয় এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতার সংকট কাটিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবার দ্রুত সোচ্চার হয়ে উঠেছিল মোটামুটি পহেলা নভেম্বর থেকেই। হাতে মাত্র গোনা কয়েকটা দিন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে গোড়া থেকেই। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বাজেট ঘাটতি কমানো এবং ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমে এ নির্বাচন নিয়ে হিসাব-নিকাশ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্রই এ নির্বাচন নিয়ে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের নেতা-নেত্রী, সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে দেখা দেয় এক শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলো যখন শুরু হয়েছিল প্রধান দুই প্রার্থী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং রিপাবলিকান দলীয় সাবেক গভর্নর মিট রমনির তুমুল প্রচারণা ও ভোটের লড়াই; তখনই যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে দেখা দেয় অত্যন্ত শক্তিশালী ঝড়ের এক অপ্রত্যাশিত তাণ্ডব। প্রথমে আটলান্টিকের উপকূলে নিউ ইয়র্ক রাজ্যের বাসিন্দাদের ঝড়ের সম্ভাব্য আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করা হয়। এ ছাড়া ফেডারেল রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, নিউজার্সি, মেরিল্যান্ড ও পেনসিলভানিয়া রাজ্য থেকে নর্থ ক্যারোলাইনা পর্যন্ত বিরাট এলাকাজুড়ে নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। সে কারণে শেষ পর্যায়ে প্রার্র্থীদের চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রচারণায় যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। প্রেসিডেন্ট ওবামা অগ্রাধিকারদের দেন জনগণের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বকে। অন্যদিকে কিছু কিছু নিরাপদ রাজ্যে পূর্ব নির্ধারিত নির্বাচনী সভা ও প্রচারণার কাজ চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত তার কর্মসূচি স্থগিত করেন মিট রমনি।
ওবামা ও রমনির মধ্যে ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় ও শেষ নির্বাচনী বিতর্কের পর ডেমোক্র্যাট দলীয় বর্তমান প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় কিছুটা বাড়লেও মিট রমনি তেমনটি পিছিয়ে পড়েছিলেন বলে মনে হয়নি। তাই তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকেরই ধারণা যে শেষ পর্যন্ত ওবামা এবং সাবেক গভর্নর রমনির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জনমত জরিপে উল্লিখিত প্রার্থী দুইজনের জনপ্রিয়তার হার দেখা গেছে প্রায় সমানে সমান। সে কারণেই প্রায় সর্বত্র বিরাজ করছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা। যুক্তরাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত জটিল পদ্ধতির নির্বাচনী ব্যবস্থায় শুধু দেশব্যাপী জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ওপর কোনো প্রার্থীর চূড়ান্ত বিজয় নির্ভর করে না। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যে জনগণের সরাসরি ভোট প্রদানের পাশাপাশি রয়েছে তাদের স্থানীয় রাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজে ভোট। প্রতিটি রাজ্যেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে যথারীতি নির্বাচিত হয়ে থাকেন নির্বাচকমণ্ডলী এবং তাঁদেরই ভোটে গঠিত হয় ইলেকটোরাল কলেজ। যদিও স্থানীয় জনসংখ্যা অনুপাতে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা এক নয়; তবুও রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের পক্ষেই যায় ইলেকটোরাল কলেজের ভোট। তাঁদের ভোটেই শেষ পর্যর্ন্ত কোনো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হয়। সে কারণেই বলা হয়, জনগণের সরাসরি ভোটের ওপর কোনো প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ভর করে না। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বমোট ভোট পেয়েও কোনো প্রার্থীর পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যে দুইজন করে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে সিনেটরের পদ নির্ধারিত করা আছে এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের (নিম্নকক্ষ) সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয়ে থাকে প্রতিটি রাজ্যের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসংখ্যা, সিনেটরদের সংখ্যা এবং ওয়াশিংটন ডিসির তিনজন নিয়ে ইলেকটোরাল কলেজ গঠন করা হয়। ফলে বিভিন্ন রাজ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যারও তারতম্য দেখা যায়। জনসংখ্যা অনুযায়ী বিশাল ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৫৩ এবং ফ্লোরিডায় ২৯। এভাবে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য মিলিয়ে রয়েছে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট। এর মধ্যে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে কোনো প্রার্থীকে অবশ্যই ২৭০টি ভোট পেতে হবে। বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে যায় নির্বাচকমণ্ডলী বা ইলেকটোরাল কলেজের ভোট। কোনো রাজ্যে কোনো প্রার্থী যদি তুলনামূলকভাবে কম ভোট পান, তাহলে তিনি নির্বাচকমণ্ডলী বা ইলেকটোরাল কলেজের ভোট লাভে ব্যর্থ হবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সব রাজ্যে সব প্রার্থীর সমান জনপ্রিয়তা নাও থাকতে পারে। নিউ ইয়র্কসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে যেমন ডেমোক্র্যাটদের বেশি প্রভাব রয়েছে, তেমনি অন্য অনেক রাজ্যে আবার রিপাবলিকানদের জনসমর্থন রয়েছে বেশি। তাই এবারের নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে 'দোদুল্যমান রাজ্যগুলো' অর্থাৎ যেসব রাজ্য কার পক্ষে যাবে এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তাদের ভোটের ওপরই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে বলে অনেকে মনে করেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিডিয়াসহ জনগণের দৃষ্টি এখন তেমন ৯টি রাজ্যের ওপরই নিবদ্ধ হয়ে আছে। 'সুইং স্টেট' নামে পরিচিত সেসব রাজ্যের মধ্যে রয়েছে ওহাইয়ো, ফ্লোরিডা, আইওয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, ভার্জিনিয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নাভাদা, উইসকনসিন ও কলোরাডো। ফ্লোরিডা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার সন্দেহ থাকায় তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত ওহাইয়ো, আইওয়া, ভার্জিনিয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, উইসকনসিন ও নাভাদার দিকে বেশি নজর দিয়েছিলেন। এতে সুইং স্টেটগুলোয় প্রার্থীদের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্যভাবে প্রচারণার মাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যায়। তবে শেষের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ওবামাকে সেসব রাজ্যে প্রচারণার কাজ বাদ দিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জরুরি ত্রাণ তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়েছে। নিউজার্সিসহ এরই মধ্যে কয়েকটি রাজ্যের উপদ্রুত এলাকা সফর করেছেন তিনি।
ইরাকে যুদ্ধকালীন অবস্থায় এবং আফগানিস্তান আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় রিপাবলিকান দলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের কর্মকাল শেষ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তখন শুরু হয় অত্যন্ত এক নাজুক পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনীতিতে ক্রমেই তখন নীরবে এক হতাশাব্যঞ্জক ধস নেমে এসেছিল। ফলে দিন দিন শ্রমজীবী মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারাতে শুরু করে। বাড়ি-ঘরের মর্টগেজের অর্থ পরিশোধ করতে না পারার কারণে বিভিন্ন রাজ্যে অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে শিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অনেকটা সে অবস্থার সূচনায় নির্বাচিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বের ওপর জনগণের অগাধ আস্থা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি ও সার্বিক অবস্থাকে জনগণের প্রত্যাশা অনুপাতে টেনে তুলতে পারেননি ওবামা। তাঁর প্রশাসনের গত চার বছরে কাঙ্ক্ষিতভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যেমন নেমে এসেছিল এক বিপর্যয়কর মন্দা অবস্থা; তেমনি তার অশুভ প্রভাব পড়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতেও। এশিয়ার বিশেষ করে জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি হলেও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা কালো ছায়া ফেলতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্বে লক্ষণীয়ভাবে বাণিজ্যের পরিমাণ কমে যায় অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর। গত চার বছর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অবস্থা থেকে টেনে তোলার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। ইরাকে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সব সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া তাদের দেশীয় মোটর শিল্পে পুঁজি ঢেলে জেনারেল মোটরস্সহ কয়েকটি উৎপাদনশীল খাতে যথেষ্ট সুফল পেয়েছেন। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে এনেছেন, অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখাও সম্ভব হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সে দুর্দিনেও প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বাস্থ্যসেবা (ওবামা কেয়ার) এবং ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতে বেশ উল্লেখযোগ্য আইনানুগ সংস্কার সাধন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেক মানুষের কোনো স্বাস্থ্যবীমা ছিল না। সে অবস্থায় 'ওবামা কেয়ার' নামে খ্যাত তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত অল্প মূল্যে তিনি সাধারণ মানুষের ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন। অধিকহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা উৎপাদনশীল খাতকে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে পরিকল্পনার মধ্যে আনার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ ছাড়া উচ্চবিত্তকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনির মতো আরো কর সহায়তার আশ্বাস না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীকে কিছুটা সহায়তা দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার জন্য নির্বাচনী ঘোষণা দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তের ওপর কিছুটা বর্ধিত হারে করারোপ করে এবং প্রতিরক্ষাসহ কয়েকটি বিশেষ খাতে কিছুটা ব্যয় কমিয়ে ব্যাপক বাজেট ঘাটতি হ্রাস করার একটি কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন ওবামা। তার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়ারও পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিম্ন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি জ্বালানি আমদানি হ্রাস করা এবং সে ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় কমিয়ে আনার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন তিনি। এ ছাড়া জ্বালানি সংকট ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণে নিজ দেশেই তিনি কয়লা, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানের ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। দেশের মানুষকে বেকার রেখে তুলনামূলকভাবে কম খরচে বিদেশ থেকে বিভিন্ন কাজ করিয়ে আনার বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। তিনি সম্ভবপর সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কাজ 'আউট সোর্সিং' না করে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ওপর নতুন আঙ্গিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামার পাশাপাশি তাঁর প্রতিপক্ষ সাবেক গভর্নর মিট রমনিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পুনর্বিন্যস্ত ও শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। রিপাবলিকানদের চিরাচরিত প্রথায় তিনি বিত্তশালীদের জন্য কর সহায়তা তেমনভাবে আর বৃদ্ধি না করে মধ্যবিত্তকে আগের তুলনায় বেশ কিছুটা সহায়তা এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁর পূর্বঘোষিত পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের কর সহায়তাকে কমিয়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে একদিকে দেশের বাজেট ঘাটতি যেমন কমবে; তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে সহায়তাদানের মাধ্যমে নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য রমনি দক্ষিণ বা লাতিন আমেরিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে চীনের প্রতি সমালোচনায় মুখর রমনি একদিকে বাজেট ঘাটতি হ্রাসের কথা বললেও অন্যদিকে নৌবাহিনীসহ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির কথা প্রচার করে পরস্পরবিরোধী কাজ করছেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ও ইসরায়েলের প্রভাবাধীন গণমাধ্যমে ও শিল্পপতি বা ধনিক শ্রেণীর খপ্পরে পড়ে রমনি মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামিক বিশ্ব নিয়ে এরই মধ্যে এমন সব কথা বলেছেন, যাতে মনে হয়েছে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর কোনো নিরপেক্ষতার প্রশ্নই নেই। তিনি জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী করার প্রস্তাবকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেন। রমনি নির্বাচিত হলে ইরান আক্রান্ত হতে পারে- তার আচার-আচরণে যেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদী তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, মুসলিম বিশ্ববিরোধী এবং সবশেষে ইসরায়েলের পক্ষে গোপন আঁতাতভিত্তিক এক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিট রমনি নির্বাচিত হলে মানবতার দৃষ্টিতে তাঁর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং পুরনো ব্যবসায়িক মানসিকতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি কতটুকু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, তাতে ইতিমধ্যে অনেকে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ঘোষণা করার পর থেকে অনেক কথা বা কর্মসূচিতে তিনি স্থির থাকতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বিপর্যস্ত আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জনপ্রিয়তা লাভের জন্য তাঁর সুবিধামতো তিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধে যখন যা খুশি বলতে দ্বিধাবোধ করেননি।
প্রেসিডেন্ট ওবামার নেতৃত্বাধীন বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন অত্যন্ত ধীরগতিতে হলেও ক্রমেই যখন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ওবামা প্রশাসনকে সাধ্যাতীত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়েছে। ফলে ইউরোপের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের এ পর্যন্ত অর্জিত প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তবুও বিরোধী শিবিরে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের আগে রমনির পক্ষে বিভিন্ন অভিযোগ আনা যত সহজ ছিল, ক্ষমতাসীনদের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এত সহজ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ যাঁদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি এখনো চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, তারাসহ সে দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীকে নির্বাচনে সে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করেই ভোট প্রদান করতে হবে। সেটিই হবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের দায়িত্বশীল নাগরিকদের সঠিক কর্তব্য। সে কারণেই এবারের নির্বাচনের গুরুত্ব এতটা বেশি এবং এবারের নির্বাচন নিয়ে এতটা শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা। এবারের নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করবে কতটা সময়ের মধ্যে এবং কী গতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং ইউরোপ ও এশিয়াসহ বিশ্বের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যায় শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রায় ঘুচে এসেছে। শ্বেতাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের সংখ্যা সাম্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে বহু জাতি ও বহু বর্ণভিত্তিক এক নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠতে যাচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য চাই বারাক ওবামার মতো একজন সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব। নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংখ্যালঘু কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা অনির্দিষ্টকাল ধরে শুধু শোষিত-বঞ্চিতই হতে থাকবে তাদের সার্বিক মুক্তি সুদূরপরাহত হয়ে পড়বে। এ আশঙ্কা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকের মধ্যেই বিরাজ করছে।
নিউ ইয়র্ক থেকে
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.