কথা সামান্যই-বর্ণ ধর্ম জাতি সম্পর্কিত আইন by ফজলুল আলম

আমি ব্যক্তিগতভাবে অতীতের ইতিহাস, বিশেষ করে আমাদের পরাধীনতার ইতিহাস পড়ে কোনো আনন্দ পাই না, উপভোগ তো করিই না। তার পরও স্বীকার করতে বাধ্য হই, ব্রিটিশরা যে দৃঢ় পণ করে ভারতবর্ষ দখলে সফলতা


অর্জন করে, তা যে ছলাকলায়ই করে থাকুক না কেন, তা নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক কালের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তারা একে একে ভারতের দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করে এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন শর্ত করে বার্ষিক করের বিনিময়ে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেয়, অনেক রাজা-রানিকে মোটা পেনশনের লোভ দেখিয়ে গদিচ্যুতও করে। তাদের সামরিক শক্তির সঙ্গে কূটনৈতিক কৌশল ভারতের বিভিন্ন রাজরাজড়াকে পরাজিত করে অনায়াসে। এর জন্য তারা যে সর্বদাই সততার সঙ্গে কাজ করেছিল তা নয়, উল্টো ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির খুঁটি গেড়েছিল যে রবার্ট ক্লাইভ, তাকে পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কার্পেটে দাঁড়িয়ে তার অপকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছিল।
ভারতে ২০০ বছর রাজত্বের ফলে ব্রিটেনের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্য আরো দেশকে পদানত করতে করতে ব্রিটেন সারা বিশ্বে নিজেদের রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। প্রথম ১০০ বছরে তারা ব্রিটিশ আইন ভারতে প্রয়োগ করলেও সেসব ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আইন বলে মনে করা হতো। কিন্তু ১৮৫৭-এর বিপ্লবের পরে ভারতবর্ষ সরাসরি ইল্যান্ডের রানি কর্তৃক শাসিত হতে শুরু করে এবং সে সময় থেকেই ব্রিটেনের আইনকানুন (তাদের পার্লামেন্টে পাস করা) দিয়ে এ দেশের আইন ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। তার প্রায় ৯০ বছর পর এ দেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের প্রবর্তিত আইনকানুনে ভারতে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চলে গেলেও আমরা ব্রিটেনের আইন শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্মানের সঙ্গে মান্য করি।
যা ভালো তা গ্রহণ করা বড় মনের পরিচয়, বিশেষত যা মানুষের মঙ্গলের জন্য, তা মানতে দোষ নেই। ব্রিটেনের আইনকানুন কিন্তু সবটাই ব্রিটেনের নয়। বিশ্বের প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ও আধুনিক সভ্যতা থেকে গৃহীত জনমঙ্গলের নীতিমালাও ব্রিটেনের আইনে সন্নিহিত করা হয়েছে। তার ওপরে যোগ হয়েছে জুরিসপ্রুডেন্স বা 'মানবিক আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন'। এটা কোনো দেশকালের বিষয় নয়, এটা কিছু জুরিস্ট, অর্থাৎ যাঁরা আন্তর্জাতিক জুরিসপ্রুডেন্স সংঘের নির্বাচিত সদস্য, তাঁরা পরিচালনা করেন (বাংলাদেশের ড. কামাল হোসেন একজন আন্তর্জাতিক জুরিস্ট)। ফলে যাঁরা দেশের জন্য আইন তৈরি করেন, তাঁদের শুধু আইন সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই হবে না, আইন কেন তৈরি করতে হবে, আইনের পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি কী ও তত্ত্বগতভাবে কোন দর্শনের ওপর সেসবের ভিত্তি হবে তা জানতে হবে। সেসবও যেসব আইন প্রণয়নকারী সজাগভাবে স্মরণ করবেন তাও নয়; নতুন আইন এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে তৈরি করা হচ্ছে। যেমন ব্রিটেনের 'রেস রিলেশনস অ্যাক্ট'। বিগত শতকের সত্তর-আশির দশকে ব্রিটেনে বর্ণবিদ্বেষ (কৃষ্ণকায় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শ্বেতকায় ব্যক্তি) এমন বেড়ে গিয়েছিল যে সেটা দমন করতে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এই আইন পাস করে এবং বর্ণবিদ্বেষকে একটা ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইনের আওতায় আনে। তাতে কিছু ফল হয়েছিল, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ (কৃষ্ণকায়দের চাকরি না দেওয়া বা নিচু পদে রাখা) বেশ কমে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাড়ায় পাড়ায় কৃষ্ণবর্ণের ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণও কমে গিয়েছিল। কিন্তু বর্ণবাদ এতে চলে যায়নি, বরং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেশ বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছিল।
একটা ফাঁক ছিল 'ধর্ম'। জাতিগত বৈষম্যের মধ্যে 'ধর্ম'কে আনা যায় না। ফলে সারা ব্রিটেনে শিখ বা মুসলমানরা তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-ব্যবহারে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার কারণে চাকরি না পেলে বা চাকরিচ্যুত হলে ওই 'রেস রিলেশনস অ্যাক্টে'র কোনো আইনগত সুবিধা পেত না। ফলে কর্তৃপক্ষ যদি দাবি করত যে ধর্মের কারণে তাদের চাকরি হয়নি, সেটা ওই রেস রিলেশনস আইনে পড়ত না।
অবশেষে এক জুরিস্ট ইংল্যান্ডের এই আইন চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁর মতে, জুরিসপ্রুডেন্সের সংজ্ঞায় জাতির সঙ্গে ধর্ম এক সূত্রে গাঁথা। এর পর রেস রিলেশনস অ্যাক্টে শুধু বর্ণ ও জাতি নয়, ধর্মও সন্নিহিত করা হয়। ব্রিটেনের এই আইন পৃথিবীর অনেক দেশে নিজেদের অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গৃহীত হয়েছে, তার ওপর কানাডার মাল্টিকালচারালিজম আইন মিলে বর্তমানে আইনের দৃষ্টিতে পশ্চিমের দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী (এথনিক মাইনরিটি) আইনের বিচার পেতে শুরু করেছে। ব্রিটেনে 'রেস রিলেশনস অ্যাক্ট' ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ অনেক কমিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশে রামু ও পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধদের ওপর হামলার আগ পর্যন্ত আমরা 'আদিবাসী' না 'উপজাতি'- এই অর্থহীন বিতর্কে কালাতিপাত করছিলাম। এখন রামুর ঘটনায় দেখা গেল যে অন্যের সম্পত্তি বিনষ্ট করার সাধারণ আইন ছাড়া দেশে সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো আইনই মিয়ানমারে বা বাংলাদেশে নেই।
কিছুদিন আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরিচালিত দেশব্যাপী এক জরিপে জানা গেছে যে দেশে ২৫০টির ওপরে উপজাতি আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে এই 'উপজাতি' কাদের বলা হবে সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা কেউ পায়নি। ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও উপজাতি বলা হয়েছে। এই তো আমাদের গবেষণার অবস্থা! দেশে নাকি একটি সরকারি নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র আছে ও সরকারের তালিকাভুক্ত বিশেষজ্ঞও আছেন! তাঁদের আওয়াজটাওয়াজ খুব একটা পাই না কেন? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের কাছে না গিয়ে সরাসরি জেলা প্রশাসকের কাছে যায় কেন?
ব্রিটেন থেকে আইন ও ব্যারিস্টারি পাস করা ব্যক্তির অভাব এ দেশে নেই, এমনকি সংসদেও ব্যারিস্টার সংসদ সদস্যও আছেন। আইন প্রণয়ন করা যাঁদের কাজ, তাঁরা তো একটু চোখ মেলে বাংলাদেশের সব সাংস্কৃতিক জাতি-গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দেওয়ার আইন করতে পারেন; আর কিছু না পারি ব্রিটেনের রেস রিলেশনস অ্যাক্টের নকল করা হলেও তো কিছু কাজ হবে।

লেখক : কথাশিল্পী ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.