অরণ্যে রোদন- ‘আমার ঘুম আসে না’ by আনিসুল হক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে এই প্রথম আলোতেই একটা কলাম লিখেছিলাম। লেখাটা ছিল একটা খোলা চিঠির মতো। তখন খুব পুশআউট-পুশইন হচ্ছিল। মানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নো-ম্যানস-ল্যান্ড হয়ে উঠেছিল অমানবিক জমিন, কিংবা না-মানুষি জমিন।


কোত্থেকে কোত্থেকে বাংলাভাষী মানুষদের ধরে এনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ঠেলে দিচ্ছিল বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ রাইফেলসও তাদের ঢুকতে দেবে না এই দেশের ভূখণ্ডে। ওই আদমসন্তানেরা পড়ে ছিল খোলা আকাশের নিচে, সীমান্তের নো-ম্যানস-ল্যান্ডে। খুব শীত ছিল তখন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা কবিতা থেকে তখন উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম:

‘গাড়ি বারান্দার নিচে আমরণ অনশনে বসে আছে
তিনজন শ্রমিক
আজ তের দিন ধরে ওদের দেখছি!
শীর্ণ মুখে জ্বলজ্বলে চোখ, রুখু দাড়ি, জট-পাকানো চুল
আধো-হেলান দিয়ে বসা, ওদের ঘুম নেই, খালি পেট
তেতো জিভে ঘুম আসে না
ওদের দেখার জন্য ভিড় জমেনি, ওদের জন্য মেডিক্যাল বুলেটিন বেরুবে না...
‘আমি রাজনীতি-ফিতি বুঝি না! আমি সইতে পারছি না ঐ
তিনজন মানুষের নিঃশব্দ বসে থাকা
তোলপাড় করছে আমার বুক...
‘বাড়িতে ফিরে ভাতের থালার সামনে আমার গা
গুলিয়ে ওঠে—সারা রাত আমার ঘুম আসে না।’

সুনীলের এই কবিতা এবং আরও অনেক কবিতা, আমার কৈশোরে আমার মন তৈরিতে সাহায্য করেছিল। ভারত-বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্র যখন কয়েকজন মানবসন্তানকে নিয়ে অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছিল, পুশইন- পুশআউটের নামে মানুষের ন্যূনতম মানবিক সম্মানটুকু দিতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল, তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল, ভাতের থালার সামনে আমার গা গুলিয়ে উঠছিল। ওই সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার শেরিফ, আমি তাঁর উদ্দেশে লিখেছিলাম, প্রিয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আপনার খারাপ লাগে না?
আজকে নিজের কথা নিজেকেই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। কতগুলো মানুষ, অবিকল আমারই মতো দেখতে, তাদেরও হাত আছে পা আছে আমারই মতো, তাদের ভাষা আছে, তাদের ঘরবাড়ি ছিল সাধ্যমতো, তাদেরও বাবা, মা, সন্তান আছে, ভাইবোন আছে, বাগান ছিল, জমিজিরেত ছিল, চারদিকে আগুন দেখে, ধ্বংস দেখে, মৃত্যু দেখে বেঁচে থাকার আকুলতায়, নিরাপত্তার আশায় তারা নাফ নদী পেরিয়ে, সমুদ্রে ডিঙি ভাসিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে চায়। তাদের মধ্যে শিশু আছে। তাঁদের মধ্যে গর্ভবতী নারী ছিলেন, বাংলাদেশের হাসপাতালে যার সন্তান জন্ম নিয়েছিল, আমরা, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র, তাদের গ্রহণ করছি না। ফিরিয়ে দিচ্ছি সেই অনিশ্চয়তায়, যেখান থেকে দুঃস্বপ্ন-তাড়িত হয়ে তারা ফিরে এসেছিল। এইবার আমি আমার নিজের বিবেককেই শুধাই, আনিসুল হক মিয়া, আপনার খারাপ লাগে না?
সত্যি সত্যি আমার খারাপ লাগছে। ভীষণ খারাপ লাগছে। এটা হওয়া উচিত নয়। আমাদের এতটা অমানবিক কি হওয়া উচিত? আমরাও তো ৪১ বছর আগে দলে দলে, প্রায় এক কোটি মানুষ এমনি রকম মৃত্যু, আগুন, নিপীড়ন দেখে প্রাণভয়ে পালিয়ে আশ্রয় চেয়েছিলাম পাশের দেশে, তারা যদি সেদিন তাদের সীমান্ত সিল করে দিত, কী হতো আমাদের?
সুনীল তো বলেই খালাস, আমি রাজনীতি-ফিতি বুঝি না! কিন্তু আমি নিয়মিত কলাম লেখক, আমি যদি বলি, আমি রাজনীতি বুঝি না, তা হলে আপনারা বলবেন, যা বোঝো না, তা লিখতে যাও কেন? তুমি জানো না, রোহিঙ্গারা কত বড় সমস্যা এ দেশে? প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা নব্বইয়ের দশকে এসেছিল এই দেশে, তাদের সদ্গতি করা যায়নি। তারা বাংলাদেশের জন্য সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে। তারা জঙ্গি হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। তাদের দিয়ে নানা অপরাধ, মাদক ও অস্ত্রের চোরাচালান করানো হচ্ছে। ওদের আমরা এই দেশে স্থান দিতেই পারি না। তার ওপর আমাদের দেশের ওই এলাকাটায় নিরাপত্তাবিষয়ক স্পর্শকাতরতা আছে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি চক্রের যোগ আছে বা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তৎপরতা শুরু করুক, সেটাই বা আমরা হতে দেবে কেন? কাজেই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ হচ্ছে, ওই রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দিয়ো না। আর তুমি কি জানো না, এই যে রামুতে উখিয়ায় বৌদ্ধমন্দির ও বসতিতে হামলা হলো, এর পেছনেও তো রয়েছে রোহিঙ্গা সংযোগ!
প্রথম কথা, আমি সাধারণীকরণের খুব বিপক্ষে। অমুকেরা খারাপ, এই ধরনের ঢালাও মন্তব্য খুবই বিপজ্জনক। রোহিঙ্গারা খারাপ, তারা অপরাধী, তারা জঙ্গি, রোহিঙ্গা মানেই সমস্যা, আমি এইভাবে ঢালাও কথার বিপক্ষে। কোনো একটা জায়গার মানুষ এই রকম, কোনো একটা রঙের মানুষ ওই রকম, কোনো একটা দেশের সবাই কিপটে, এইভাবে বলতে নেই, এটা সত্য নয়। সত্য হলো, সব জায়গায়, সব জাতিতে, সব দেশে, সব ভাষায় ভালো মানুষ আছে, খারাপ মানুষ আছে। কোনো ভালো মানুষও কোনো এক সময় খারাপ কাজ করতে পারে, আবার সাত খুনের আসামিও তাঁর শিশুর কান্না সহ্য করতে পারেন না, শিশুর মুখে একটুখানি হাসি দেখলে আবেগে চোখের জল মোছেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের জন্মস্থান ফেলে শখ করে এই দেশে আসেনি। তারা বাধ্য হয়ে এসেছে। আসতে তাদের কষ্ট হয়েছে, নাড়িছেঁড়া কষ্ট। শিকড় ওপড়ানোর কষ্ট। এখনো যারা আসছে, তারা বনপোড়া হরিণীর মতো ছুটে আসছে।
দ্বিতীয় কথা হলো, বুঝলাম, আমাদের সাধ্য নেই রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানানোর, তাদের ঠাঁই দেওয়ার, তাদের জন্য শিবির গড়ার। তা হলে সুউচ্চ স্বরে যথেষ্ট মাত্রায় প্রতিবাদ করছি না কেন?
আমরা যুদ্ধ চাই না। শান্তি চাই। কোনো অজুহাতেই কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠুক, এটা আমরা ভাবতেই চাই না। আবার সৈন্যসংখ্যা ও সমরশক্তির দিক থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে, ক্রমাগত গণতন্ত্রহীনতা, জবাবদিহিহীনতা ও সামরিক শাসন ওখানকার মানবিক উন্নয়নের চেয়ে সামরিক উন্নয়নেই বেশি বিনিয়োগ ঘটিয়েছে। ডেইলি স্টার-এ (নভেম্বর ৫, ২০১২) মো. চৌধুরী যেমনটা বলেছেন, মিয়ানমারের (এবং বাংলাদেশ) ভূ ও সমুদ্র এলাকায় বিশ্বশক্তির খেলোয়াড়দের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডির সমাধানে কোনো স্বাধীন শক্ত পদক্ষেপকে প্রতিহত করে চলেছে।
আপাতত বল আমাদের কোর্টে নেই। এটা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর হাতে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দোস্তি পুরোনো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, হাজার হাজার ঘরবাড়ি পোড়ানো হলো, লক্ষ মানুষ আশ্রয় না পেয়ে পশুর পালের মতো ঘুরছে, কত মানুষ মারা গেল, এখন কোথায় মানবাধিকারের প্রবক্তারা! তারা কেন মিয়ানমারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করছে না এই অমানবিক জাতিগত সহিংসতা বন্ধ করার জন্য। কেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অপরাধীদের বিচার হবে না?
রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ না মুসলিম—এটা আমার কাছে প্রধান বিবেচ্য নয়। রোহিঙ্গারা বাংলাভাষী কি না, এটাও আমাকে কমই ইমপ্যাথি দেয়। আমার প্রধান বিবেচ্য হলো, ওরা মানুষ। একজন মানুষও যদি ব্যথা পায়, আমি ব্যথা পাই। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশের মানুষেরা বাড়িঘর হারিয়ে, স্বজন হারিয়ে একটুখানি আশ্রয়ের সন্ধানে, নিরাপত্তার খোঁজে আমার দরজায় এসে মাথা কুটে মরছে। আমি দরজা খুলে তাদের ভেতরে নিতে পারছি না, এতে যে আমার কী খারাপ লাগছে!
বাংলাদেশ সরকারের উচিত, মিয়ানমারের ভেতরের এই মানবতাবিরোধী তৎপরতাকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মুখ গুঁজে না থেকে কথা বলা, আওয়াজ তোলা, অন্তত বিশ্বপরিমণ্ডলে আওয়াজ তোলার জন্য বিভিন্ন কৌশল নেওয়া। একাত্তর সালে ইন্দিরা গান্ধী বেরিয়েছিলেন বিশ্বসফরে, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, এই ছিল তাঁর সফরের প্রতিপাদ্য। বাংলাদেশকেও এই প্রচারণায় নামতে হবে। আর আমাদের সিভিল সোসাইটিরও উচিত, এই বিষয়ে বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকারবাদী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তৎপর হওয়া।
আমার খুব মনে হয়, আহা, ওই বাচ্চাটা যদি আমি হতাম, যে তার রোহিঙ্গা বাবা-মায়ের সঙ্গে নৌকায় উঠে সাগর-নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছে। আর ঢুকতে না পেরে ফের ফিরে যাচ্ছে। একাত্তর সালে আমি খুব ছোট ছিলাম। পাকিস্তানি মিলিটারি আসবে শুনে আমরা রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আরেক গ্রামে গিয়েছিলাম। সেই সময়কার ভয় আমার বুক চেপে ধরে। আর ওই বাচ্চারা নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে দেখেছে। ওদের কেমন লাগছে?
নীরবতা ভাঙার সময় কি পেরিয়ে যাচ্ছে না?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.