ভুল বিকাশ by মঈনুল আহসান সাবের

হানিমুন থেকে ফিরে যাওয়ার আগের রাতে কথাটা বলে মুনীর। একটু আগে তারা ডাইনিং রুম থেকে রাতের খাবার সেরে ফিরেছে। মুনীর সিগারেট ধরিয়ে একবার বাইরে তাকায়। জানালার রঙিন স্বচ্ছ পর্দা সরাতেই অল্প সামনে রাতের সমুদ্র।


চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে জল, ফেনিল ঢেউ। তীরে দেখা যায় একজন-দু'জন লোক, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ খুব আস্তে হাঁটছে। বাতাসে উড়ছে তীরের ধুলোবালি। বন্ধ জানালার ফাঁকফোকর গলে ঢেউয়ের গর্জন এসে পেঁৗছায় এ ঘরেও। মুনীর পর্দা নামিয়ে টেনে দেয়। স্বচ্ছ পর্দার ওপাশে কাচের জানালা ভেদ করে চাঁদের আলোয় চকচকে সমুদ্র সামান্য বোঝা যায়। 'শোনো',_ মুনীর ঘরের ভেতর চোখ ফিরিয়ে এনে বলে।
স্বপ্না ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখছিল। খুব কাছ থেকে আয়নায় নিজের চোখ, নাক, ঠোঁট, চিবুক খুঁটিয়ে দেখছিল মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। পাউডারের পাফ মৃদু বুলোয় চোখের নিচে, চিবুকের পাশে। নিজের সুন্দর দাঁতগুলো একবার দেখে নেয়। লম্বা চুল একবার সামনে নিয়ে আসে, পরে উপরে ধরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। মুনীরের দিকে সে একবার তাকায়, পর মুহূর্তে আবার চোখ ফিরিয়ে আনে আয়নার ওপর। নিজের চোখ দুটো পরিপূর্ণ মেলে দিয়ে বলে, 'এই দ্যাখো, আমার চোখের নিচে কালি পড়েছে কেন?' 'সম্ভবত ক্লান্তি।' মুনীর জানালার কাছ থেকে সরে এসে স্বপ্নার পাশে দাঁড়িয়ে দু'হাতে তার মুখ তুলে ধরল, 'হুঁ ক্লান্তি, খুব দৌড়াদৌড়ি করা হলো এ ক'দিন, তোমার আবার মোমের...।' কথা শেষ করতে দিল না স্বপ্না, 'জানো',_ সে বলল, 'ক্লাসের ছেলেগুলো না আমাকে মোমের পুতুল বলত।' 'জানি'_ মুনীর বলল, 'তুমি বলেছ... একটা কথা স্বপ্না।' কিন্তু স্বপ্না চোখ ফেরাল না আয়না থেকে, 'আমার চোখ দুটো কেমন, বলো তো?'
মুনীর সিগারেট শেষ করে বিছানায় পা উঠিয়ে বসল, 'তোমার চোখ দুটো, দাঁড়াও বলছি, কখনো মনে হয় ও দুটো কোনো দুষ্ট হরিণের ছিল। কখনো মনে হয় শান্ত পুকুর, না না পুকুর ভালো শোনায় না, শান্ত সরোবর।'
: আমার নাক?
: বাঁশির মতো। কিন্তু বাঁশির মতো কেন যে বলা হয় তা আমি আদতেই জানি না।
: আর আমার গাল?
: কখনো কাঁচা-পাকা আপেল, বিদেশি আপেল, কখনো মনে হয় পাতলা মেঘের আড়াল থেকে চুইয়ে পড়ছে চাঁদের আলো।
: আমার ঠোঁট?
: প্রবালের মতো।
: আর আমার হাসি, বলো?
: কখনো মনে হয়, যখন জোরে হাসো তখন মনে হয় বাতাসে উড়ে যাচ্ছে গোলাপ পাপড়ি।
হাসি হাসি মুখে স্বপ্না উঠে এলো মুনীরের সামনে। মুখ নামিয়ে এনে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, 'আমাকে একটু আদর করো।' স্বপ্না আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফিরে যাচ্ছিল। মুনীর বলল, 'আমার কথাটা শুনবে না?'
: 'বলো, তুমি নিজেই বলছ না'_স্বপ্না স্ট্যাচুর মতো দাঁড়াল, 'কি বলবে বলো, আমি শুনছি।'
: না, এখানে আসো, অত দূরে থেকে হবে না।
: ভালোবাসা থাকলে অত দূর থেকেও হয়, জানো?
: না, মাইয়ামানুষটা জ্বালাইয়া মারল।
: জোনাল ল্যাঙ্গুয়েজ তোমার একদম হয় না, উচ্চারণ করতেই পার না, দাঁড়াও আসছি।
স্বপ্না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে, শরীরে স্প্রে করে পারফিউম, সামান্য পাউডার বুলোয় ঘাড়ে, গলায়, বুকে। চুল বেঁধে নেয়। আলো নিভিয়ে দিয়ে মুনীরের পাশে বসে বলল, 'এবার বলো, আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী কী বলে শুনি।'
মুনীর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, 'কাল এক জায়গায় যাবে?'
: কাল তো ফিরে যাচ্ছি...
স্বপ্না আধশোয়া হয়।
: কাল ফেরার সময় বলতে গেলে পথেই পড়বে, তোমাকে অনেক দিন হলো বলব ভাবছিলাম।
: খুলে-মেলে বলো। তুমি সব সময় তোমার কথাকে এমন অহেতুক শাড়ি-ব্লাউজ-ব্রা পরিয়ে রাখো।
: তোমার মুখ একদম গেছে... শোনো_জায়গাটার নাম নবীপুর গ্রাম, আমরা কাল ভোরে রওনা দিলে বিকেলের দিকে ওখানে পেঁৗছে যাব।
: গ্রাম? যাব। আমি কোনো দিন গ্রাম দেখিনি। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী?
'একাত্তর সালে বুঝেছো।' মুনীর সিগারেট ধরাল, 'একাত্তর সালে আমি ওই গ্রামে ছিলাম দিন তিনেক, ঢাকায় তখন তাণ্ডব, লোকজন সুযোগ পেলেই সরে পড়ছে, কাকে কখন ধরে নিয়ে যাবে, গুলি করে মারবে তার কোনো ঠিক নেই, আমি আবার একটু রাজনীতি করতাম, ভয় ছিল, তাই একদিন কাটি মারলাম, বিদায় ঢাকা শহর আর পাক আর্মি। পথে তিন দিন থাকলাম নবীপুরে, অবস্থা যে তখন কী ছিল, তুমি বুঝতে পারবে না।'
'তা বটে।' স্বপ্না মাথা ঝাঁকালো, 'ছিলাম বিদেশে, শুধু টেলিভিশন আর খবরের কাগজ, মারাত্মক সব ব্যাপার-স্যাপারের খবর পেতাম বটে, কিন্তু তোমাদের মতো ইনভলভড তো ছিলাম না, তাই চেষ্টা করলেও তোমাদের মতো বুঝতে পারব না।'
'টেলিভিশনে তো দেখাচ্ছেই কিভাবে পালাচ্ছিল মানুষ, এখন মনে হয় গরু-ছাগলের পালের মতো পালিয়েছিলাম। যাকগে, বাবা-মা ঢাকায় থাকল, আরো কয়েকজন মুরবি্বর সঙ্গে, আমি ঢাকা ছাড়লাম। নবীপুর পেঁৗছে সীমান্ত পেরোনোর প্ল্যান করছিলাম, তখনও কিন্তু আর্মি পেঁৗছায়নি নবীপুরে। আর শুধু আমি? আমার মতো কত মানুষ তখন ওখানে, সব বর্ডার ক্রস করার আগে বিশ্রাম নিচ্ছিল, কী আদর গ্রামবাসীদের। স্বপ্না, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।' 'গ্রামের লোকেরা খুব নরম হয়, না?' স্বপ্না জিজ্ঞেস করে।
'হ্যাঁ, আমার সঙ্গে গ্রামের প্রায় সব লোকের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। আর যে বাড়িতে ছিলাম সেখানে তো কথাই নেই, একদম ঘরের মানুষ, লোকজন দেখিয়ে দিয়েছিল স্যাক্রিফাইস কাকে বলে, তিনটে দিন ছিলাম, বুঝেছো; কিন্তু আমাকে কুটোটাও সরাতে হয়নি, শুধু বসে বসে খাওদাও, ঘুরেফিরে বেড়াও, শুধু আমিই নই, যত লোক গিয়েছিল, তারা সবাই অমন রাজার হালে ছিল।'
স্বপ্না বলল, 'আমি তবে যাব, আমাকে রানীর হালে রাখবে, না?' মুনীর জ্বলন্ত সিগারেট এগিয়ে ধরল স্বপ্নার দিকে_'ইয়ার্কি মেরো না; ছ্যাঁকা দেব।' একটু পেছনে সরে স্বপ্না, খুব চ্যাঁচাবার মতো করে বলে, 'দাও, ওটাই তো পারো, বিয়ের পর থেকেই দেখছি শুধু ছ্যাঁকাই দিয়ে যাচ্ছো... আর কি যে শুধু সিগারেট খাও, মুখে গন্ধ হয়।' তারপর হাসে, নরম গলায় বলে_'ওই গন্ধের মধ্যে একটা পৌরুষ অবশ্য আছে বৈকি!'
'নাও, দুটো টান দাও'_মুনীর সিগারেট আরো বাড়িয়ে দেয়।
'এ্যাই, তুমি না বলো আমার মধ্যে এই লাজুক-লাজুক নরম-নরম মেয়েলি ভাব তুমি বেশি পছন্দ করো, সিগারেট দিচ্ছ যে বড়, আমার মধ্যে পুরুষালি ভাব_সেটা কি তোমার ভালো লাগবে, না ব্যাপারটা ভালো হবে, বলো?'
কথা শেষ করেই সিগারেটে টান দিয়ে সে অনেকক্ষণ কাশে, মাগো, কি বিচ্ছিরি সিগারেট, আগেরটার মতো না, এ তো রিকশাঅলারা খায়, অবশ্য তুমিও ওদের মতোই কাঠখোট্টা... কী যেন বলছিলে?
'আদর-যত্ন। স্বপ্না, পারে তো আমাদের জন্য সব উজাড় করে দেয়, আর যেদিন নবীপুর ছাড়ব ভেবেছিলাম সেদিন সন্ধ্যায় মিলিটারি এলো, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার সব এদিক-ওদিক বনে-জঙ্গলে, ধান-পাট ক্ষেতে লুকিয়ে কূল পাই না। ধরাই বোধ হয় পড়ে যেতাম, গুলি খেয়ে মরতে হতো, তোমাকে চুমু খাওয়ার জন্য এই মুনীর আর থাকত না। ওই ওরাই বাঁচিয়েছিল, তিন দিনের যে কত গল্প, বলে ফুরানো যাবে না।'
'ইন্টাররেস্টিং'_স্বপ্না বলল, 'তুমি আগে বলনি কেন, যারা আমার প্রাণপ্রিয় পতির প্রাণ বাঁচিয়েছিল, এত আদর-যত্ন করেছিল তাদের ওখানে যাব না? কী যে বলো?'
'তিন বছর হয়ে গেল, আমার উচিত ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যাওয়া, কিন্তু এসএমজি কাঁধে ঝুলিয়ে নবীপুরের পাশ দিয়েই ঢাকা ফিরলাম, আর যাওয়া হলো না। এই তিন বছরে একবারও হলো না। ভাবতে এখন লজ্জা লাগে। অকৃতজ্ঞ বলে একটা শব্দ আছে মনে পড়ে যায়, ওরাই বা কী ভেবেছিল। অবশ্য ওদের কে কেমন আছে যেমন আমি জানি না, তেমনি ওরাও আমার সম্বন্ধে পুরোপুরিই অজ্ঞ। দেখে নিশ্চয় খুব খুশি হবে, তার ওপর তুমি আছো সঙ্গে। প্রথমেই খুব বিনয়ের সঙ্গে মাফ চেয়ে ওদের রাগটাগ সব মুছে দেব কেমন?'
'তুমি একটা চামার'_স্বপ্না আলতো একটা ঘুষি বসায় মুনীরের চিবুকে, 'এত দিনে তোমার যাওয়ার সময় হলো, তিন বছর পর ইশ! পুরুষমানুষ সব পারে, মনে হচ্ছে আমাকে গিয়ে তোমার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।'
'কী করব, এত কাজ সব সময়, ইচ্ছে যে করত না এমন তো না; কিন্তু যাব বললেই কি যাওয়া হয়, আর তোমাকে বিয়ে করার জন্যই আমাকে পাক্কা এক বছর ঘুরতে হলো।'
স্বপ্না ইয়ার্কি মেরে একটু লাজুক হাসলো_'সত্যি?'
'তিন সত্যি... কিন্তু এখন এমন একটা সুযোগ পেয়েছি, আর তুমিও যেতে চাচ্ছো_সুতরাং কাল আমরা যাচ্ছি।'
'জানো, ভালোভাবে গ্রাম আমার দেখা হয়নি। তুমি একটু বর্ণনা দাও না নবীপুরের, মানুষজন কেমন ছিল?'
'এখন নয়, ঘুম পাচ্ছে। নবীপুরের তিন দিনের গল্প বলতে তিন দিন লাগবে। কাল সারাটা পথ ধরে তোমাকে নবীপুরের গল্প শোনাব। এখন ঘুমাব।'

No comments

Powered by Blogger.