কালান্তরের কড়চা-দিল্লির লাড্ডু খেয়েও বেগম জিয়া পস্তাতে পারেন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ব্রিটেনের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জার্মানির সঙ্গে মিউনিখ শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে লন্ডনে ফিরে এসে বলেছিলেন, আমি ইউরোপের জন্য আগামী ২০ বছরের শান্তির নিশ্চয়তা নিয়ে এসেছি।
এর কিছুকালের মধ্যেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে এবং চেম্বারলেনকে 'অ্যাপিজমেন্ট নীতি'র অনুসারীর দুর্নাম নিয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
বেগম খালেদা জিয়া দিল্লি সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে একটি অলিখিত শান্তিচুক্তিও করে এসেছেন বলে প্রকাশ। তিনি বলেছেন, 'আমরা আর অতীতের দিকে ফিরে তাকাব না।' অর্থাৎ অতীতের ভারতবিরোধী নীতি আর অনুসরণ করবেন না। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে তৎপরতা চালাতে দেবেন না। চাই কি, ধর্মান্ধ দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রাখবেন না। ভারত বিনিময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নেবে না বলে বিএনপি নেত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে। ভারতের এই নতুন কূটনীতির সূচনা অবশ্য বহু আগেই, অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের সময় শুরু হয়। তিনি খালেদা জিয়াকে বলে গিয়েছিলেন, ভারত কোনো বিশেষ দলের আর বন্ধু হবে না। সে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায়। ইঙ্গিতটা স্পষ্টভাবেই ছিল আওয়ামী লীগের দিকে। এই দলের সঙ্গে ভারতের যে ট্র্যাডিশনাল বন্ধুত্ব, তা পরিবর্তনের ইঙ্গিতই প্রণব বাবু দিয়েছিলেন। সেই পরিবর্তনেরই স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে খালেদা জিয়ার এবারের দিল্লি সফরের সময়।
অবশ্য দিল্লি এবারও একটু চাণক্যনীতির আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি থেকে সরকারি সব শীর্ষ নেতাই খালেদা জিয়াকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন, কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সাক্ষাতের সময় করে উঠতে পারেননি। এখানেও ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। ভারত সরকার বিএনপির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, কিন্তু দল হিসেবে কংগ্রেস এখনো বাড়ায়নি। এটা বোধ হয় আওয়ামী লীগের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার।
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভারত সফরকে ব্যালান্স করেছেন। দিল্লি যাওয়ার আগে তিনি চীন সফর করে এসেছেন। অর্থাৎ চীনকেও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ভারত সফর চীনের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। কেবল বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তনে বিএনপিরও একটু বাঁক পরিবর্তন মাত্র। কিন্তু তাতেও আওয়ামী লীগ প্রথমে আশ্বস্ত হতে পারেনি। বেগম জিয়ার ভারত সফর, উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ ও দিল্লিকে তাদের চিরাচরিত ভারতবিরোধী নীতি পরিবর্তনের আশ্বাস দেওয়ায় আওয়ামী লীগ এই ভেবে বিচলিত হয়েছে যে ভারতের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বমূলক অবস্থানের সমভাগ বুঝি বিএনপি নিয়ে নিল! ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা রাজনৈতিক বিজ্ঞতা ও পরিপক্বতার পরিচায়ক নয়। আমার আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাওস থেকে ফিরে আসার পর বিএনপি নেত্রীর দিল্লি সফর সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন, তাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন।
খালেদা জিয়া চেম্বারলেনের মতো বলেননি, তাঁর দিল্লি সফর দ্বারা গোটা উপমহাদেশের জন্য আগামী কয়েক বছরের শান্তির নিশ্চয়তা বহন করে এনেছেন। কিন্তু এ কথা সত্য, ভারতে অবস্থানকালে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা যদি বাস্তবে অনুসরণ করেন তাহলে উপমহাদেশে সত্যিই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল, এই সফরকে উৎসাহিত ও অভিনন্দিত করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন পানিচুক্তি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী তৎপরতা উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করার ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যাপারে খালেদা জিয়াও একই নীতি অনুসরণের আশ্বাস ভারতকে দিয়েছেন। এটা আওয়ামী লীগের নৈতিক জয়। আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর নেতা ও মন্ত্রী তা বুঝতে পারেননি এবং এই ভেবে নার্ভাস হয়ে পড়েছেন যে ভারতের সঙ্গে তাঁদের সখ্যের 'মনোপলি' বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপি হয়তো তার ফায়দা লুটবে। বৃহত্তর দেশপ্রেম দ্বারা প্রভাবিত হলে আওয়ামী লীগ নেতারা এই সফরের ইতিবাচক দিকটাই আগে দেখতেন। সফরের সাফল্য কামনা করতেন। তার বদলে তাঁদের কেউ কেউ সপত্নীসুলভ ঈর্ষার পরিচয় দিয়েছেন।
ভারতের এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে খালেদা জিয়ার ভারত সফর সম্পর্কে আমার আলাপ হচ্ছিল। তিনি যুক্তি দেখালেন, হাসিনা সরকারের হাতকে সবল করার জন্যই ভারত সরকার খালেদার প্রতি সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপি সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দানের নীতি থেকে সরে এলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শান্তিময় ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তাতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় লাভ। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এই পরিবেশের সুফল ভোগ করবে।
তাঁকে বলেছি, আমি তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। আওয়ামী লীগের প্রতি কংগ্রেস সরকারের নীতি গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার মতো। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকেই দেখে আসছি, বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহলগুলো ছেড়ে দিয়েছে, ভারত দেয়নি। আদালতের রায়ের ধুয়া তুলে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি করেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে এই চুক্তির শর্ত পালন করেনি। বর্তমানেও হাসিনা সরকারের হাত শক্তিশালী করার প্রকৃষ্ট পন্থা ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধের সমস্যা নিরসন, সীমান্তে প্রত্যহ বিএসএফের বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ করার মাধ্যমে। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব বাবু যে অর্থনৈতিক সাহায্যের প্যাকেজ ডিল নিয়ে এসেছিলেন সেটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দ্বারা। ভারত এখন পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়ন করেনি। মমতার ধুয়া তুলে তিস্তা ও টিপাইমুখ সমস্যা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অব্যাহত আছে।
হাসিনা সরকারের আমলে এসব সমস্যার একটা মোটামুটি সমাধান দ্বারা দেশের সেক্যুলারপন্থী ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সরকারের হাত যেমন শক্তিশালী করা যেত, তেমনি বাংলাদেশে যে চিরাচরিত ভারত বিরোধতার হাওয়া বহমান, তা ঘুরে যেত। তিস্তা, টিপাইমুখ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি অব্যাহত রেখে কেবল হাসিনা সরকারের ওপর তেল-গ্যাস বা ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে চাপ সৃষ্টি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীসুলভ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতবিরোধিতা নীতি পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি আদায় করে কোনো লাভ হবে না। সত্যিকার অর্থে ভারতকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তার চাণক্যসুলভ নীতি পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে এ কথা বুঝতে দিতে হবে, ১৯৭১ সালের মতোই ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ও তাদের যেকোনো সমস্যায় নিকট-প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে প্রস্তুত। নইলে শেখ হাসিনাকে চাপের মধ্যে রেখে বা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি আদায় করে কোনো লাভ হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে বাংলাদেশের এক বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে ভারত সম্পর্কে একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ও ভীতি বিরাজ করে। বিএনপি এই জনসংখ্যারই প্রতিনিধিত্বকারী দল। জিন্নাহ থেকে জিয়া পর্যন্ত গোটা উপমহাদেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বহমান হাওয়া বিএনপি তারই প্রতিনিধি। বিএনপি হঠাৎ দায়ে পড়ে সেই হাওয়ার গতি ফেরাতে চাইলে নিজেরাই ধ্বংস হবে, হাওয়ার গতি ফেরাতে পারবে না।
খালেদা জিয়া একটি কারণে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর দুই পুত্রকে মামলা-হামলা মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা। আমার খবর, আমেরিকা, ভারত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে খালেদা জিয়া ধরনা দিচ্ছেন তাঁর পুত্রদের উদ্ধার ও দেশে ফিরিয়ে এনে বিএনপি রাজনীতির হাল ধরানোর জন্য। আমার ধারণা, এ জন্য তিনি ভারতের কাছেও নমনীয় হয়েছেন। তারেক ফিরে এসে বিএনপির হাল না ধরলে বিএনপির অস্তিত্বই বর্তমান নেত্রীর কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে। এটা বিএনপির অনেক নেতা জানেন। এ নিয়ে দলটির ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্বও আছে।
খালেদা জিয়া ভারতকে যত আশ্বাসই দিন, তা পূরণ করতে পারলে দেশের উন্নতি হতো; কিন্তু তাঁর দল টিকবে না। যে রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর বিএনপি দাঁড়িয়ে আছে, সে অবস্থান থেকে সরে এলে বিএনপির ভোটব্যাংকে বিরাট ভাঙন ধরবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগেরও বেগম জিয়ার ভারত সফরে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে তা ঘটবে জনগণের 'প্রটেস্ট ভোটের' কারণে। বিএনপি তার সুলফভোগী হবে মাত্র।
আওয়ামী লীগ যদি এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চায় তাহলে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসার জন্য দিল্লিকে এগিয়ে আসতে আগ্রহী করা প্রয়োজন। এসব অমীমাংসিত বিষয় ঝুলিয়ে রেখে ভারত কেবল খালেদার সঙ্গে সমঝোতা করে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। খালেদা জিয়াও শেখ হাসিনার মতো জনগণের আস্থা হারাবেন। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, ভারতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো এখনো আছে, কিন্তু তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। আমলাতান্ত্রিক ও করপোরেট বিগবিজনেস এখন সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারতের রাজনৈতিক শক্তি চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। কিন্তু দিল্লির বনেদি আমলাতন্ত্র এর বিরুদ্ধে। খালেদা জিয়া ভারত-বিরোধিতা নীতি ত্যাগ করে যদি ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন দাবি আদায়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, তাহলে এই জাতীয় ঐক্যই কেবল ভারতের আমলাতন্ত্রের সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক দাবিগুলো আদায় করতে পারবে। নইলে শেখ হাসিনার মতোই বেগম জিয়া দিল্লির লাড্ডু খেয়ে পস্তাবেন।
ঢাকা, ৫ নভেম্বর, ২০১২, সোমবার
বেগম খালেদা জিয়া দিল্লি সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে একটি অলিখিত শান্তিচুক্তিও করে এসেছেন বলে প্রকাশ। তিনি বলেছেন, 'আমরা আর অতীতের দিকে ফিরে তাকাব না।' অর্থাৎ অতীতের ভারতবিরোধী নীতি আর অনুসরণ করবেন না। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে তৎপরতা চালাতে দেবেন না। চাই কি, ধর্মান্ধ দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রাখবেন না। ভারত বিনিময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নেবে না বলে বিএনপি নেত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে। ভারতের এই নতুন কূটনীতির সূচনা অবশ্য বহু আগেই, অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের সময় শুরু হয়। তিনি খালেদা জিয়াকে বলে গিয়েছিলেন, ভারত কোনো বিশেষ দলের আর বন্ধু হবে না। সে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চায়। ইঙ্গিতটা স্পষ্টভাবেই ছিল আওয়ামী লীগের দিকে। এই দলের সঙ্গে ভারতের যে ট্র্যাডিশনাল বন্ধুত্ব, তা পরিবর্তনের ইঙ্গিতই প্রণব বাবু দিয়েছিলেন। সেই পরিবর্তনেরই স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে খালেদা জিয়ার এবারের দিল্লি সফরের সময়।
অবশ্য দিল্লি এবারও একটু চাণক্যনীতির আশ্রয় নিয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি থেকে সরকারি সব শীর্ষ নেতাই খালেদা জিয়াকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন, কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী সাক্ষাতের সময় করে উঠতে পারেননি। এখানেও ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। ভারত সরকার বিএনপির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে, কিন্তু দল হিসেবে কংগ্রেস এখনো বাড়ায়নি। এটা বোধ হয় আওয়ামী লীগের জন্য সান্ত্বনা পুরস্কার।
বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভারত সফরকে ব্যালান্স করেছেন। দিল্লি যাওয়ার আগে তিনি চীন সফর করে এসেছেন। অর্থাৎ চীনকেও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ভারত সফর চীনের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া নয়। কেবল বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তনে বিএনপিরও একটু বাঁক পরিবর্তন মাত্র। কিন্তু তাতেও আওয়ামী লীগ প্রথমে আশ্বস্ত হতে পারেনি। বেগম জিয়ার ভারত সফর, উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ ও দিল্লিকে তাদের চিরাচরিত ভারতবিরোধী নীতি পরিবর্তনের আশ্বাস দেওয়ায় আওয়ামী লীগ এই ভেবে বিচলিত হয়েছে যে ভারতের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বমূলক অবস্থানের সমভাগ বুঝি বিএনপি নিয়ে নিল! ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তা রাজনৈতিক বিজ্ঞতা ও পরিপক্বতার পরিচায়ক নয়। আমার আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লাওস থেকে ফিরে আসার পর বিএনপি নেত্রীর দিল্লি সফর সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন, তাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন।
খালেদা জিয়া চেম্বারলেনের মতো বলেননি, তাঁর দিল্লি সফর দ্বারা গোটা উপমহাদেশের জন্য আগামী কয়েক বছরের শান্তির নিশ্চয়তা বহন করে এনেছেন। কিন্তু এ কথা সত্য, ভারতে অবস্থানকালে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা যদি বাস্তবে অনুসরণ করেন তাহলে উপমহাদেশে সত্যিই শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল, এই সফরকে উৎসাহিত ও অভিনন্দিত করা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন পানিচুক্তি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী তৎপরতা উচ্ছেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করার ব্যবস্থা ইত্যাদি ব্যাপারে খালেদা জিয়াও একই নীতি অনুসরণের আশ্বাস ভারতকে দিয়েছেন। এটা আওয়ামী লীগের নৈতিক জয়। আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর নেতা ও মন্ত্রী তা বুঝতে পারেননি এবং এই ভেবে নার্ভাস হয়ে পড়েছেন যে ভারতের সঙ্গে তাঁদের সখ্যের 'মনোপলি' বুঝি হাতছাড়া হয়ে গেল এবং আগামী নির্বাচনে বিএনপি হয়তো তার ফায়দা লুটবে। বৃহত্তর দেশপ্রেম দ্বারা প্রভাবিত হলে আওয়ামী লীগ নেতারা এই সফরের ইতিবাচক দিকটাই আগে দেখতেন। সফরের সাফল্য কামনা করতেন। তার বদলে তাঁদের কেউ কেউ সপত্নীসুলভ ঈর্ষার পরিচয় দিয়েছেন।
ভারতের এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে খালেদা জিয়ার ভারত সফর সম্পর্কে আমার আলাপ হচ্ছিল। তিনি যুক্তি দেখালেন, হাসিনা সরকারের হাতকে সবল করার জন্যই ভারত সরকার খালেদার প্রতি সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করেছে। বিএনপি সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দানের নীতি থেকে সরে এলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শান্তিময় ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তাতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় লাভ। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ এই পরিবেশের সুফল ভোগ করবে।
তাঁকে বলেছি, আমি তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। আওয়ামী লীগের প্রতি কংগ্রেস সরকারের নীতি গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার মতো। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল থেকেই দেখে আসছি, বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহলগুলো ছেড়ে দিয়েছে, ভারত দেয়নি। আদালতের রায়ের ধুয়া তুলে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি করেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে এই চুক্তির শর্ত পালন করেনি। বর্তমানেও হাসিনা সরকারের হাত শক্তিশালী করার প্রকৃষ্ট পন্থা ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধের সমস্যা নিরসন, সীমান্তে প্রত্যহ বিএসএফের বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ করার মাধ্যমে। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব বাবু যে অর্থনৈতিক সাহায্যের প্যাকেজ ডিল নিয়ে এসেছিলেন সেটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দ্বারা। ভারত এখন পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়ন করেনি। মমতার ধুয়া তুলে তিস্তা ও টিপাইমুখ সমস্যা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অব্যাহত আছে।
হাসিনা সরকারের আমলে এসব সমস্যার একটা মোটামুটি সমাধান দ্বারা দেশের সেক্যুলারপন্থী ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সরকারের হাত যেমন শক্তিশালী করা যেত, তেমনি বাংলাদেশে যে চিরাচরিত ভারত বিরোধতার হাওয়া বহমান, তা ঘুরে যেত। তিস্তা, টিপাইমুখ, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি অব্যাহত রেখে কেবল হাসিনা সরকারের ওপর তেল-গ্যাস বা ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে চাপ সৃষ্টি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীসুলভ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভারতবিরোধিতা নীতি পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি আদায় করে কোনো লাভ হবে না। সত্যিকার অর্থে ভারতকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তার চাণক্যসুলভ নীতি পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে এ কথা বুঝতে দিতে হবে, ১৯৭১ সালের মতোই ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ও তাদের যেকোনো সমস্যায় নিকট-প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়াতে প্রস্তুত। নইলে শেখ হাসিনাকে চাপের মধ্যে রেখে বা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি আদায় করে কোনো লাভ হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে বাংলাদেশের এক বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে ভারত সম্পর্কে একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ও ভীতি বিরাজ করে। বিএনপি এই জনসংখ্যারই প্রতিনিধিত্বকারী দল। জিন্নাহ থেকে জিয়া পর্যন্ত গোটা উপমহাদেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বহমান হাওয়া বিএনপি তারই প্রতিনিধি। বিএনপি হঠাৎ দায়ে পড়ে সেই হাওয়ার গতি ফেরাতে চাইলে নিজেরাই ধ্বংস হবে, হাওয়ার গতি ফেরাতে পারবে না।
খালেদা জিয়া একটি কারণে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তাঁর দুই পুত্রকে মামলা-হামলা মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে চান। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা। আমার খবর, আমেরিকা, ভারত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে খালেদা জিয়া ধরনা দিচ্ছেন তাঁর পুত্রদের উদ্ধার ও দেশে ফিরিয়ে এনে বিএনপি রাজনীতির হাল ধরানোর জন্য। আমার ধারণা, এ জন্য তিনি ভারতের কাছেও নমনীয় হয়েছেন। তারেক ফিরে এসে বিএনপির হাল না ধরলে বিএনপির অস্তিত্বই বর্তমান নেত্রীর কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে। এটা বিএনপির অনেক নেতা জানেন। এ নিয়ে দলটির ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্বও আছে।
খালেদা জিয়া ভারতকে যত আশ্বাসই দিন, তা পূরণ করতে পারলে দেশের উন্নতি হতো; কিন্তু তাঁর দল টিকবে না। যে রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর বিএনপি দাঁড়িয়ে আছে, সে অবস্থান থেকে সরে এলে বিএনপির ভোটব্যাংকে বিরাট ভাঙন ধরবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগেরও বেগম জিয়ার ভারত সফরে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে তা ঘটবে জনগণের 'প্রটেস্ট ভোটের' কারণে। বিএনপি তার সুলফভোগী হবে মাত্র।
আওয়ামী লীগ যদি এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে চায় তাহলে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসার জন্য দিল্লিকে এগিয়ে আসতে আগ্রহী করা প্রয়োজন। এসব অমীমাংসিত বিষয় ঝুলিয়ে রেখে ভারত কেবল খালেদার সঙ্গে সমঝোতা করে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। খালেদা জিয়াও শেখ হাসিনার মতো জনগণের আস্থা হারাবেন। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, ভারতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো এখনো আছে, কিন্তু তাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। আমলাতান্ত্রিক ও করপোরেট বিগবিজনেস এখন সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারতের রাজনৈতিক শক্তি চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন। কিন্তু দিল্লির বনেদি আমলাতন্ত্র এর বিরুদ্ধে। খালেদা জিয়া ভারত-বিরোধিতা নীতি ত্যাগ করে যদি ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন দাবি আদায়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, তাহলে এই জাতীয় ঐক্যই কেবল ভারতের আমলাতন্ত্রের সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক দাবিগুলো আদায় করতে পারবে। নইলে শেখ হাসিনার মতোই বেগম জিয়া দিল্লির লাড্ডু খেয়ে পস্তাবেন।
ঢাকা, ৫ নভেম্বর, ২০১২, সোমবার
No comments