চারদিক- প্রাণখোলা এক সন্ধ্যা by আকমল হোসেন

সন্ধ্যা হতেই একে একে এসে জমায়েত হতে থাকেন। খুব বড় আয়োজন নয়, আবার মেজাজের দিক থেকে একেবারে ছোটও বলা যাবে না। অন্যদিকে সম্পূর্ণ না হলেও ঘরোয়া আয়োজনই এটি।
শারদীয় দুর্গাপূজা গেছে, গেছে পবিত্র ঈদুল আজহা—তখনো বাতাসে উৎসবের রেশ বইছে (১ নভেম্বর ২০১২)। এ রকম একটা সময়কে আরও কিছুটা আবেগ দিতে, জীবনকে উদ্দীপনা দিতেই এই আয়োজন। স্রেফ একটি গানের আসর। কেউ গাইবেন, কেউ বসে থাকবেন—এটাই হয়তো নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মটা ভাঙতেই, যান্ত্রিক জীবনযাপনের বাইরে এক বেলা নিজেকে খুলে ধরতেই এমন একটি চেষ্টা (যদিও যন্ত্র, অর্থাৎ কড়া আলো ফেলা ক্যামেরার সচল চোখ বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, যান্ত্রিকতা থেকে বের হতে চাইলেও যন্ত্র পিছু ছাড়ে না)।
আসরটা বসেছিল মৌলভীবাজার চক্ষু হাসপাতালের তিনতলার মিলনায়তনে। আর উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছিল কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবেই। উদ্যোগের সূচনা হয়েছিল মৌলভীবাজারের একমাত্র সৃজনশীল বইয়ের দোকান উত্তরা মার্কেটের শিকড় থেকে। সন্ধ্যার পর দিনের সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে যাঁরা এখানে বইয়ের সঙ্গে ভিন্ন রকম কিছু সময় কাটাতে আসেন, তাঁরাই মূলত এর উদ্যোক্তা। আর সেটা উসকে দিয়েছিলেন কবি শহীদ সাগ্নিক, যিনি নিজেও অজ্ঞান নামে বাউল ঘরানার গান লেখেন, সুর দেন। এক সন্ধ্যায় শিকড়ে বসে তাঁর গানের উচ্চারণ থেকেই এ রকম একটি বৈঠকের চিন্তা আসে। আর সেটা লুফে নেন সাবেক পৌর কমিশনার, মৌলভীবাজার চক্ষু হাসপাতালের অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদক আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মুজাহিদ। খোঁজা হলো সেই সব শিল্পীকে, যাঁরা প্রাণমন দিয়ে গান করেন, খ্যাতি বা অন্য কোনো লাভালাভের দিকে যাঁদের এখনো বাণিজ্যিক চোখ তৈরি হয়নি।
সেদিন শুরুতেই আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মুজাহিদ সবাইকে আপ্যায়ন করলেন মৌসুমি ফল জাম্বুরা ও কামরাঙার চাটনি দিয়ে। অনেকেই তৃপ্তির সঙ্গে শুরুটাকে গ্রহণ করলেন। একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতা (যদিও সবাই অংশগ্রহণকারী) চলে এলে সবাই উঠে গেলেন তিনতলার মিলনায়তনে। শহরের কোলাহলের বাইরে নীরব-নির্জন স্থান। অনানুষ্ঠানিকতার কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে, হয়তো সূচনাটাও সে রকম কিছু ভূমিকায় ভারী ছিল (বৃত্তের বাইরে আসতে গিয়ে, যা অনেকের কাছেই মনে হয়েছে বৃত্ত আঁকড়ে থাকাই)। তবে সেটা কথাবার্তায় খুব বেশি দূর এগোয়নি। মূল লক্ষ্যের দিকেই তখন হাওয়া। কেউ যেন বললেন, আর কিছু নয়, আমরা চাই মাঠের গান, মাটির গান।
মূলত এখানে যাঁরা সমবেত, তাঁরা সবাই কমবেশি নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, খ্যাত। যাঁরা শুধু বক্তা, নয় শ্রোতা হন। গান শোনেন, গান নিয়ে গূঢ়তত্ত্বের কথা বলেন। কিন্তু নিজেরা গাইতে পারেন না। নিজেরা নাচতে পারেন না। অথচ প্রাণ আঁকুপাঁকু করে, প্রথাগত, নিয়মতান্ত্রিক যন্ত্রসভ্যতার এই যে অহংকার। তার বাইরে যেতে, কিছুটা সময় কাটাতে। নগরজীবনের পাথুরে যে একরৈখিকতা, তার বাইরে-ভেতরে যে কাঙাল বাউল আইঢাই করে, তাকে একটু মুক্তি দিতে। কিন্তু চাইলেই তো আর তাঁরা সবখানে নিজেকে খুলে ধরতে পারেন না। এ রকম একদল মানুষের জন্যই এই আয়োজন। সেটা জানাতেই এ এম ইয়াহিয়া মুজাহিদ বললেন, ‘এটা কোনো আনুষ্ঠানিক কিছু না। শুধু প্রথাগত সময়ের বাইরে সবাই মিলে একটু সময় কাটানো। যাতে সবাই প্রাণ খুলে অংশ নিতে পারেন। সবখানে, সবকিছুতে নানা কারণে আমরা শামিল হতে পারি না।’
প্রাণখোলা এই আসরে উপস্থিত হয়েছেন প্রাবন্ধিক ও কলেজশিক্ষক মো. আবদুল খালিক, লোক-গবেষক মাহফুজুর রহমান, কলেজশিক্ষক শক্তিপদ পাল, ব্যবসায়ী রত্নেস্বর সিংহ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন, ব্যাংকার সৈয়দ মোশাহিদ আহমদ, রেডিও পল্ল্লিকণ্ঠের কেন্দ্র ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান, কলেজশিক্ষক সৈয়দ মুজিবুর রহমান, শাহ আবদুল অদুদ, নিজাম উদ্দিন, কবি ও সংগঠক শহীদ সাগ্নিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক মো. আবদুল মছব্বির প্রমুখ।
গান শুরু হলো রবীন্দ্র-নজরুলকে দিয়েই। কিছুটা ভারী ভারী বাতাস। সবাই চাইছেন আরও একটু খোলা শ্বাস ফেলতে। আরও একটু ভেসে যেতে। গাইলেন মীর ইউসুফ, আয়াজ মামুদ, মাহফুজুর রহমান, মেহেদী হাসানসহ আরও অনেকে। জল-কাদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা যে কথা ও সুর অন্তরকে নাড়া দেয়, সেই হাসন-লালন, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, জালালুদ্দিন, শাহনুর শাহ—এসব মরমি ও লোককবির গানের মধ্যে শিল্পী-শ্রোতা সবাই মিশে গেলেন। বাদ পড়েনি মাইজভান্ডারি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান। অনেকে গানের সঙ্গে নাচলেন। মধ্যরাত পর্যন্ত বইল প্রাণের হাওয়া।
বিষয়-আশয়ে মোড়ানো প্রথাগত প্রতিটি মানুষের ভেতর যে একেকজন সুরমাতাল মানুষ আছে, সেটা শুধু সময় ও সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসতে পারে, এটা বোঝা যায় এই আসরে। হয়তো এ রকম প্রাণখোলা সময় জীবনের উদ্দীপনা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। নানা চড়াই-উতরাইয়ে হোঁচট খাওয়া সময় আরও সামনে চলার গতি পায়। মাঝেমধ্যেই এমন খোলস ভেঙে স্বতঃস্ফূর্ত সৌন্দর্যে প্রতিটি মানুষেরই বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকলে মানবিক আগুন কিছুটা হলেও জ্বলে ওঠার রসদ পেতে পারে। শুধু আত্মকেন্দ্রের ঘোরেই জগৎ-সংসার নয়, এর বাইরেও একান্ত ব্যক্তিগত, সম্মিলিত এক জীবন আছে, এটা ভাবার মনে হয় দরকার।
আকমল হোসেন
nipupalo@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.