প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রসঙ্গে দুটি কথা by তারেক শামসুর রেহমান
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে। গত ৩০ জুলাই বিবিসি তা প্রচার করে। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান এবং খালেদা জিয়ার তা প্রত্যাখ্যান রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই আহ্বানের পেছনে কতটুকু আন্তরিক ছিলেন?
ওটা কি প্রধানমন্ত্রীর 'কথার কথা' ছিল? যদি প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হতেন, তাহলে তিনি তাঁর প্রস্তাবের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখাও দিতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী তা দেননি। ফলে প্রশ্ন উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সঠিক। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা সংবিধানে আছে। বলা আছে, সরকারের শেষ তিন মাস হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর প্রধানমন্ত্রী সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সরকারের নেতৃত্ব দেবেন (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার), যেখানে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব (?) থাকবে, সেই সরকার কি নিরপেক্ষ হবে? প্রশাসনের প্রভাব কি তখন উপেক্ষা করা যাবে? যেখানে এমপিরা ক্ষমতায় থাকবেন এবং তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থীও হবেন, তাঁরা কি স্থানীয় প্রশাসনে প্রভাব খাটাবেন না? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন স্থানীয় পর্যায়ের যে প্রশাসন, তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। স্থানীয় প্রশাসন বাহ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাবে পরিচালিত হয়। ফলে এই 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন'-এর ফর্মুলা কাজ করবে না। তবে এই ফর্মুলা কাজ করতে পারে, যদি যৌথ নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালিত হয়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এই যৌথ প্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন। এ ক্ষেত্রে দুটি দলের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে (পাঁচজন করে) একটি ছোট্ট মন্ত্রিসভা হতে পারে, যাঁরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো দুই দলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে। এই ফর্মুলা তখন কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সাক্ষাৎকারে এই প্রস্তাবটি দিলেন কেন? প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য পরিষ্কার- বিদেশি জনমতকে বোঝানো যে তাঁর সরকার বিরোধী দলকে নিয়েই কাজ করতে চায়। বিরোধী দল সরকারে আসুক, সেটাও তিনি চান। বিবিসি জনপ্রিয় মাধ্যম। বিবিসিতে প্রচারিত বক্তব্য খোদ ব্রিটেনে সরকারের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী সংবিধান ও গণতন্ত্রে উত্তরণের কথা বলেছেন। সংবিধান তাঁর পক্ষে। আর গণতন্ত্রে একটি নির্বাচিত সরকারের শেষ সময়েই ওই সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে- এটা প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রী একদিকে সত্য বলেছেন, অন্যদিকে বাস্তবতা এড়িয়ে গেছেন। বাস্তবতা বলে, বাংলাদেশের বিরাজমান গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য কোনো দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। তবে জাতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে রাষ্ট্র যে সংবিধানবিরোধী কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার দৃষ্টান্ত তো আমাদের কাছে আছে। ২০০৮ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ে সরকার এবং বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। ২০০৮ সালে কেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী রাইলা ওডিঙ্গা বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছিল না। একপর্যায়ে ডেসমন্ড টিটুর (দক্ষিণ আফ্রিকার ধর্মীয় নেতা) মধ্যস্থতায় প্রেসিডেন্ট সোয়াই ফিবাকি ওডিঙ্গাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। যদিও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে জিম্বাবুয়েতে। সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী নেতা সাভাঙ্গিরাই বিজয়ী হলেও প্রেসিডেন্ট মুগাবে (১৯৮০ সাল থেকে ক্ষমতায়) ক্ষমতা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। পরে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকির উদ্যোগে একটি সমঝোতা হয় এবং সাভাঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এখানেও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। সংবিধান নিঃসন্দেহে একটা ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সংবিধানে সরকারের শেষ তিন মাসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে উল্লেখ করা আছে। এটাই বিবেচ্য। তাই বলে চূড়ান্ত নয়। পরিবর্তন যে করা যাবে না, তা নয়। প্রয়োজন আন্তরিকতার। চতুর্থত, সরকারপ্রধান যখন বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাসে অগি্নসংযোগের ঘটনায় 'অভিযুক্ত' বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৪৬ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গত ৩১ জুলাই দ্রুত বিচার আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। বিচারকাজ শুরু হবে ৭ আগস্ট। বিএনপির শীর্ষ নেতারা যখন অভিযুক্ত, তখন বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনা কি পরস্পরবিরোধী নয়? এখন বিএনপি যদি সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সরকার কী জবাব দেবে? বাজারে গুজব- একটি বিশেষ মহল বিএনপিকে ভাঙার (?) চেষ্টা করছে। গুজবের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। তবে নাজমুল হুদার দলত্যাগ, একটি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ (সাবেক স্পিকার রাজ্জাক আলীর উদ্যোগে) ইত্যাদি প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। পঞ্চমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সমঝোতায় যাওয়া। আর এটাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে বিএনপিরও কিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল', সর্বজনগ্রাহ্য একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি সরকার, সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে সরকার, স্পিকারের নেতৃত্বে সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি সরকার- ইত্যাদি ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর আলোচনার মধ্য দিয়েই একটি পথ বের হয়ে আসবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দেন, সেই সরকার গ্রহণযোগ্য হবে না। ইতিহাস থেকে আমরা কি কিছু শিখেছি? একুশ শতকের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী সর্বত্র পরিবর্তনের ঢেউ বইছে। 'কালার রেভল্যুশন' যেমন মধ্য এশিয়া তথা থাইল্যান্ডের মতো দেশে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল, ঠিক তেমনি 'আরব বসন্ত' গোটা আরব বিশ্বকেই বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝাঁকুনি দিয়েছে, সেখানে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। সেই পরিবর্তন নিয়ে কিংবা গণতন্ত্র বিনির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তির কাছে চূড়ান্ত বিচারে কোনো অশুভ শক্তি টিকে থাকতে পারেনি। এটা বোঝার জন্য আমাদের মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, সুইজারল্যান্ডের দার্শনিক জ্যাকব বুরচার্ড কিংবা ফ্রান্সের দার্শনিক আলেকসিস দি টকিউভিলের রচনা পাঠ করার প্রয়োজন নেই। ২০১১ সালের কায়রোর 'তাহরির স্কয়ারের' বিপ্লবের মর্ম উপলব্ধি করাই যথেষ্ট। আমরা ইতিহাস থেকে পাঠ নেব। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর 'গোলাপ বিপ্লব' জর্জিয়ায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এডওয়ার্ড শেভারনাদজেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। ২০০৫ সালে ইউক্রেনে 'অরেঞ্জ রেভল্যুশন' ইয়ুশচেঙ্কোকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিরঘিজস্তানে 'টিউলিপ রেভল্যুশন'ও সেখানে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল অস্কার আকয়েভকে। আমরা কি 'ভেলভেট রেভল্যুশন'-এর কথা জানি? প্রয়াত ভাসলাভ হাভেল শান্তিপূর্ণভাবে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপব্যাপী। আমি নিজে পশ্চিম ইউরোপে থেকে তখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম এই বিপ্লব। ২০০৮ সালে থাইল্যান্ডের 'লাল শার্ট' রেভল্যুশনের সঙ্গেও এর মিল আছে। মূলত ১৯৮৯ সালের চেকোস্লোভাকিয়ার 'ভেলভেট রেভল্যুশন' আর ২০১১ সালের কায়রোর তাহরির স্কয়ারের রেভল্যুশন- পার্থক্য নেই কোথাও। বাংলাদেশের সঙ্গে মিসর বা কিরঘিজস্তানের পরিস্থিতি মেলানো যাবে না। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, যা ওই সব দেশে ছিল না। তবু কখনো-সখনো সরকার ভুল করে। থাইল্যান্ডে অত্যন্ত জনপ্রিয় থাকসিন সিনাওয়াত্রাও ভুল করেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে পারেনি। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য কালার রেভল্যুশনের ক্ষেত্রেও। শাকাসভিলে (জর্জিয়া), ইয়ুশচেঙ্কো (ইউক্রেন) কিংবা রোজা অতুনভায়েভা (কিরঘিজস্তান) ভুল করেছেন। বিপ্লব তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। জনগণের অধিকার রক্ষিত হয়নি। এখন দেখার পালা মুরসি মিসরের জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সত্য। কিন্তু কোথায় যেন একটা বড় 'কিন্তু' রয়ে গেছে। 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার'-এর মতো হয়ে গেল ব্যাপারটা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনগণের স্বার্থেই সংবিধান পরিবর্তন করেছে- এটা যেমন গণতন্ত্র, তেমনি বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে গণতন্ত্রকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, তার নামও গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এই গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। আমার ধারণা, বিবিসিকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব চূড়ান্ত বিচারে কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সত্য। কিন্তু কোথায় যেন একটা বড় 'কিন্তু' রয়ে গেছে। 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার'-এর মতো হয়ে গেল ব্যাপারটা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনগণের স্বার্থেই সংবিধান পরিবর্তন করেছে- এটা যেমন গণতন্ত্র, তেমনি বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে গণতন্ত্রকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, তার নামও গণতন্ত্র। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এই গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। আমার ধারণা, বিবিসিকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব চূড়ান্ত বিচারে কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
No comments