জাপানে দুর্যোগ এবং আমাদের ভাবনা by নেহাল আদেল

যেসব পরিবেশবাদী কয়লা ও তেল জ্বালানির পরিবর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক চুলি্ল ব্যবহারের দাবি তুলছিলেন, তাঁদের ভাবনায় ধাক্কা দিল জাপানের ভূমিকম্প। পারমাণবিক রি-অ্যাক্টরের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধসে পড়েছে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের কমান্ড।


আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির উত্থান যেমন ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধরত মার্কিন সেনাসহ গোটা ইউরোপীয় ও মধ্যপ্রাচ্য কমান্ডকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, প্রায় একই ব্যবস্থা ঘটছে পূর্ব রণাঙ্গনে। উত্তর কোরিয়া আক্রমণের পাঁয়তারা করছিল দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। ভূমিকম্পের সময় যৌথ মহড়া চলছিল তাদের। সে মহড়ায় ৪০০ জাহাজ ও ৩০০ বিমানকে তাৎক্ষণিকভাবে ভূমিকম্প ও সুনামি জর্জরিত জাপানে ত্রাণকাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। কলকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যাতায়াতব্যবস্থার বিপর্যয়ে। এর মাত্র কয়েক দিন আগে জাপান তার প্রযুক্তির শীর্ষ বুলেট ট্রেন চালু করেছিল।
হয়তো আল-কায়েদা বলবে, এটা সৃষ্টিকর্তার শক্তি। এমন কোনো তত্ত্বে বিশ্বাস করি না। এ বিপর্যয়কে দেখছি গোটা মানবজাতির বিপর্যয় হিসেবে। আমরা প্রযুক্তিতে যতই উন্নত হই না কেন, ক্ষমতায় বাহবা নিতে পারি না। এটাই সুরা ফাতেহায় লেখা আছে। তেমন একটি বিশ্লেষণ দিয়ে বিদ্যার বাহবা নিতে চাই না। দেখছি, আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ করণীয়। আজ উপমহাদেশে পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর তৈরির দৌড় দেখছি। যদিও ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভারত তার কয়লা দিয়ে এ শতাব্দীর প্রয়োজন মেটাতে পারে। মনমোহন সিং বিতর্কিত মার্কিন-ভারত পরমাণু চুক্তি করে তারাও পারমাণবিক চুলি্ল তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পাকিস্তানও পিছিয়ে নেই। তারা চীনের সঙ্গে মিলে পরমাণু চুলি্ল বানাচ্ছে।
আমরাও কি পিছিয়ে আছি? আমরা গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের রূপপুর পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর প্রকল্প চাঙ্গা করার চেষ্টা করছি। এটায় তদানীন্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সরকার হাত দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি চীন সফর করেছিলেন। চীনারা তাঁকে বলেছিল, তারা পরমাণু গবেষণায় যাচ্ছে। পাকিস্তানের বর্তমান পরমাণু প্রকল্প ও তাতে পাক-চীন সহযোগিতার প্রকৃত রূপকার ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যাঁকে আমরা তাঁর দূরদৃষ্টি বলতে পারি। তবুও পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সামরিক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে দেশদ্রোহী বলে পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে। আমরা রূপপুরকে পেছনে ফেলে এসেছি। তাহলে পাকিস্তানের পারমাণবিক রি-অ্যাক্টর কাহুতায় না হয়ে রূপপুরে হতো। আমরা কি ভুল করেছি?
আজকের বিশ্বের পারমাণবিক বিপর্যয় হয়তো বলবে_পারমাণবিক চুলি্ল ও পারমাণবিক অস্ত্র না তৈরি করে আমরা ভুল করিনি। আমাদের পাল্লা দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্প্রতি একটি পারমাণবিক চুলি্ল তৈরির চুক্তি করেছে। আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে এটাকে সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের পারমাণবিক নিরাপত্তার দিকেও জোর দিতে হবে। ইউক্রেনের চেরনোবিলে যখন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে, তখন মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ইতিহাস তাঁকে মানব-ইতিহাসের অযোগ্যতম নেতা হিসেবে শনাক্ত করেছে। অনেক গবেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে এ দুর্ঘটনা ঘটায়। তদানীন্তন সিআইএ প্রধান ও বর্তমান মার্কিন দেশরক্ষামন্ত্রী দিকনির্দেশ করেন। তিনি এটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার চক্রান্তের অংশ মনে করেন। এমন একটি কল্পতরু নির্মাণ করতে চাই না; কিন্তু দুর্ঘটনাকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে বক্তৃতা করছিলেন। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে সর্বাধুনিক, তবে তিনি কেন এমন একটি ভূমিকম্প ও সুনামির পূর্বাভাস পাননি। কেন তাঁরা পারমাণবিক চুলি্লগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেননি।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার পাঁচ বছর আগে সোভিয়েত জেনারেল ওরগিকভ কম্পিউটার ভাইরাস আক্রমণের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শত্রু একটি অত্যাধুনিক রণকৌশল ব্যবহার করবে, যা যুদ্ধরেখার ভেতর থেকে কাজ করবে। গর্বাচেভ তাতে কান দেননি। তিনি হয়তো ক্ষমতাদর্পী ছিলেন অথবা সম্পূর্ণ নির্বোধ ছিলেন। জাপানি প্রধানমন্ত্রী আজ দুর্নীতির স্ক্যান্ডালে জড়িত। ঘুষ নেওয়ার দায়ে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তিনি নিজেও বেআইনি তহবিল নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। ইঙ্গ-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তির হোতা মনমোহন সিংহ টেলিকম দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছেন। এশিয়ার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। আমরা জানি না, জাপানের চুলি্ল বিস্ফোরণের প্রতিফল চেরনোবিলের চেয়েও ভয়াবহ হবে কি-না। কিন্তু এখন বলতে হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে আমাদের ভেবেচিন্তে এগোতে হবে।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী নৃতাত্তি্বক

No comments

Powered by Blogger.