সদরে অন্দরে-কোন ষড়যন্ত্রের শিকার গার্মেন্ট শিল্প by মোস্তফা হোসেইন

আবারও শ্রমিক অসন্তোষ। আশুলিয়া উত্তপ্ত। গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস ইত্যাকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল সেখানে। তৎপরতা বেড়ে গেল তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের। মন্ত্রী-সচিবও এগিয়ে এলেন। সবশেষে মাইকিং করা হলো, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন। কথা বলবেন তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিকদের সঙ্গেও।
সর্বোচ্চ মহলের আশ্বাসের কথা শোনার পর শ্রমিকরা রণে বিরতি দিলেন। কিন্তু পরদিন আবার সেই একই অবস্থা। শুক্রবার পত্রিকায় সংবাদ হলো, সহিংসতা বন্ধ না হলে সোমবার থেকে আশুলিয়ার কারখানাগুলো বন্ধ করে দেবে মালিক পক্ষ। বোঝা যাচ্ছে না, পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় দেবে। বোঝা যাচ্ছে না, এত ঘন ঘন শ্রমিক অসন্তোষেরই বা কারণ কী?
শুধুই কি বেতনের কারণে এই অসন্তোষ? শ্রমমন্ত্রী বললেন, ষড়যন্ত্র আছে এর পেছনে। এখানেই বড় প্রশ্ন। হা-মীম গ্রুপের কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিক মারা গেলেন বছর দুয়েক আগে। বলা হলো দেখতে হবে, পেছনে ষড়যন্ত্র আছে কি না। একই কারখানায় আবার অসন্তোষ দেখা দিল মাস কয়েক আগে। এবার দেখা গেল, চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা। শ্রমিক অসন্তোষ উসকে দেওয়া হলো, শ্রমিককে মেরে ফেলা হয়েছে গুজব তুলে। কী আশ্চর্যজনক ঘটনা! যে শ্রমিককে গুম করে হত্যা করা হয়েছে বলে ওরা আন্দোলনে নামল, সেই শ্রমিককে প্রকাশ্যে হাজির করার পরও তারা থামল না সহজে। তখনো আমরা শুনলাম, নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের আওয়াজ শোনা গেল শিল্প মালিকদের কণ্ঠে, শোনা গেল সরকারের মুখ থেকেও। মঙ্গলবার থেকে যখন আবার অসন্তোষ তৈরি হলো তখনো আমাদের শুনতে হলো নিশ্চয়ই এটা কোনো ষড়যন্ত্রের পরিণতি।
প্রতিটি ঘটনার পরই বলা হচ্ছে, ষড়যন্ত্র আছে ঘটনার অন্তরালে। তার পরও এত দিন পর্যন্ত ষড়যন্ত্র-রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হলো না কেন? এর জবাব আমরা পাইনি। পাইনি বলেই প্রশ্নটা জোরালোভাবেই এসে যায়, তাহলে কি সরকার তৈরি পোশাক শিল্প খাতে যথাযথ নজর দিতে পারছে না? যাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা তারাই 'হয়তোবা' 'থাকতে পারে' জাতীয় অনুমাননির্ভর বক্তব্য দিয়ে চলেছেন।
অন্যদিকে ষড়যন্ত্র হওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। কারণ এ খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রতিযোগী দেশগুলোর গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। ব্যবসায় এটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অসম্ভব কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিল্প মালিক এবং সরকারের ভূমিকা কী? তৈরি পোশাক শিল্পের বড় আমদানিকারক দেশটি হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি কমিয়ে দিল কেন? শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের মৃত্যুর পর আমাদের দেশের মানুষ জানলও না। বাইরের দুনিয়ায় রীতিমতো আলোচ্য বিষয় হয়ে গেল বাংলাদেশের একজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বললেন, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি হ্রাস পেতে পারে। তাদের দেশ, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ক্রয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। প্রাসঙ্গিকভাবেই তিনি বললেন, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে তেমন আলোচনায় না এলেও ওইসব দেশে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বললেন, শ্রমিক অসন্তোষের কথাও।
কোনো শ্রমিকের এমন মৃত্যু অবশ্যই মেনে নেওয়া যায় না। আবার শ্রমিক অসন্তোষ ঘটার কারণগুলোকেও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বেতন নিয়মিত না পাওয়ার ঘটনা কমে গেছে আগের তুলনায়। বছর দুই-তিনেক আগেও যেভাবে পোশাক শিল্প মালিকদের অনেকেই শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে কারখানা চালানো সম্ভব বলে মনে করতেন, এখন অবস্থা সে রকম নয়, কিন্তু বর্ধিত বেতনের বিষয়টি শ্রমিকদের দাবি থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে চাহিদা আছে তা পূরণের বিষয়টি বিবেচ্য। কারণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শ্রমিক তখনই শ্রম দিতে পারে, যখন তাঁর বেঁচে থাকার মতো অবস্থা নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা কী সেই সুযোগটি পাচ্ছে? ২০১০ সালে অনেক দেন-দরবার করে শ্রমিকের নূ্যনতম মজুরি করা হয়েছিল তিন হাজার টাকা। দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া অবস্থায় একজন মানুষ মাসে তিন হাজার টাকায় চলতে পারে কি? প্রশ্ন, সংগত কারণেই আসতে পারে। দৈনিক ১০০ টাকা মজুরিতে এখনো বাংলাদেশে শ্রমিক কাজ করছেন, এটা ভাবতেও অবাক লাগে। আজও কৃষি শ্রমিক কিংবা সাধারণ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের নূ্যনতম দৈনিক মজুরি যেখানে ৪০০ টাকার বেশি, সেখানে গার্মেন্টকর্মী কিভাবে দৈনিক ১০০ টাকা দিয়ে জীবন ধারণ করতে পারেন? প্রশ্নগুলো যখনই মালিক পক্ষের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখনই তারা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার কথা বলে। বলে, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বৃহৎ এই খাতটিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু শ্রমিকের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে তাদের বঞ্চিত করার এ প্রবণতা নিয়ে তাদের মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। যখনই শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনার ব্যাপারে দাবি করেন, তখনই বলতে শোনা যায়, কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা এও মনে করিয়ে দেন, তাহলে দেশের ৩৫ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। এই ৩৫ লাখের কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি তাই জিম্মির মতো ভূমিকা পালন করে। এই ৩৫ লাখ শ্রমিকের শ্রম দিয়েই যে তাঁরা পুঁজি সম্প্রসারণ করছেন সে কথা দিব্যি ভুলে যান।
ভিয়েতনাম, চীন, ভারত যদি অধিক মজুরি দিয়ে ব্যবসা টিকে থাকতে পারে, তারা যদি ইউরোপ-আমেরিকায় নিজেদের বাজার ধরে রাখতে পারে তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা অসম্ভব কেন? ওইসব দেশ যদি বেশি পারিশ্রমিক প্রদান করে বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে পারে তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
বাংলাদেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। সরকার ব্যাপক সহযোগিতা প্রদান করে আসছে এর বিকাশের লক্ষ্যে। যে দেশে জাতীয় বাজেট হয় দুই লাখ কোটি টাকারও কম, সেই দেশে ছয় বছরেই শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। সোয়া লাখ কোটি টাকার শুল্কের মালিক এ দেশের সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের এ অর্থ শিল্পের বিকাশে কাজে লাগবে- এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকের পাওনাদিও ধর্তব্য। কিন্তু সেই সুযোগ কি পোশাক শিল্প মালিকরা দিচ্ছেন? শ্রমিকরা তো ব্যবসায় শেয়ার চান না। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য চাহিদা তাঁদের। কেন পূরণ হবে না এটি? সরকার সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে লাখ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারত। প্রাসঙ্গিক বিষয় বিশ্লেষণ করে তাই আজকে উপসংহারে পৌঁছানোর সময় এসেছে। এ শুল্ক সুবিধার মাধ্যমে দেশের চেয়ে কিছু উদ্যোক্তার সুবিধাকেই নিশ্চিত করা হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের এই অস্থিতিশীলতা সহজেই কেটে যাবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। যত দিন শিল্প মালিকদের একতরফাভাবে সুবিধা প্রাপ্তির দিকটিই তাদের কাছে বড় বলে মনে হতে থাকবে, তত দিন শিল্পে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র বলে যে চিৎকার করা হচ্ছে, তাও যদি সরকার এবং মালিক পক্ষ তলিয়ে না দেখে তাহলেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকবে। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নিশ্চয়ই মাসিক পাঁচ-সাত হাজার টাকা যথেষ্ট নয়। কিভাবে সেসব অভাগা শ্রমিকদের শ্রমবিক্রির পথ সুগম হবে সেদিকে নজর দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.