সময়চিত্র-আসুন, সরকারের প্রশংসা করি by আসিফ নজরুল
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কথা চমৎকার। তিনি বলেছেন, সরকারের সমালোচনা করলে অসুবিধা নেই, তবে সরকারের ৯০ শতাংশ সমালোচনা করলে ১০ শতাংশ প্রশংসা অন্তত করা উচিত। এ ধরনের উদারতা নিকট অতীতে কোনো মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদ দেখিয়েছেন বলে মনে হয় না। মন্ত্রী-উপদেষ্টারা চান শতভাগ আনুগত্য, অকুণ্ঠ প্রশংসা।
তাঁরা প্রাণ খুলে নিজেদের সরকারের প্রশংসা করেন, অন্যদের থেকেও প্রাণখোলা প্রশংসা চান। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বক্তব্য তাই অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি মাত্র ১০ শতাংশ প্রশংসা চেয়েছেন। আমার মতে, সরকারের এতটুকু প্রশংসা সব ক্ষেত্রে করা সম্ভব।
১০ শতাংশ মেপে দেখা সম্ভব নয়। নয় লাইন সমালোচনা করে এক লাইন প্রশংসা করলে তা অঙ্কের হিসেবে সহি হবে। কিন্তু তা অনেকের মনঃপূত হবে না। তার চেয়ে প্রতিটি নিন্দনীয় কাজের গভীরে কোনো প্রশংসনীয় দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা শ্রেয়তর। এই চেষ্টা করা সম্ভব, সব ‘কুকর্মে’র মধ্যেও প্রশংসা করার মতো কিছু বিষয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
যেমন কিছুদিন আগে যুবলীগের নেতা ইব্রাহিম হত্যার মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই মামলা যত দিন পুলিশের কাছে ছিল, আমরা মুগ্ধ হয়ে ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য শুনতাম। তিনি মন্ত্রীর কথায় চলেন না, চাকরির ভয় করেন না, আল্লাহকে হাজের-নাজের রেখে কথা বলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এমন নন-সেক্যুলার কথাবার্তা, দলীরকরণের যুগে এমন লৌহকঠিন ব্যক্তিত্ব সরকার সহ্য করে চলেছে, এটাও তো অনেক! আল্লাহ ওনাকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছেন, তিনি তদন্তের আগেই বুঝে ফেলেছিলেন ইব্রাহিমের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা মাত্র, পরে বুঝেছেন, হত্যাকাণ্ড হলেও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী শাওন এর সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নন। তাঁর কথা শুনে অনেকে রাগ করেছেন। কিন্তু এটিও তো সত্যি, এমন দরবেশ পুলিশ কর্মকর্তা থাকলেই না ‘নির্দোষ’ ব্যক্তিরা রেহাই পেয়ে যাবেন!
১০ শতাংশ প্রশংসার কথা আসলে এটি নয়। আসল প্রশংসা নিহিত এর তদন্তের মধ্যে। তদন্ত চলছে অনেক দিন, কিন্তু শাওন এখনো গ্রেপ্তার হননি। তিনি যদি কোনো দিন গ্রেপ্তার না হন, কিংবা এই মামলায় কেউ যদি শাস্তি না পায়, এমনকি যদি প্রেসিডেন্টের অপার কৃপায় মাফ পায়, তার পরও এর মধ্যে প্রশংসনীয় দিক আছে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকার বিএনপিকে দায়ী করেনি, এমনকি জামায়াত বা জঙ্গিদেরও নয়। আমাদের মতো নিন্দুক মানুষের বোঝা উচিত, এটিও অনেক বড় উদারতা, সরকার অন্তত ১০ শতাংশ প্রশংসা পেতেই পারে এতে।
আমি জানি, এসব কথা বিএনপির লোকদের পছন্দ হবে না। তারা শতভাগ নিন্দায় বিশ্বাসী দল। নিজেদের আমলে অত্যাচার-অনাচার কম করেনি তারা। অথচ সরকার যখন একই কাজ করে নির্দয় নিন্দায় মেতে ওঠে তারা। দলীয়করণ তারা করেছে, দুর্নীতি-অনিয়ম-সন্ত্রাসের তাণ্ডব তারা চালিয়েছে, মানুষকে খাদ্যহীন-আলোহীন-আশাহীনও তারা করেছে। অথচ এসব কাজ এই সরকার করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তারা। বিএনপির বোঝা উচিত, দিনবদলের কথা বললেও সরকার আসলে তাদেরই অনুসরণ করছে। শুধু এ কারণে হলেও অন্তত ১০ শতাংশ প্রশংসা তাদেরও করা উচিত।
কাজেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বক্তব্য সঠিক। অন্তত কিছু প্রশংসা সরকারের করা উচিত সবার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সর্বত্র সরকারের প্রশংসার জয়গান কিছুটা হলেও ওঠা উচিত।
২.
পাবনার ঘটনা নিয়ে বিরাট শোরগোল হলো দেশে। নিয়োগের বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ অপদস্থ করল সরকারের কর্মকর্তাদের। অথচ কর্মকর্তাদের কাণ্ডজ্ঞান থাকলে এটি ঘটার কথা নয়। তাঁরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো সঠিক সময়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিংবা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে মিডিয়াকে বলতে পারতেন, কই, মারেনি তো কেউ! তা না করে সাংবাদিক ঢেকে কান্নাকাটি! কার সহ্য হয় এসব?
একজন উপদেষ্টা নিজে পাবনা গিয়ে বললেন, এসব ঠিক হয়নি আর কান্নাকাটিও আসলে ঘটেনি। এরপর সাধারণ সৌজন্যবোধ থাকলে সরকারি কর্মকর্তারা বলতে পারতেন, কান্নার ছবিটি আসলে কান্নার না, কিংবা এটি মিডিয়ার কারসাজি! এটুকু বললেও হতো আসলে। দেড় যুগ আগে মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় আওয়ামী লীগের এমপির হাতে অস্ত্রের ছবি কারচুপি করে সাজানো, একজন সর্বজ্ঞানী কলামিস্ট এ রকম অভিমত দিয়েছিলেন। এই অসাধারণ আবিষ্কার বিফলে যায়নি। এত বছর পর বর্তমান সরকার সেই হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে অনেককে অব্যাহতি দিয়েছে। পাবনার সরকারি কর্মকর্তারা মিডিয়ার ওপর একহাত নিয়ে আজ বা আগামীকাল শাসকদলের সোনার ছেলেদের রক্ষা করার এমন একটি সুযোগ তৈরি করতে পারতেন। এই বুদ্ধি বা দেশপ্রেম তাঁদের নেই কেন? জেলহাজত থেকে সোনার ছেলেরা বের হয়ে এলে এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো তাঁদের। সরকার এ জন্যই তাঁদের পাবনা থেকে বদলি করেছে, মানসিক ধকল কাটানোর জন্য কাউকে কাউকে ওএসডি করেছে! কিন্তু তাঁদের তো অন্তত চাকরিচ্যুত করা হয়নি! এ জন্য হলেও সরকার কিছু প্রশংসা পেতে পারে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই কথাগুলো দেশের কেউ বুঝল না!
শুধু পাবনা নয়, নিয়োগ-পরীক্ষা নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডের অভিযোগ উঠছে সারা দেশে। অথচ এখানেও প্রশংসা করার কিছু বিষয় আছে। নিয়োগ যারা পাচ্ছে তারা আওয়ামী লীগের লোক হতে পারে, কিন্তু তারা তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। শুধু যদি তাদের চাকরি হয়, তাহলেও তো দেশের বেকার সমস্যা খানিকটা দূর হয়। তাদের চাকরি পাইয়ে দিয়ে যদি কারও পকেট ভারী হয়, তাতেও লাভ আছে। এতে চাকরিপ্রাপ্ত আর চাকরিপ্রদাতা দুই পক্ষের আর্থিক সংস্থান হয়। দুর্নীতি না হলে লাভ হয় শুধু প্রথম পক্ষের। বেকার সমস্যায় জর্জরিত দেশে নিয়োগ-বাণিজ্যেই তো উত্তম!
সমালোচকেরা হয়তো বলবেন, প্রশাসনে মেধাবীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে এতে, যোগ্যদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, তাদের সমান সুযোগের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এগুলো ঠিক, কিন্তু সে জন্যও শতভাগ সমালোচনার যুক্তি নেই। মেধাবীদের বুঝতে হবে, এ দেশে প্রকৃত মেধার পরিচয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগে যুক্ত থাকার মধ্যে। কিংবা তাদের খুশি করার মধ্যে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ঠিক উল্টো কাজ করার মধ্যে। বর্তমান সরকার যে আরও খোলাখুলি করে দিয়েছে বিষয়টি, এটি সরকারের স্বচ্ছতার প্রমাণ। আর স্বচ্ছতা মানেই সুশাসন, তাই না?
৩.
ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনোখুনি নিয়ে সবচেয়ে সমালোচনা হচ্ছে সরকারের। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বারবার তাঁর ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। এতেও লাভ হয়নি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, তাঁর ক্ষোভ আন্তরিক। আমাদের মনে আছে, তিনিই প্রথম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রকৃত ছাত্রদের নেতৃত্বের সুযোগ দিয়েছেন, তাঁদের বয়সসীমা নির্দিষ্ট করেছেন, তাঁদের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন। তাঁর আন্তরিকতার সবচেয়ে বড় অপমান করেছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীরা। সারা দেশে যেভাবে তাঁরা সন্ত্রাসে মেতে উঠছেন, যে নৃশংসতা দেখাচ্ছেন তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত করবে।
একটু নিষ্ঠুরতা হয়ে যায়, তবু বলি, এর মধ্যেও কিছুটা প্রশংসার বিষয় রয়েছে। যেমন খুনের ঘটনার পর কিছু নেতাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি অভিযুক্তদের চূড়ান্ত বহিষ্কার করতে না পারে, আদালত যদি তাঁদের জামিন দিয়ে দেয়, তাহলে সরকার কী করবে? হ্যাঁ, দেশে যদি আওয়ামী পুলিশ লীগ, প্রশাসন লীগ কিংবা বিচারক লীগ থাকত তাহলে আমরা পুরোপুরি দোষ সরকারকে দিতে পারতাম। এই দর্শনের কথাই সরকারি দলের যুগ্ম মহাসচিব বাকশালের আদর্শে বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমরা যদি তা না বুঝি তাহলে সরকারের কী দোষ!
আসল প্রশংসার কাজ করছে ছাত্রলীগ নিজে। একজন মন্ত্রী তাদের বুদ্ধি দিয়েছিলেন নিজেরা মারামরি না করে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর চড়াও হতে। ছাত্রলীগ তার কথা শোনেনি। এরপর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেখানেও তারা নিজেরাই মারামারি করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। ছাত্রদল বা শিবির আক্রান্ত হয়েছে কালেভদ্রে। বিরোধী দলের প্রতি এই অপূর্ব সহনশীলতার নজির আছে আর দেশে?
চাইলে প্রশংসা করার মতো বিষয় সব কাজেই পাওয়া যাবে। সরকার বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির আইন করেছে তো অসুবিধা কী? কোন দিন কোন আদালতে মন্ত্রী-আমলাদের শাস্তির ঘটনা ঘটেছে? মাঝখান দিয়ে শুধু শুধু আদালতে মামলার জট বেড়েছে, টাকাপয়সার অপচয় হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেন বিশ্বাসীরা আশাবাদী হয়েছে। একবারে আইন করে দায়মুক্তি দিয়ে দিলে বরং এসব ঝামেলা বিদায় হয়। দায়মুক্তি আইনের প্রশংসা করা উচিত তাই। সরকার যে বিভিন্ন কৌশলে বিএনপিকে সংসদ থেকে বাইরে রেখেছে বলে কোনো কোনো নিন্দুক অভিযোগ করেন, তার মধ্যেও প্রশংসা করার বিষয় রয়েছে। বিরোধী দল সংসদে থাকলে সরকারি দলের কারও কারও মাথায় রক্ত চড়ে যায়, সংসদে গালাগালি-কটূক্তি তাই চরমে ওঠে। তার চেয়ে তারা সংসদে না থাকলেই ভালো। একপক্ষীয় কটূক্তি হয়, কিন্তু তা বহুক্ষণ স্থায়ী হয় না। সাংসদেরা প্রাণভরে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন অবদানের কথা বলতে পারেন। এসব ভালো কথা শুনে লোকের দুঃখ নিশ্চয়ই ঘোচে কিছুটা। এ জন্য সম্ভবত সরকার চাইছে, বিটিভির সংবাদ একটু প্রচারিত হোক বেসরকারি টিভিতে। জিনিসের দাম বাড়ুক, লোডশেডিং বাড়ুক, খুন-ছিনতাই চলুক। তাই বলে ভালো কথা শোনার আনন্দ থেকে কেন বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ!
এমন জনদরদি সরকারের কিছু প্রশংসা করাই উচিত আমাদের।
৪.
সমস্যা হচ্ছে, এই সাধারণ বিষয়টি জ্ঞানী মানুষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশে অতি বরেণ্য একজন মানুষ। তিনি সবার অভিভাবকতুল্য, প্রখর প্রজ্ঞাবান। অথচ তিনিই কী ভয়ংকর কথা বলে বসলেন। তিনি কেমন করে বলেন দেশ এখন বাজিকরদের হাতে? কেমন করে লিখেন ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি এত ধরনের বাজির রকমফের দেখে দেশের মানুষ দিশেহারা?
তার কথা শুনে মনে হয়, দেশে যেন আগে হয়নি এসব! রাজাকার আর তার বন্ধুদের সরকারও এসব করেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের লোকজন এসব করছে। চেতনার এতে যতই বারোটা বাজুক, চেতনাধারীরা তো লাভবান হচ্ছেন। ১০ শতাংশ প্রশংসা এখানেও তো সরকারের প্রাপ্য!
কাজেই আসুন, সবাই মিলে সরকারের প্রশংসা করি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং সরকারের সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১০ শতাংশ মেপে দেখা সম্ভব নয়। নয় লাইন সমালোচনা করে এক লাইন প্রশংসা করলে তা অঙ্কের হিসেবে সহি হবে। কিন্তু তা অনেকের মনঃপূত হবে না। তার চেয়ে প্রতিটি নিন্দনীয় কাজের গভীরে কোনো প্রশংসনীয় দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা শ্রেয়তর। এই চেষ্টা করা সম্ভব, সব ‘কুকর্মে’র মধ্যেও প্রশংসা করার মতো কিছু বিষয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
যেমন কিছুদিন আগে যুবলীগের নেতা ইব্রাহিম হত্যার মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই মামলা যত দিন পুলিশের কাছে ছিল, আমরা মুগ্ধ হয়ে ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য শুনতাম। তিনি মন্ত্রীর কথায় চলেন না, চাকরির ভয় করেন না, আল্লাহকে হাজের-নাজের রেখে কথা বলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এমন নন-সেক্যুলার কথাবার্তা, দলীরকরণের যুগে এমন লৌহকঠিন ব্যক্তিত্ব সরকার সহ্য করে চলেছে, এটাও তো অনেক! আল্লাহ ওনাকে দিব্যদৃষ্টি দিয়েছেন, তিনি তদন্তের আগেই বুঝে ফেলেছিলেন ইব্রাহিমের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা মাত্র, পরে বুঝেছেন, হত্যাকাণ্ড হলেও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী শাওন এর সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নন। তাঁর কথা শুনে অনেকে রাগ করেছেন। কিন্তু এটিও তো সত্যি, এমন দরবেশ পুলিশ কর্মকর্তা থাকলেই না ‘নির্দোষ’ ব্যক্তিরা রেহাই পেয়ে যাবেন!
১০ শতাংশ প্রশংসার কথা আসলে এটি নয়। আসল প্রশংসা নিহিত এর তদন্তের মধ্যে। তদন্ত চলছে অনেক দিন, কিন্তু শাওন এখনো গ্রেপ্তার হননি। তিনি যদি কোনো দিন গ্রেপ্তার না হন, কিংবা এই মামলায় কেউ যদি শাস্তি না পায়, এমনকি যদি প্রেসিডেন্টের অপার কৃপায় মাফ পায়, তার পরও এর মধ্যে প্রশংসনীয় দিক আছে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরকার বিএনপিকে দায়ী করেনি, এমনকি জামায়াত বা জঙ্গিদেরও নয়। আমাদের মতো নিন্দুক মানুষের বোঝা উচিত, এটিও অনেক বড় উদারতা, সরকার অন্তত ১০ শতাংশ প্রশংসা পেতেই পারে এতে।
আমি জানি, এসব কথা বিএনপির লোকদের পছন্দ হবে না। তারা শতভাগ নিন্দায় বিশ্বাসী দল। নিজেদের আমলে অত্যাচার-অনাচার কম করেনি তারা। অথচ সরকার যখন একই কাজ করে নির্দয় নিন্দায় মেতে ওঠে তারা। দলীয়করণ তারা করেছে, দুর্নীতি-অনিয়ম-সন্ত্রাসের তাণ্ডব তারা চালিয়েছে, মানুষকে খাদ্যহীন-আলোহীন-আশাহীনও তারা করেছে। অথচ এসব কাজ এই সরকার করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে তারা। বিএনপির বোঝা উচিত, দিনবদলের কথা বললেও সরকার আসলে তাদেরই অনুসরণ করছে। শুধু এ কারণে হলেও অন্তত ১০ শতাংশ প্রশংসা তাদেরও করা উচিত।
কাজেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বক্তব্য সঠিক। অন্তত কিছু প্রশংসা সরকারের করা উচিত সবার। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সর্বত্র সরকারের প্রশংসার জয়গান কিছুটা হলেও ওঠা উচিত।
২.
পাবনার ঘটনা নিয়ে বিরাট শোরগোল হলো দেশে। নিয়োগের বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ অপদস্থ করল সরকারের কর্মকর্তাদের। অথচ কর্মকর্তাদের কাণ্ডজ্ঞান থাকলে এটি ঘটার কথা নয়। তাঁরা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো সঠিক সময়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিংবা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে মিডিয়াকে বলতে পারতেন, কই, মারেনি তো কেউ! তা না করে সাংবাদিক ঢেকে কান্নাকাটি! কার সহ্য হয় এসব?
একজন উপদেষ্টা নিজে পাবনা গিয়ে বললেন, এসব ঠিক হয়নি আর কান্নাকাটিও আসলে ঘটেনি। এরপর সাধারণ সৌজন্যবোধ থাকলে সরকারি কর্মকর্তারা বলতে পারতেন, কান্নার ছবিটি আসলে কান্নার না, কিংবা এটি মিডিয়ার কারসাজি! এটুকু বললেও হতো আসলে। দেড় যুগ আগে মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় আওয়ামী লীগের এমপির হাতে অস্ত্রের ছবি কারচুপি করে সাজানো, একজন সর্বজ্ঞানী কলামিস্ট এ রকম অভিমত দিয়েছিলেন। এই অসাধারণ আবিষ্কার বিফলে যায়নি। এত বছর পর বর্তমান সরকার সেই হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে অনেককে অব্যাহতি দিয়েছে। পাবনার সরকারি কর্মকর্তারা মিডিয়ার ওপর একহাত নিয়ে আজ বা আগামীকাল শাসকদলের সোনার ছেলেদের রক্ষা করার এমন একটি সুযোগ তৈরি করতে পারতেন। এই বুদ্ধি বা দেশপ্রেম তাঁদের নেই কেন? জেলহাজত থেকে সোনার ছেলেরা বের হয়ে এলে এ ধরনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো তাঁদের। সরকার এ জন্যই তাঁদের পাবনা থেকে বদলি করেছে, মানসিক ধকল কাটানোর জন্য কাউকে কাউকে ওএসডি করেছে! কিন্তু তাঁদের তো অন্তত চাকরিচ্যুত করা হয়নি! এ জন্য হলেও সরকার কিছু প্রশংসা পেতে পারে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই কথাগুলো দেশের কেউ বুঝল না!
শুধু পাবনা নয়, নিয়োগ-পরীক্ষা নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডের অভিযোগ উঠছে সারা দেশে। অথচ এখানেও প্রশংসা করার কিছু বিষয় আছে। নিয়োগ যারা পাচ্ছে তারা আওয়ামী লীগের লোক হতে পারে, কিন্তু তারা তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। শুধু যদি তাদের চাকরি হয়, তাহলেও তো দেশের বেকার সমস্যা খানিকটা দূর হয়। তাদের চাকরি পাইয়ে দিয়ে যদি কারও পকেট ভারী হয়, তাতেও লাভ আছে। এতে চাকরিপ্রাপ্ত আর চাকরিপ্রদাতা দুই পক্ষের আর্থিক সংস্থান হয়। দুর্নীতি না হলে লাভ হয় শুধু প্রথম পক্ষের। বেকার সমস্যায় জর্জরিত দেশে নিয়োগ-বাণিজ্যেই তো উত্তম!
সমালোচকেরা হয়তো বলবেন, প্রশাসনে মেধাবীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে এতে, যোগ্যদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, তাদের সমান সুযোগের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এগুলো ঠিক, কিন্তু সে জন্যও শতভাগ সমালোচনার যুক্তি নেই। মেধাবীদের বুঝতে হবে, এ দেশে প্রকৃত মেধার পরিচয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগে যুক্ত থাকার মধ্যে। কিংবা তাদের খুশি করার মধ্যে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ঠিক উল্টো কাজ করার মধ্যে। বর্তমান সরকার যে আরও খোলাখুলি করে দিয়েছে বিষয়টি, এটি সরকারের স্বচ্ছতার প্রমাণ। আর স্বচ্ছতা মানেই সুশাসন, তাই না?
৩.
ছাত্রলীগ-যুবলীগের খুনোখুনি নিয়ে সবচেয়ে সমালোচনা হচ্ছে সরকারের। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বারবার তাঁর ক্ষোভ ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। এতেও লাভ হয়নি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, তাঁর ক্ষোভ আন্তরিক। আমাদের মনে আছে, তিনিই প্রথম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রকৃত ছাত্রদের নেতৃত্বের সুযোগ দিয়েছেন, তাঁদের বয়সসীমা নির্দিষ্ট করেছেন, তাঁদের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন। তাঁর আন্তরিকতার সবচেয়ে বড় অপমান করেছেন ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা-কর্মীরা। সারা দেশে যেভাবে তাঁরা সন্ত্রাসে মেতে উঠছেন, যে নৃশংসতা দেখাচ্ছেন তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত করবে।
একটু নিষ্ঠুরতা হয়ে যায়, তবু বলি, এর মধ্যেও কিছুটা প্রশংসার বিষয় রয়েছে। যেমন খুনের ঘটনার পর কিছু নেতাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি অভিযুক্তদের চূড়ান্ত বহিষ্কার করতে না পারে, আদালত যদি তাঁদের জামিন দিয়ে দেয়, তাহলে সরকার কী করবে? হ্যাঁ, দেশে যদি আওয়ামী পুলিশ লীগ, প্রশাসন লীগ কিংবা বিচারক লীগ থাকত তাহলে আমরা পুরোপুরি দোষ সরকারকে দিতে পারতাম। এই দর্শনের কথাই সরকারি দলের যুগ্ম মহাসচিব বাকশালের আদর্শে বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমরা যদি তা না বুঝি তাহলে সরকারের কী দোষ!
আসল প্রশংসার কাজ করছে ছাত্রলীগ নিজে। একজন মন্ত্রী তাদের বুদ্ধি দিয়েছিলেন নিজেরা মারামরি না করে বিরোধী ছাত্রসংগঠনের ওপর চড়াও হতে। ছাত্রলীগ তার কথা শোনেনি। এরপর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেখানেও তারা নিজেরাই মারামারি করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। ছাত্রদল বা শিবির আক্রান্ত হয়েছে কালেভদ্রে। বিরোধী দলের প্রতি এই অপূর্ব সহনশীলতার নজির আছে আর দেশে?
চাইলে প্রশংসা করার মতো বিষয় সব কাজেই পাওয়া যাবে। সরকার বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির আইন করেছে তো অসুবিধা কী? কোন দিন কোন আদালতে মন্ত্রী-আমলাদের শাস্তির ঘটনা ঘটেছে? মাঝখান দিয়ে শুধু শুধু আদালতে মামলার জট বেড়েছে, টাকাপয়সার অপচয় হয়েছে, ওয়ান-ইলেভেন বিশ্বাসীরা আশাবাদী হয়েছে। একবারে আইন করে দায়মুক্তি দিয়ে দিলে বরং এসব ঝামেলা বিদায় হয়। দায়মুক্তি আইনের প্রশংসা করা উচিত তাই। সরকার যে বিভিন্ন কৌশলে বিএনপিকে সংসদ থেকে বাইরে রেখেছে বলে কোনো কোনো নিন্দুক অভিযোগ করেন, তার মধ্যেও প্রশংসা করার বিষয় রয়েছে। বিরোধী দল সংসদে থাকলে সরকারি দলের কারও কারও মাথায় রক্ত চড়ে যায়, সংসদে গালাগালি-কটূক্তি তাই চরমে ওঠে। তার চেয়ে তারা সংসদে না থাকলেই ভালো। একপক্ষীয় কটূক্তি হয়, কিন্তু তা বহুক্ষণ স্থায়ী হয় না। সাংসদেরা প্রাণভরে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন অবদানের কথা বলতে পারেন। এসব ভালো কথা শুনে লোকের দুঃখ নিশ্চয়ই ঘোচে কিছুটা। এ জন্য সম্ভবত সরকার চাইছে, বিটিভির সংবাদ একটু প্রচারিত হোক বেসরকারি টিভিতে। জিনিসের দাম বাড়ুক, লোডশেডিং বাড়ুক, খুন-ছিনতাই চলুক। তাই বলে ভালো কথা শোনার আনন্দ থেকে কেন বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ!
এমন জনদরদি সরকারের কিছু প্রশংসা করাই উচিত আমাদের।
৪.
সমস্যা হচ্ছে, এই সাধারণ বিষয়টি জ্ঞানী মানুষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশে অতি বরেণ্য একজন মানুষ। তিনি সবার অভিভাবকতুল্য, প্রখর প্রজ্ঞাবান। অথচ তিনিই কী ভয়ংকর কথা বলে বসলেন। তিনি কেমন করে বলেন দেশ এখন বাজিকরদের হাতে? কেমন করে লিখেন ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি, মতলববাজি এত ধরনের বাজির রকমফের দেখে দেশের মানুষ দিশেহারা?
তার কথা শুনে মনে হয়, দেশে যেন আগে হয়নি এসব! রাজাকার আর তার বন্ধুদের সরকারও এসব করেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের লোকজন এসব করছে। চেতনার এতে যতই বারোটা বাজুক, চেতনাধারীরা তো লাভবান হচ্ছেন। ১০ শতাংশ প্রশংসা এখানেও তো সরকারের প্রাপ্য!
কাজেই আসুন, সবাই মিলে সরকারের প্রশংসা করি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এবং সরকারের সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments