টিপাইমুখ প্রকল্প-প্রস্তুতির কাজ থেমে নেই by রাহীদ এজাজ

বাংলাদেশের সম্মতি নিয়ে এগোনো হবে বলা হলেও টিপাইমুখ বহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তুতিকাজ থেমে নেই। প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পাওয়া সাপেক্ষে প্রকল্পটি মন্ত্রিসভা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রধান প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এনএইচপিসির (জাতীয় জলবিদ্যুৎ সংস্থা) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া গেছে।


এখন বনসংক্রান্ত ছাড়পত্র পেলে মন্ত্রিসভা কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া হবে। এ ছাড়া কারিগরি ও অর্থনৈতিক ছাড়পত্র আগেই দিয়ে দিয়েছে ভারত সরকার।
তবে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা আর স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিরোধিতা প্রলম্বিত করতে পারে টিপাইমুখ প্রকল্পের বাস্তবায়ন। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যুক্ত থাকায় প্রকল্পের খরচও বাড়বে। তা ছাড়া উৎপাদন-সরঞ্জামের মূল্যও বেড়ে চলছে লাগামহীনভাবে। এ অবস্থায় এটিকে ‘উচ্চাভিলাষী’ প্রকল্প হিসেবেই বিবেচনা করছে এনএইচপিসি।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রস্তাবিত এই বৃহদায়তন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তবে এনএইচপিসির নির্বাহী পরিচালক এ কে সরকারের দাবি, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সুফল পাবে বাংলাদেশ। তাঁর অভিমত, বাংলাদেশের উদ্বেগ যৌথ সমীক্ষার সময় তুলে ধরা হলে তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এ কে সরকার বলেন, এ পর্যন্ত যেসব বিষয়ে অনুমোদন পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন কাজের সমন্বয় সাধন করছেন। অর্থাৎ প্রকল্পের নকশাসহ অবকাঠামোর খুঁটিনাটি দিক, আশপাশের পরিস্থিতি, সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের প্রস্তুতির দিকগুলো যাচাই-বাছাই করছেন।
মণিপুর ও মিজোরামের জনগণের একাংশ এবং পরিবেশবাদীদের পাশাপাশি আসামের বরাক উপত্যকার লোকজনও টিপাইমুখের প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। তাঁদের যুক্তি, এটি বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প এলাকার মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। সামগ্রিকভাবে বিপন্ন হবে পরিবেশ। তবে মণিপুর সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এন দ্বিজেন সিংয়ের দাবি, টিপাইমুখ প্রকল্পের সমর্থনকারীর সংখ্যা বিরোধীদের চেয়ে অনেক বেশি। বিরোধিতাকারীরা সংখ্যায় কম হলেও সংগঠিতভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন। ফলে তাঁদের কণ্ঠই গণমাধ্যমে বেশি প্রতিফলিত হচ্ছে।
সম্প্রতি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে টিপাইমুখ এলাকা সফরের পর শিলচরের কাছাড় ক্লাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলেন এ কে সরকার ও তাঁর কয়েকজন সহকর্মী। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের টিপাইমুখ এলাকায় যাওয়ার কথা থাকলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। তাই হেলিকপ্টার থেকেই টিপাইমুখ প্রকল্প দেখতে হয়েছে।
বড় প্রতিবন্ধকতা দুর্গম এলাকা: টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (নকশা) কাজল সাহা বলেন, দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নকে প্রলম্বিত করতে পারে। কারণ, আসামের শিলচর থেকে টিপাইমুখ প্রকল্পের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। এর মাঝে ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ভালো, বাকি ৯৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা ও ৪৯ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করতে হবে নতুন করে। বর্তমানে নৌপথে টিপাইমুখ যাওয়া সম্ভব হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী সরঞ্জাম সেখানে নিয়ে যাওয়ার মতো নাব্যতা নদীতে নেই। তা ছাড়া নিরাপত্তাজনিত সমস্যাও আছে। তাই টিপাইমুখে নির্মাণকাজ শুরু করার আগে রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত করতেই দুই বছর লাগতে পারে।
সমীক্ষায় শুধু প্রকল্পের আশপাশ: টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবসংক্রান্ত সমীক্ষা করা হয়েছে শুধু প্রকল্পের জলাধারসংলগ্ন ১০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে। অন্যদিকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে করা সমীক্ষায়ও বিবেচিত হয়েছে প্রকল্প এলাকার আশপাশ। আর বাঁধে ফাটলসংক্রান্ত সমীক্ষা চালানো হয়েছে প্রকল্পসংলগ্ন বদরহাট এলাকা পর্যন্ত। ফলে টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না, এমনটা বলা হলেও সেটি উপেক্ষিত থেকেছে এসব সমীক্ষায়।
লাভবান হবে!: টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মনে করেন এনএইচপিসির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ কে সরকার। তিনি বলেন, বন্যার সময় একসঙ্গে সব পানি ছেড়ে দেওয়া হবে না। নিয়ন্ত্রিত উপায়ে পানি ছাড়া হবে। বর্ষার সময় পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ছাড়া হবে। এতে লাভবান হবে বাংলাদেশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, জলাধারে ১৬ হাজার ৯৬১ কিউমেক পানির মধ্যে ১০ হাজার ২১৪ কিউমেক জমা রাখা হবে। বাকি ছয় হাজার ৭৫০ কিউমেক পানি স্পিলওয়ের মাধ্যমে ছাড়া হবে।
টিপাইমুখ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে ভারত সরকারের বড় যুক্তি হলো, এই বাঁধের মাধ্যমে ভারতের কাছাড় ও আশপাশের এলাকা এবং বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়া হবে না; বরং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সারা বছরই পানি ছাড়া হবে। বিশেষ করে বর্ষাকালে পানি আটকে রাখা হবে জলাধারে। ফলে ভাটির বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ কমবে। শুকনো মৌসুমে এই পানি ছাড়ার কারণে সেচের কাজে ব্যবহার করা যাবে।
খোলাসা নয় লাভ-ক্ষতি: এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। সংগত কারণেই এই প্রকল্পে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ছয় থেকে সাত রুপি হবে। এটা এনএইচপিসির জন্য লাভজনক হবে কি না, জানতে চাইলে এ কে সরকার স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, বন্যানিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের প্রকল্পে খরচ বাড়াটাই স্বাভাবিক।
সিডব্লিউসি থেকে এনএইচপিসি: সম্প্রতি টিপাইমুখ এলাকা সফরের সময় এনএইচপিসির নির্বাহী পরিচালক এ কে সরকার জানান, ১৯২৯-৩০ সালে বন্যায় দারুণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিল আসাম, বিশেষ করে এর বরাক উপত্যকা। তখন থেকেই ওই এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাবনার শুরু। এ পরিস্থিতিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন (সিডব্লিউসি) ১৯৫৪ সাল থেকে বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে। সিডব্লিউসির সমীক্ষা শেষে ১৯৮৪ সালে একটি বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) জমা দেয়। পরে এ কাজটি করার দায়িত্ব বর্তায় সিডব্লিউসির একটি সংস্থা ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের কাছে। এরপর ব্রহ্মপুত্র বোর্ড ওই ডিপিআর কিছুটা সংশোধন করে। প্রকল্পটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হওয়ায় ফের পরিবর্তন আসে বাস্তবায়নকারী সংস্থার দায়িত্বে। ১৯৯৯ সালে প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংস্থাকে (নিপকো)। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ (সিইএ) ২০০৩ সালে প্রকল্পের কারিগরি ও অর্থনৈতিক ছাড়পত্র দেয়। প্রায় এক দশক আগে দায়িত্ব পেলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত না হওয়ায় নতুন করে ভাবতে শুরু করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
এ প্রসঙ্গে এ কে সরকার বলেন, ‘সরকারের মধ্যে হয়তো ভাবনা শুরু হয়েছিল, এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন নিপকোকে দিয়ে না-ও হতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এনএইচপিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত প্রকল্পটি আরও উন্নত ও বিনিয়োগের পথ সুগম করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর এক বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালের এপ্রিলে আমরা প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছি। ২০১১ সালের অক্টোবরে এনএইচপিসি, এসজেভিএন ও মণিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে সই হয়েছে একটি প্রমোটরস চুক্তি।’
সব মিলিয়ে প্রকল্পটি চারবার হাতবদল হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সব ছাড়পত্র নিপকোর নামেই আছে। নতুন কোম্পানি গঠনের আগে এভাবেই কাজ এগোবে।

No comments

Powered by Blogger.