কলকাতার চিঠি-বাঙালির কাঁটা বাঙালি? by অমর সাহা

১৯৯৬ সাল। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে বাম ও প্রগতিশীল ১৩টি দলের ‘যুক্তফ্রন্ট’ সরকার গড়ার কাজে ব্রতী হয়। এই ১৩ দলে ছিলেন জনতা দলের ভি পি সিং, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের লালুপ্রসাদ যাদব, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব, বিজু জনতা দলের বিজু পট্টনায়েক, তেলেগু দেশমের চন্দ্রবাবু নাইডু, অসম গণপরিষদের প্রফুল্ল


মহন্ত, ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দলের এইচ ডি দেবগৌড়াসহ চার বাম দল—সিপিএম, সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি। যুক্তফ্রন্টের সভায় সিদ্ধান্ত হয় ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন সিপিএমের প্রবীণ নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। যুক্তফ্রন্টের সভায় জ্যোতি বসুকে সংসদীয় দলের নেতাও নির্বাচন করা হয়।
কিন্তু বাদ সাধে জ্যোতি বসুর দল সিপিএম। তারা ঘোষণা দেয়, তারা কেন্দ্রীয় সরকারে যোগ দেবে না, বাইরে থেকে সমর্থন জানাবে। এ নিয়ে সিপিএমও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেন সিং সুরজিৎ, সমর মুখার্জি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা সরকারে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। অন্যদিকে আবার সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসুরা সরকারে না যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। এই নিয়ে দলের ভেতর বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। অবশেষে কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় ভোটাভুটি হয়। ভোটে সরকারের যাওয়ার প্রস্তাব ২২-২৭ ভোটে খারিজ হয়ে যায়। ভেঙে যায় প্রথম বাঙালিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। অগত্যা যুক্তফ্রন্ট প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসায় এইচ ডি দেবগৌড়াকে। আর আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল যে কেন্দ্রীয় কমিটির সাত বাঙালি সদস্য সেদিন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন: বিনয় চৌধুরী, বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, বিনয় কোঙার, নীরেন ঘোষ, চিত্তব্রত মজুমদার ও হান্নান মোল্লা। তাঁরা যদি সেদিন জ্যোতি বসুর প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়াতেন, তবে ভারতের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতো। বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেতেন। কিন্তু বাঙালিরাই দিলেন না সেই সুযোগ।
১৯৯৬ থেকে ২০১২ দীর্ঘ ১৬ বছর পর সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইলেন আরেক বাঙালি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বেসর্বা। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে চলে আসে আরেক বাঙালি নেতা, কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জির নাম। জাতীয় কংগ্রেস গত বুধবার জানিয়ে দেন রাষ্ট্রপতি পদে তাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে প্রণব মুখার্জির নাম। দ্বিতীয় স্থানে বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির নাম। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী নিজে মমতাকে দিল্লিতে ডেকে প্রণবকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব দিলেই মমতা তাতে সায় না দিয়ে বরং সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে বৈঠক করে ওই দুটি নাম প্রত্যাখ্যান করে নতুন করে জুড়ে দেন তিনটি নাম। তাঁরা হলেন: সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং লোকসভার সাবেক স্পিকার এবং বামপন্থী নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম। দাবি করা হয়, এই তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি করা হোক। কংগ্রেস অবশ্য মমতার এই প্রস্তাব বৃহস্পতিবার সরাসরি খারিজ করে দেয়।
মমতার এই ভূমিকায় রুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে আরেক বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথ। যদিও কংগ্রেস এখনই হাল ছাড়ছে না। তারা নতুন করে অঙ্ক কষা শুরু করেছে। ইউপিএর মমতা বাদে সব শরিকই প্রণবকে সমর্থন জানালেও রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থীর জয় পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আবার মমতা এবং মুলায়মের এই দুই দলের প্রার্থীকেও জিতিয়ে আনা অসম্ভব হবে।
বলে রাখা ভালো, ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা, নিম্নকক্ষ লোকসভা এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার সদস্যরা। অর্থাৎ সাংসদ ও বিধায়কেরা। বলা বাহুল্য, গত নির্বাচনের মতো এবারও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হচ্ছে ১৯ জুলাই।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট হয় প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা ভবনে। ভোট হয় একটি ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে। প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যা অনুসারে ঠিক হয় একজন সদস্যের ভোটমূল্য। অর্থাৎ ওই রাজ্যের প্রকৃত ভোটার আর বিধানসভা আসনের ভাগফল যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তা-ই হয় একজন বিধায়কের ভোটমূল্য। আবার দেশের মোট ভোটার সংখ্যাকে ভাগ করা হয় লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যসংখ্যা দিয়ে। এতে পাওয়া যায় রাজ্য ও লোকসভার সদস্যদের ভোটমূল্য। সব মিলিয়ে এবার লোকসভা, রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্যদের ভোটমূল্য গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮২। ভারতে রয়েছে এখন উভয় সংসদে ৭৭৬ জন সাংসদ ও চার হাজার ১২০ জন বিধায়ক।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হতে হলে এবার ন্যূনতম ভোট লাগবে পাঁচ লাখ ৪৯ হাজার ৪৪২টি। কংগ্রেসের রয়েছে তিন লাখ ৩০ হাজার, তৃণমূল কংগ্রেস ৪৫ হাজার ৯২৫, সমাজবাদী পার্টি ৬৬ হাজার ৬৮৮টি। আবার সমাজবাদী পার্টি এবং তৃণমূল ছাড়া ইউপিএর ভোট রয়েছে চার লাখ ৫৯ হাজার ৩১টি। ম্যাজিক সংখ্যার চেয়ে কম রয়েছে ৯০ হাজার ৪১১টি। আর যদি ইউপিএর সঙ্গে লালু প্রসাদের আরজেডি, সমাজবাদী পার্টি এবং মায়াবতীর বিএসপি কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন দেয়, তবে তাদের ভোটসংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৪টি।
অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএর ভোট রয়েছে তিন লাখ চার হাজার ৭৮৫টি। জেতার জন্য কম রয়েছে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৭টি ভোট। আর কেবল বিজেপির রয়েছে দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৮৫টি ভোট। মমতা এবং মুলায়মের ভোট যোগ করলে ভোটসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে চার লাখ ১৭ হাজার ৩৯৮টি। তাই এখন এক দিকে কংগ্রেস, অন্যদিকে বিজেপি এবং মমতা রাজনৈতিক আসরে নেমেছেন জয়ের জন্য। লক্ষ্য একটাই, যেভাবে হোক অন্য রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের ভোট বাগিয়ে আনা। এই নিয়েই এখন জোর রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে।
শেষ কথা, এবারও হয়তো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এক বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ। ইতিহাসে প্রথম এক বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আর দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ এসেছে ৬৫ বছর পর। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চাইছে রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে একজন বাঙালির রাষ্ট্রপতি হওয়ার যে সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়।
 অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.