মনের কোণে হীরে-মুক্তো-বাংলাদেশে দুর্নীতির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা by ড. সা'দত হুসাইন
নির্বাচন-পূর্ব বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন আলোকিত মানুষ। বর্তমানে বয়সের ভারে এবং পরিস্থিতির চাপে তিনি 'ডাইনে-বাঁয়ে' সমানতালে বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য কোনো কোনো সময় সরকারের জন্য বিব্রতকর, এমনটি বললে অত্যুক্তি হবে না। আশার কথা যে মাঝেমধ্যে এর মধ্যেও আলোক রশ্মি দেখা যায়।
মনে হয় তিনি অন্তর্জ্বালায় ভুগছেন। এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক আপ্তবাক্য হচ্ছে: Contradiction is the man, consistency is demand of others on him.
সাম্প্রতিককালে তিনি একটি মূল্যবান সত্য কথা বলেছেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, পুলিশের পদ্ধতিতেই দুর্নীতি রয়েছে, মাঠপর্যায় থেকে সর্বস্তরেই আছে দুর্নীতির অভিযোগ। পুলিশের মতো একইভাবে ভূমি প্রশাসন, বিচার বিভাগ, কর প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়। ফলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য যাদের স্বার্থের প্রতিকূলে গেছে, তারা এ বক্তব্যে আহত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অহমিকায় চোট লাগাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এ বক্তব্য আপামর জনসাধারণের অনুধাবনকে প্রতিফলিত করেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের চুলচেরা বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে দুর্নীতির ঘাত-প্রতিঘাতে তারা জর্জরিত। তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, পরিবেশ বিষাক্ত। তারা মনেপ্রাণে এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। কবে মুক্তি পাবে কিংবা আদৌ মুক্তি পাবে কি না সে সম্পর্কে তারা মোটেই নিশ্চিত নয়।
সাধারণ মানুষ দুর্নীতিকে ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক অর্থে বোঝে; বুদ্ধিবৃত্তি বা নৈতিক অবক্ষয় তাদের কাছে অপছন্দনীয় হলেও এ নিয়ে তারা মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন নয়। দুর্নীতির ব্যবহারিক সংজ্ঞা হচ্ছে : লিখিতভাবে বা প্রকাশ্যে বিবৃত সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যান ছাড়া কোনো ব্যক্তি প্রচলিত আইন বা নীতি লঙ্ঘন-পূর্বক তার নিজের অথবা আত্মীয়স্বজনের জন্য কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক সুবিধা গ্রহণ করলে সে কাজকে দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা বাহুল্য, অতি অল্প পরিমাণ সুবিধা গ্রহণকে জনগণ 'নগণ্য' হিসেবে উপেক্ষা করে থাকে। এ নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। এরূপ 'নগণ্য' সুবিধা গ্রহণকে সাধারণত দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
অর্থমন্ত্রী যে দুর্নীতির কথা বলেছেন তা মোটেই নগণ্যের পর্যায়ে পড়ে না। এটি মোটা দাগের দুর্নীতি, যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। আমাদের জীবনযাত্রা তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নৈরাজ্যের ছায়া ফেলেছে। এ পরিস্থিতি শিক্ষাদীক্ষা তথা সামাজিক প্রদীপ্তি এবং অগ্রগতির প্রতি বিরাট হুমকিস্বরূপ। দেখা যাচ্ছে শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা এবং পেশাভিত্তিক অবস্থানে অধস্তন হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থবলে একজন ব্যক্তি তার সৎ, সুশিক্ষিত, প্রদীপ্ত এবং সংস্কৃতিবান বন্ধু, আত্মীয় কিংবা পড়শির তুলনায় অনেক বেশি সচ্ছল, আয়েশি এবং আকর্ষণীয় জীবন যাপন করছে। আর্থিক টানাপড়েনে যদি মর্যাদাবান ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ কিংবা কষ্ট-ক্লিষ্ট হয়ে পড়ে, তবে তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আমাদের সমাজে তা-ই ঘটছে। নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। অতিসাধারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হচ্ছে। খেটে খাওয়া শ্রমিক তার বাড়ির আশপাশের সব জমি কিনে ফেলেছে। এনজিওকর্মী ব্যাংক কেনার পাঁয়তারা করছে। দিনমজুর ট্রাক-বাসের ব্যবসা শুরু করেছে। বিমানবন্দরের পোর্টার বিশাল মার্কেট তৈরি করে তা ভাড়া দিচ্ছে। লঞ্চঘাটের কুলির সর্দার দু-তিনটি ট্রলার একসঙ্গে কিনছে। পেশজীবীরাও এত সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে যে তারা এর হিসাব-নিকাশ রাখতে পারছে না। সর্বত্রই দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ আহরণের এক মারাত্মক প্রতিযোগিতা।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপরিউক্ত অশুভ প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা দৃষ্টিকটুভাবে এগিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তা যেকোনো প্রাজ্ঞ এবং বিবেকবান লোককে মুহূর্তের জন্য হলেও স্তম্ভিত করে। তারা কিছুতেই মিলাতে পারেন না, স্বল্প বেতনভুক্ত একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কী করে এত সম্পদের মালিক হয়। সম্পদশালী কর্মকর্তাদের গৎবাঁধা উত্তর- এ সম্পদ তারা শ্বশুরপক্ষ থেকে পেয়েছে অথবা কোনো সহৃদয় আত্মীয়স্বজন তাদের দান করেছে। বিদেশে চাকরির অজুহাত দেন কিছু কর্মকর্তা। আবার কেউ কেউ দাবি করে যে উত্তরাধিকার সূত্রে তারা অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে।
এসব যে নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকা কর্মকর্তা, যাঁদের পরিবার সচ্ছল ছিল, যাঁরা দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন, যাঁদের কোনো নির্ভরশীল আত্মীয়ের ভরণপোষণ জোগাতে হয়নি, যাঁদের স্ত্রী চাকরি করেছেন তাঁদেরও সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। জীবনে তাঁরা গ্রামে কোনো বড় বাড়ি করতে পারেননি। বড় দামি গাড়ি কিনতে পারেননি। আত্মীয়স্বজনকে দামি উপহার দিতে পারেননি। বড়জোর অবসর জীবনে খেয়ে-পরে ভালো আছেন। ছেলেমেয়ে মানুষ হয়েছে ওই পর্যন্তই। কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে গ্রামে বাড়ি নির্মাণ করা, মা-বাবার নামে নিজ খরচে স্কুল-কলেজ করা কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সৎভাবে উপার্জিত অর্থে বড় রকমের দান-অনুদান বা নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা একজন গণকর্মচারীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব বলে আমি মনে করি।
ভয় ও হতাশার ব্যাপার হলো, দুর্নীতির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মারাত্মকভাবে প্রসারিত হচ্ছে এবং এর শিকড় গভীরে চলে যাচ্ছে। কতিপয় সংগঠনে এ রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে। সমাজদেহে এটি দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। একটি সংগঠনে কারা দুর্নীতিবাজ, এটি প্রায় সবাই জানে, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে কেউ সাহস পায় না। বরং বেশির ভাগ সহকর্মী এদের সমীহ করে চলে। কারণ এরা ক্ষমতাবান; ওপরওয়ালাদের সঙ্গে এদের ভালো যোগসূত্র রয়েছে। এরা যে কারো ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এদের চালচলন, ভোগ-উপভোগের নমুনা সহকর্মীদের প্রলোভিত করে। কখনো কখনো এরা সহকর্মী এবং অধস্তন কর্মীদের জন্য নানারূপ অন্যায় সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে এরা নেতা বনে যায়। এ সুযোগে এরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে।
সামাজিক অঙ্গনেও দুর্নীতিবাজ বিত্তশালীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে। মধ্যবিত্তের দৃশ্যমান উত্থান এ ধারাকে ত্বরান্বিত করছে। লোভ এবং আত্মকেন্দ্রিকতা ভোগবাদকে সুরক্ষা করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। ঘৃণিত হওয়ার বদলে দুর্নীতিবাজ বিত্তশালীরা সমাজের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। বড় মাপের নেতা হয়ে ওঠে। অর্থ-সম্পদের মালিকানাই আজ মূল্যায়নের মূল মানদণ্ড। কী প্রক্রিয়ায় এ সম্পদ আহরিত হয়েছে তা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং বিত্তশালী যত দুর্নীতিবাজই হোক না কেন, সমাজ-নিয়ন্ত্রণে তার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। মধ্যবিত্ত সমাজে প্রায় সবাই অর্থের বশ। দুর্নীতিকে রুখবে কে?
দুর্নীতি দেশের জন্য এক মারাত্মক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করার জন্য সব দল ঘোষণা দিতে বদ্ধপরিকর। সরকারি দল, বিরোধী দল একে অপরকে দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করে এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনে আন্তরিক এমনটি প্রমাণ করার জন্য নানা প্রচার কৌশল অবলম্বন করে। দুর্নীতি দমনের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, নতুন সংগঠন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি কমেনি। আবার নতুনভাবে অনুধাবন করা হচ্ছে, নতুন স্লোগান উঠছে। তবু দুর্নীতি থেকেই যাচ্ছে। অবশেষে খোদ অর্থমন্ত্রী বলছেন দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সরকারের জন্য ব্রিবতকর হলেও সমস্যা চিহ্নিত করতে তিনি ভুল করেননি।
আসলে দুর্নীতি দূর করতে আমরা চাই কি না, জাতি হিসেবে নিজেদের সে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। আমার ধারণা ভাবধারার নেতৃত্বদানকারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ আসলে দুর্নীতি নিরসন করতে চায় না। কারণ শ্রেণী হিসেবে তারা দুর্নীতিবান্ধব। দুর্নীতির মাধ্যমে তারা অধিকতর সম্পদশালী হয়, দেশের সম্পদের ওপর, মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠা করে। সে জন্যই দুর্নীতি দূর হয় না। শুধু কথার পিঠে কথা বাড়ে। নানা কৌশলে, নানা স্লোগানে নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার চেষ্টা করা হয় মাত্র। দুর্নীতির সঙ্গে সখ্য রাখা আমাদের শ্রেণী চরিত্র। সে চরিত্র সুদৃঢ়। অনেক বেশি নিখাদ। দুর্নীতির শিকড় তাই অনেক গভীরে প্রোথিত।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
সাম্প্রতিককালে তিনি একটি মূল্যবান সত্য কথা বলেছেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, পুলিশের পদ্ধতিতেই দুর্নীতি রয়েছে, মাঠপর্যায় থেকে সর্বস্তরেই আছে দুর্নীতির অভিযোগ। পুলিশের মতো একইভাবে ভূমি প্রশাসন, বিচার বিভাগ, কর প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়। ফলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য যাদের স্বার্থের প্রতিকূলে গেছে, তারা এ বক্তব্যে আহত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অহমিকায় চোট লাগাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এ বক্তব্য আপামর জনসাধারণের অনুধাবনকে প্রতিফলিত করেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের চুলচেরা বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে দুর্নীতির ঘাত-প্রতিঘাতে তারা জর্জরিত। তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, পরিবেশ বিষাক্ত। তারা মনেপ্রাণে এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। কবে মুক্তি পাবে কিংবা আদৌ মুক্তি পাবে কি না সে সম্পর্কে তারা মোটেই নিশ্চিত নয়।
সাধারণ মানুষ দুর্নীতিকে ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক অর্থে বোঝে; বুদ্ধিবৃত্তি বা নৈতিক অবক্ষয় তাদের কাছে অপছন্দনীয় হলেও এ নিয়ে তারা মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন নয়। দুর্নীতির ব্যবহারিক সংজ্ঞা হচ্ছে : লিখিতভাবে বা প্রকাশ্যে বিবৃত সমালোচনা বা প্রত্যাখ্যান ছাড়া কোনো ব্যক্তি প্রচলিত আইন বা নীতি লঙ্ঘন-পূর্বক তার নিজের অথবা আত্মীয়স্বজনের জন্য কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক সুবিধা গ্রহণ করলে সে কাজকে দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা বাহুল্য, অতি অল্প পরিমাণ সুবিধা গ্রহণকে জনগণ 'নগণ্য' হিসেবে উপেক্ষা করে থাকে। এ নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। এরূপ 'নগণ্য' সুবিধা গ্রহণকে সাধারণত দুর্নীতি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
অর্থমন্ত্রী যে দুর্নীতির কথা বলেছেন তা মোটেই নগণ্যের পর্যায়ে পড়ে না। এটি মোটা দাগের দুর্নীতি, যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। আমাদের জীবনযাত্রা তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নৈরাজ্যের ছায়া ফেলেছে। এ পরিস্থিতি শিক্ষাদীক্ষা তথা সামাজিক প্রদীপ্তি এবং অগ্রগতির প্রতি বিরাট হুমকিস্বরূপ। দেখা যাচ্ছে শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা এবং পেশাভিত্তিক অবস্থানে অধস্তন হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থবলে একজন ব্যক্তি তার সৎ, সুশিক্ষিত, প্রদীপ্ত এবং সংস্কৃতিবান বন্ধু, আত্মীয় কিংবা পড়শির তুলনায় অনেক বেশি সচ্ছল, আয়েশি এবং আকর্ষণীয় জীবন যাপন করছে। আর্থিক টানাপড়েনে যদি মর্যাদাবান ব্যক্তির জীবন দুর্বিষহ কিংবা কষ্ট-ক্লিষ্ট হয়ে পড়ে, তবে তা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আমাদের সমাজে তা-ই ঘটছে। নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। অতিসাধারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হচ্ছে। খেটে খাওয়া শ্রমিক তার বাড়ির আশপাশের সব জমি কিনে ফেলেছে। এনজিওকর্মী ব্যাংক কেনার পাঁয়তারা করছে। দিনমজুর ট্রাক-বাসের ব্যবসা শুরু করেছে। বিমানবন্দরের পোর্টার বিশাল মার্কেট তৈরি করে তা ভাড়া দিচ্ছে। লঞ্চঘাটের কুলির সর্দার দু-তিনটি ট্রলার একসঙ্গে কিনছে। পেশজীবীরাও এত সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে যে তারা এর হিসাব-নিকাশ রাখতে পারছে না। সর্বত্রই দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ আহরণের এক মারাত্মক প্রতিযোগিতা।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপরিউক্ত অশুভ প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তারা দৃষ্টিকটুভাবে এগিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তা যেকোনো প্রাজ্ঞ এবং বিবেকবান লোককে মুহূর্তের জন্য হলেও স্তম্ভিত করে। তারা কিছুতেই মিলাতে পারেন না, স্বল্প বেতনভুক্ত একজন কর্মকর্তা-কর্মচারী কী করে এত সম্পদের মালিক হয়। সম্পদশালী কর্মকর্তাদের গৎবাঁধা উত্তর- এ সম্পদ তারা শ্বশুরপক্ষ থেকে পেয়েছে অথবা কোনো সহৃদয় আত্মীয়স্বজন তাদের দান করেছে। বিদেশে চাকরির অজুহাত দেন কিছু কর্মকর্তা। আবার কেউ কেউ দাবি করে যে উত্তরাধিকার সূত্রে তারা অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছে।
এসব যে নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকা কর্মকর্তা, যাঁদের পরিবার সচ্ছল ছিল, যাঁরা দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন, যাঁদের কোনো নির্ভরশীল আত্মীয়ের ভরণপোষণ জোগাতে হয়নি, যাঁদের স্ত্রী চাকরি করেছেন তাঁদেরও সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। জীবনে তাঁরা গ্রামে কোনো বড় বাড়ি করতে পারেননি। বড় দামি গাড়ি কিনতে পারেননি। আত্মীয়স্বজনকে দামি উপহার দিতে পারেননি। বড়জোর অবসর জীবনে খেয়ে-পরে ভালো আছেন। ছেলেমেয়ে মানুষ হয়েছে ওই পর্যন্তই। কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে গ্রামে বাড়ি নির্মাণ করা, মা-বাবার নামে নিজ খরচে স্কুল-কলেজ করা কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সৎভাবে উপার্জিত অর্থে বড় রকমের দান-অনুদান বা নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা একজন গণকর্মচারীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব বলে আমি মনে করি।
ভয় ও হতাশার ব্যাপার হলো, দুর্নীতির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মারাত্মকভাবে প্রসারিত হচ্ছে এবং এর শিকড় গভীরে চলে যাচ্ছে। কতিপয় সংগঠনে এ রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে। সমাজদেহে এটি দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। একটি সংগঠনে কারা দুর্নীতিবাজ, এটি প্রায় সবাই জানে, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে কেউ সাহস পায় না। বরং বেশির ভাগ সহকর্মী এদের সমীহ করে চলে। কারণ এরা ক্ষমতাবান; ওপরওয়ালাদের সঙ্গে এদের ভালো যোগসূত্র রয়েছে। এরা যে কারো ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এদের চালচলন, ভোগ-উপভোগের নমুনা সহকর্মীদের প্রলোভিত করে। কখনো কখনো এরা সহকর্মী এবং অধস্তন কর্মীদের জন্য নানারূপ অন্যায় সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে এরা নেতা বনে যায়। এ সুযোগে এরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে।
সামাজিক অঙ্গনেও দুর্নীতিবাজ বিত্তশালীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে। মধ্যবিত্তের দৃশ্যমান উত্থান এ ধারাকে ত্বরান্বিত করছে। লোভ এবং আত্মকেন্দ্রিকতা ভোগবাদকে সুরক্ষা করে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। ঘৃণিত হওয়ার বদলে দুর্নীতিবাজ বিত্তশালীরা সমাজের মধ্যমণি হয়ে ওঠে। বড় মাপের নেতা হয়ে ওঠে। অর্থ-সম্পদের মালিকানাই আজ মূল্যায়নের মূল মানদণ্ড। কী প্রক্রিয়ায় এ সম্পদ আহরিত হয়েছে তা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং বিত্তশালী যত দুর্নীতিবাজই হোক না কেন, সমাজ-নিয়ন্ত্রণে তার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। মধ্যবিত্ত সমাজে প্রায় সবাই অর্থের বশ। দুর্নীতিকে রুখবে কে?
দুর্নীতি দেশের জন্য এক মারাত্মক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করার জন্য সব দল ঘোষণা দিতে বদ্ধপরিকর। সরকারি দল, বিরোধী দল একে অপরকে দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করে এবং দুর্নীতির মূলোৎপাটনে আন্তরিক এমনটি প্রমাণ করার জন্য নানা প্রচার কৌশল অবলম্বন করে। দুর্নীতি দমনের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, নতুন সংগঠন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি কমেনি। আবার নতুনভাবে অনুধাবন করা হচ্ছে, নতুন স্লোগান উঠছে। তবু দুর্নীতি থেকেই যাচ্ছে। অবশেষে খোদ অর্থমন্ত্রী বলছেন দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সরকারের জন্য ব্রিবতকর হলেও সমস্যা চিহ্নিত করতে তিনি ভুল করেননি।
আসলে দুর্নীতি দূর করতে আমরা চাই কি না, জাতি হিসেবে নিজেদের সে প্রশ্ন করার সময় এসেছে। আমার ধারণা ভাবধারার নেতৃত্বদানকারী উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ আসলে দুর্নীতি নিরসন করতে চায় না। কারণ শ্রেণী হিসেবে তারা দুর্নীতিবান্ধব। দুর্নীতির মাধ্যমে তারা অধিকতর সম্পদশালী হয়, দেশের সম্পদের ওপর, মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠা করে। সে জন্যই দুর্নীতি দূর হয় না। শুধু কথার পিঠে কথা বাড়ে। নানা কৌশলে, নানা স্লোগানে নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার চেষ্টা করা হয় মাত্র। দুর্নীতির সঙ্গে সখ্য রাখা আমাদের শ্রেণী চরিত্র। সে চরিত্র সুদৃঢ়। অনেক বেশি নিখাদ। দুর্নীতির শিকড় তাই অনেক গভীরে প্রোথিত।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments