দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি-লোনাপানির চিংড়ি আর কৃষকের লোনা অশ্রু by মোশাহিদা সুলতানা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কত কৃষকের চোখের জল একসঙ্গে হলে একটা নদী বইবে তা আমরা জানি না। শুধু জানি, এই চোখের জল বইছে নিয়মিত। আবহমানকাল ধরে নদীর কূলে বসবাসকারী কৃষকেরা লড়াই করে চলেছেন নদীর ও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে।
এক বর্ষায় হেসে, পরের বর্ষায় কেঁদে প্রতিনিয়ত যাঁরা লড়ছেন, তাঁরা একেকজন নায়ক। একদিন বুঝি বিধাতা সুপ্রসন্ন হলেন। চিংড়ি চাষের বিপুল সম্ভাবনা, দ্রুত উচ্চমুনাফা অর্জন এবং রাতারাতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো হলো খেটে খাওয়া কৃষকদের। একরের পর একর ধানি জমি লোনাপানিতে ভরে গেল। সেখানে চাষ হওয়া চিংড়ি বাক্সে বাক্সে হিমায়িত হয়ে পৌঁছে গেল ইউরোপ-আমেরিকার অসংখ্য মানুষের ডিনার টেবিলে। সংবাদ বেরুল: অবশেষে কৃষকদের দিন ফিরেছে। পাটশিল্প ধ্বংসের আফসোস ভুলে আমাদের অনেক অর্থনীতিবিদ আনন্দে দিশাহারা হয়ে জানালেন, চিংড়ি চাষ কত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আনছে। দিশেহারা অনেক ক্ষুদ্র কৃষকও। তবে তাদের কারণ ভিন্ন। কারণ, এ সাফল্যের বলি হলেন তারাই।
চিংড়ি চাষকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান নবম। একজন কৃষক ধান থেকে যা উপার্জন করতে পারেন, তার প্রায় ১০ গুণ উপার্জন করতে পারেন চিংড়ি থেকে। রপ্তানি বাজারে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় আশির দশক থেকে এটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রসার পায়। দক্ষিণাঞ্চলে বিপুল ধানি জমি চিংড়ি ঘেরে চলে যেতে থাকে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেককে বাধ্য হতে হয় ঘেরের আগ্রাসনে জমি দিতে। অনেককে জমি বিক্রি করে দিতে হয়।
কিন্তু যখন ইইউ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে আনন্দে ভাটা পড়ে। বিতর্কের কারণ চিংড়িতে ভাইরাসের আক্রমণ। লাভ কমে আসতে থাকে। কৃষকদের মধ্যে তৈরি হয় নানা প্রকার সংশয়। একদিকে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে লবণাক্ততার কারণে শাকসবজির চাষ যখন হুমকির সম্মুখীন হলে প্রান্তিক চাষিদের দুর্ভোগও বাড়ে। শুরু হয় পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্ব। কৃষকদের একদল লোনাপানির পক্ষে, একদল মিষ্টিপানির পক্ষে। কিছু কিছু এলাকায় নিজেদের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা দন্দ্বের সূত্র ধরে রক্তপাতও ঘটে। Environmental Justice-এর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এই দ্বন্দ্বে প্রায় ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় আরও হাজারজন।
প্রকৃতির মতোই রহস্যময় নদীর পথ চলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই দুর্বোধ্য ভূমি ও নদীর মধ্যে সম্পর্ক। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পোল্ডার নির্মাণ শুরু হয়। উদ্দেশ্য, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। হয়েছিলও তাই। হল্যান্ডের মডেলে নদী পরিবেষ্টিত নিম্নভূমিকে বন্যা এবং লবণাক্ততা থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে বাঁধ দিয়ে নদী থেকে আলাদা করা হয়। তৈরি হয় স্লুইসগেট, যার মাধ্যমে কৃষকেরা ইচ্ছামতো পানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন: শীত ও গ্রীষ্মে স্ল্লুইসগেট লবণাক্ত পানি ঢোকানোর জন্য এবং বর্ষার মৌসুমে বের করে দেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা যত সহজ ছিল, বাস্তবায়ন তা ছিল না। পোল্ডারের সুফলতা কমতে থাকে যখন স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন জায়গায় স্লুইসগেটগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, এই স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ করে কখন পানি ঢোকানো হবে এবং কখন বের করা হবে, তা নিয়ে সাধারণ কৃষক ও চিংড়িচাষিদের মধ্যে বিবাদ লাগে। চিংড়ির মুনাফা এই বিরোধিতাকে আরও উসকে দেয়। একপর্যায়ে শক্তিশালী ঘেরমালিকরা স্লুইসগেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে, যদিও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু জনবলের ঘাটতি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবে সময়মতো স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তারা। ফলাফল রাজনীতিকরণ। প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে একটি এককালীন বিরোধিতা থেকে চিরস্থায়ী বিরোধিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে প্রান্তিক চাষিরা, যাঁরা চিংড়ি চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান চাষে আগ্রহী হতে শুরু করে, তারা নানা রূপ বাধার সম্মুখীন হয়। কিছু কিছু এলাকায় প্রান্তিক চাষিদের প্রভাবশালী কৃষকদের কাছ থেকে সেচের পানি কিনতেও হয়েছে। এই বাণিজ্যিকীকরণের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ব্যর্থতার কারণে।
সমস্যার কারণ কেবল সরকারি অবহেলাই নয়, পরিকল্পনার ব্যর্থতাও দায়ী। বাংলাদেশের মতো ভিয়েতনাম, ইকুয়েডরসহ অন্য দেশগুলোতেও দেখা দেয় মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা। পরিকল্পনাগুলো করেছিল কারা? বিশ্বব্যাংকের প্রেরণা ও সক্রিয়তায় চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলো। যুক্তিটা এই: চিংড়ি চাষে কর্মসংস্থান বাড়ে, বাড়ে কৃষকের আয়, বাড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটা হয়েছিল রপ্তানিমুখী কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে। কিন্তু জানা থাকা সত্ত্বেও পরিণামে এর ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখা হয়েছে। কারণ তার ভুক্তভোগী ধনী কৃষক নন প্রান্তিক চাষি। তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কেউ চিন্তা করেনি, করেনি সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধি ও প্রকৃতির ওপর এর বিষফল নিয়েও। সবকিছু অর্থমূল্যে বিচার করার এই দৃষ্টিভঙ্গি বহু ক্ষেত্রেই এ রকম ক্ষতিকর ফল জন্ম দিয়েছে।
যে কৃষক আগে ধান চাষ করতেন, তিনি এখন বাধ্য হয়ে চিংড়ি চাষ করেন। বাজারমূল্যের থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হয় তাঁকে, তাঁর উঠানে শাকসবজি হয় না, তাঁকে খাবার পানি কিনে আনতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে, তাঁর গোয়ালের গরুর খাবার নেই, গরু দুধ দেয় না, গাছে ফল হয় না। তবে কি শুধু চিংড়ি খেয়ে থাকবেন এই কৃষক? না। চিংড়িতেও ভাইরাস! যদিও অঞ্চল ও শ্রেণীভেদে এই দুর্ভোগ সমান নয়, তবু বুঝতে দেরি হয় না কে বেশি ভুক্তভোগী।
বিরোধিতা বাড়ছে আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা আরও প্রভাবশালী হচ্ছেন। যাঁর আগে জমি ছিল, যাঁর ঘরে সারা বছর ধান থাকে, যাঁর কিছু জমিতে ধানের চাষ হলে বাকি জমিতে অনায়াসে চিংড়ির চাষ হয়, সরকারের ভূমিবণ্টন আইনের আওতায় ভূমি বরাদ্দ পাচ্ছেন তাঁরাই। দুর্ভাগা প্রান্তিক চাষিদের পাশে দাঁড়াবে কে? দিন শেষে আইন একটি ব্যবসা, দিন শেষে মিথ্যা মামলা, ভোগান্তি মানে প্রভাবশালীর পায়ে গিয়ে পড়া। আর গ্রামে গ্রামে বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, প্রভাবশালীদের অনাচার।
এর শেষ কোথায়? সমুদ্রের লোনা জলে এর উৎপত্তি, চোখের পানিতে কী এর শেষ? আমরা চাই, আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এই প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করুক। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যেন জলবায়ু পরিবর্তন এবং দারিদ্র্য নিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্র হয়ে না ওঠে। কৃষকেরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হোক। সরকার পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে পানিশাসনের অবকাঠামো তৈরি করুক। এবং এই অবকাঠামো পরিচালনার ভার যেন থাকে ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর।
মোশাহিদা সুলতানা: প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
চিংড়ি চাষকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান নবম। একজন কৃষক ধান থেকে যা উপার্জন করতে পারেন, তার প্রায় ১০ গুণ উপার্জন করতে পারেন চিংড়ি থেকে। রপ্তানি বাজারে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় আশির দশক থেকে এটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রসার পায়। দক্ষিণাঞ্চলে বিপুল ধানি জমি চিংড়ি ঘেরে চলে যেতে থাকে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেককে বাধ্য হতে হয় ঘেরের আগ্রাসনে জমি দিতে। অনেককে জমি বিক্রি করে দিতে হয়।
কিন্তু যখন ইইউ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে আনন্দে ভাটা পড়ে। বিতর্কের কারণ চিংড়িতে ভাইরাসের আক্রমণ। লাভ কমে আসতে থাকে। কৃষকদের মধ্যে তৈরি হয় নানা প্রকার সংশয়। একদিকে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে লবণাক্ততার কারণে শাকসবজির চাষ যখন হুমকির সম্মুখীন হলে প্রান্তিক চাষিদের দুর্ভোগও বাড়ে। শুরু হয় পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বন্দ্ব। কৃষকদের একদল লোনাপানির পক্ষে, একদল মিষ্টিপানির পক্ষে। কিছু কিছু এলাকায় নিজেদের মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা দন্দ্বের সূত্র ধরে রক্তপাতও ঘটে। Environmental Justice-এর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এই দ্বন্দ্বে প্রায় ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং আহত হয় আরও হাজারজন।
প্রকৃতির মতোই রহস্যময় নদীর পথ চলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই দুর্বোধ্য ভূমি ও নদীর মধ্যে সম্পর্ক। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পোল্ডার নির্মাণ শুরু হয়। উদ্দেশ্য, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। হয়েছিলও তাই। হল্যান্ডের মডেলে নদী পরিবেষ্টিত নিম্নভূমিকে বন্যা এবং লবণাক্ততা থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে বাঁধ দিয়ে নদী থেকে আলাদা করা হয়। তৈরি হয় স্লুইসগেট, যার মাধ্যমে কৃষকেরা ইচ্ছামতো পানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন: শীত ও গ্রীষ্মে স্ল্লুইসগেট লবণাক্ত পানি ঢোকানোর জন্য এবং বর্ষার মৌসুমে বের করে দেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা যত সহজ ছিল, বাস্তবায়ন তা ছিল না। পোল্ডারের সুফলতা কমতে থাকে যখন স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন জায়গায় স্লুইসগেটগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, এই স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ করে কখন পানি ঢোকানো হবে এবং কখন বের করা হবে, তা নিয়ে সাধারণ কৃষক ও চিংড়িচাষিদের মধ্যে বিবাদ লাগে। চিংড়ির মুনাফা এই বিরোধিতাকে আরও উসকে দেয়। একপর্যায়ে শক্তিশালী ঘেরমালিকরা স্লুইসগেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে, যদিও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু জনবলের ঘাটতি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবে সময়মতো স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তারা। ফলাফল রাজনীতিকরণ। প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে একটি এককালীন বিরোধিতা থেকে চিরস্থায়ী বিরোধিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে প্রান্তিক চাষিরা, যাঁরা চিংড়ি চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান চাষে আগ্রহী হতে শুরু করে, তারা নানা রূপ বাধার সম্মুখীন হয়। কিছু কিছু এলাকায় প্রান্তিক চাষিদের প্রভাবশালী কৃষকদের কাছ থেকে সেচের পানি কিনতেও হয়েছে। এই বাণিজ্যিকীকরণের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ব্যর্থতার কারণে।
সমস্যার কারণ কেবল সরকারি অবহেলাই নয়, পরিকল্পনার ব্যর্থতাও দায়ী। বাংলাদেশের মতো ভিয়েতনাম, ইকুয়েডরসহ অন্য দেশগুলোতেও দেখা দেয় মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং অন্যান্য সামাজিক সমস্যা। পরিকল্পনাগুলো করেছিল কারা? বিশ্বব্যাংকের প্রেরণা ও সক্রিয়তায় চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে উন্নয়নশীল দেশগুলো। যুক্তিটা এই: চিংড়ি চাষে কর্মসংস্থান বাড়ে, বাড়ে কৃষকের আয়, বাড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এটা হয়েছিল রপ্তানিমুখী কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে। কিন্তু জানা থাকা সত্ত্বেও পরিণামে এর ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখা হয়েছে। কারণ তার ভুক্তভোগী ধনী কৃষক নন প্রান্তিক চাষি। তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কেউ চিন্তা করেনি, করেনি সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধি ও প্রকৃতির ওপর এর বিষফল নিয়েও। সবকিছু অর্থমূল্যে বিচার করার এই দৃষ্টিভঙ্গি বহু ক্ষেত্রেই এ রকম ক্ষতিকর ফল জন্ম দিয়েছে।
যে কৃষক আগে ধান চাষ করতেন, তিনি এখন বাধ্য হয়ে চিংড়ি চাষ করেন। বাজারমূল্যের থেকে বেশি দামে চাল কিনতে হয় তাঁকে, তাঁর উঠানে শাকসবজি হয় না, তাঁকে খাবার পানি কিনে আনতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে, তাঁর গোয়ালের গরুর খাবার নেই, গরু দুধ দেয় না, গাছে ফল হয় না। তবে কি শুধু চিংড়ি খেয়ে থাকবেন এই কৃষক? না। চিংড়িতেও ভাইরাস! যদিও অঞ্চল ও শ্রেণীভেদে এই দুর্ভোগ সমান নয়, তবু বুঝতে দেরি হয় না কে বেশি ভুক্তভোগী।
বিরোধিতা বাড়ছে আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা আরও প্রভাবশালী হচ্ছেন। যাঁর আগে জমি ছিল, যাঁর ঘরে সারা বছর ধান থাকে, যাঁর কিছু জমিতে ধানের চাষ হলে বাকি জমিতে অনায়াসে চিংড়ির চাষ হয়, সরকারের ভূমিবণ্টন আইনের আওতায় ভূমি বরাদ্দ পাচ্ছেন তাঁরাই। দুর্ভাগা প্রান্তিক চাষিদের পাশে দাঁড়াবে কে? দিন শেষে আইন একটি ব্যবসা, দিন শেষে মিথ্যা মামলা, ভোগান্তি মানে প্রভাবশালীর পায়ে গিয়ে পড়া। আর গ্রামে গ্রামে বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, প্রভাবশালীদের অনাচার।
এর শেষ কোথায়? সমুদ্রের লোনা জলে এর উৎপত্তি, চোখের পানিতে কী এর শেষ? আমরা চাই, আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড এই প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করুক। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যেন জলবায়ু পরিবর্তন এবং দারিদ্র্য নিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্র হয়ে না ওঠে। কৃষকেরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হোক। সরকার পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে পানিশাসনের অবকাঠামো তৈরি করুক। এবং এই অবকাঠামো পরিচালনার ভার যেন থাকে ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর।
মোশাহিদা সুলতানা: প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments