প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক-‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি: দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি’

গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি: দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো:


যাঁরা অংশ নিলেন
সুলতানা কামাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
গৌতম দেওয়ান
সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি
স্বপন আদনান
সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন
মণিস্বপন দেওয়ান
সাবেক উপমন্ত্রী
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়
অধ্যাপক আমেনা মহসীন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শক্তিপদ ত্রিপুরা
সাংগঠনিক সম্পাদক, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও সভাপতি, খাগড়াছড়ি হেডম্যান সমিতি এবং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান
সুধাসিন্ধু খীসা
কো-চেয়ারম্যান
জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)
সঞ্জীব দ্রং
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
মো. জাহাঙ্গীর কামাল
সাধারণ সম্পাদক
পাবর্ত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলন
বিনায়ক সেন
গবেষণা, পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)
ইলিরা দেওয়ান
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, হিল উইমেনস ফেডারেশন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনে কর্মরত
মতিউর রহমান
সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
মতিউর রহমান
পার্বত্য শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন—এটি একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর বাস্তবায়ন জরুরি। এরই মধ্যে প্রথম আলো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত চার দিনের ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করেছে। সরকার বারবার বলছে, তারা এ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে চায়। তারা বিভিন্ন শক্তিশালী কমিটিও গঠন করেছে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের এক যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। তাই জনমত গড়ে তোলার জন্য এবং সমাজের সব মহলের মধ্যে এই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরতে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। যেন সরকারকে এ বিষয়ে সজাগ করা যায়—বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ, যারা এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ চায়, তাদের সহায়তা করা যায়। আমরা সবাইকে নিয়ে এই আলোচনা করতে চেয়েছি।
এই অনুষ্ঠানে পার্বত্যচট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার এবংখাগড়াছড়ির সাংসদ ও শরণার্থী পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা অংশ নিতে আগ্রহের সঙ্গে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ ব্যস্ততার জন্য তাঁরা আসতে পারেননি।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পরের বছর রাঙামাটিতে বিশাল জনসমাবেশ হয়েছিল। সেখানে আমরা দেখেছিলাম, চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মাথায় সেখানকার জনগণের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হতাশার ছায়া। পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগের আমলে চুক্তি বাস্তবায়নে কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু বড়ো অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার গঠনের পর তারা চুক্তিটি বাতিল করে দেয়নি, কিন্তু তাদের সময় চুক্তি বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছিল চুক্তি বাস্তবায়নে।
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে পূর্ণাঙ্গরূপে চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল। সরকার গঠন করার পর তারা শক্তিশালী কমিটি গঠনও করেছে, চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলছে। যদিও এখন পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বর্তমান সরকার টাস্কফোর্স গঠন, ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু সেই আদিবাসী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য তেমন কোনো বড় উদ্যোগ আমরা দেখিনি।
ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির আগেই ভূমি জরিপের বিষয়ে কমিশনের অবস্থান ও বক্তব্য নিয়ে বর্তমানে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তাঁরা বলেছেন, পাবর্ত্য চুক্তি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমার মতে, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে যদি ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার আসে, তারা পাবর্ত্য চুক্তি বাতিল করতে পারবে না। অন্যদিকে ভূমি কমিশনকে কার্যকর করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে মতৈক্যে পৌঁছানো গেছে।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপি; তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে পার্বত্য অঞ্চলে।
পরিশেষে বলব, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। আমাদের সবার আশা, একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ—আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে চুক্তিটির বাস্তবায়ন এই পার্বত্য অঞ্চলে অতি জরুরি। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আশা যে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছিল ১৯৯৭ সালে, তারা তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট উদ্যোগী হবে। যেহেতু এটি মহাজোটের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল, তাই তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা উচিত। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য চুক্তিটি যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।
আলোচনার শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে অনুরোধ করব চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাগুলো কী এবং তা সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া উচিত, সে বিষয়ে বলার জন্য।

সুলতানা কামাল
আমরা জানি, প্রথম আলোয় প্রকাশিত ধারাবাহিক সংবাদটির বক্তব্য ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে। এ বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আজকের বৈঠকের আলোচকদের আলোচনার মাধ্যমে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটগুলো কী কী এবং এসব সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া জরুরি, সে বিষয়গুলো উঠে আসবে—পার্বত্য চট্টগ্রাম যে অশান্ত হয়ে উঠছে, তা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়।
পাশাপাশি শান্তির পথে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যাবে, সে বিষয়গুলো বিষদভাবে তুলে ধরা উচিত। আজকের আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে। চুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার কিংবা চুক্তির কিছু বিষয় সংশোধন করা বা বর্তমান প্রেক্ষাপটে চুক্তির কোন অংশগুলোর পরিবর্তন আনতে হবে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও সব শ্রেণীর মানুষের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা উচিত।

আব্দুল কাইয়ুম
আজকের আলোচনার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক—উভয় দিকেই গুরুত্ব রয়েছে। কারণ যখন কোনো সরকার এ ধরনের কোনো চুক্তি করে, তখন সেটি কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সরকারের একার বিষয় থাকে না। সে চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেশের সব সরকারের ওপর বর্তায়। সেই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত না হয়, তখন সেটি দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি করে। আমরা চাই, পার্বত্য চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা হোক।
অনেকে বলেন, চুক্তিটির মধ্যে অসামঞ্জস্য রয়েছে। কিংবা বর্তমান প্রেক্ষাপটে চুক্তিটির ত্রুটি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অতি দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এই পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

গৌতম দেওয়ান
সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের সবার কাছে মনে হচ্ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অগ্রাধিকার তালিকার মধ্যে নেই। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। বিভিন্ন গণমাধ্যমের পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, সুশীল সমাজ—সবার সহযোগিতা যদি আমরা পাই অর্থাৎ যদি একটি জনমত সৃষ্টি করতে পারি, তবে সরকারের কাছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় তুলে আনা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আজকের এই গোলটেবিল বৈঠক সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাজ করবে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কিন্তু কেন হচ্ছে না, সে বিষয়গুলো আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি না কিংবা প্রকৃত কারণ জানার স্বল্পতা রয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির একটি প্রস্তাবনার মধ্যে চারটি খণ্ড রয়েছে। সেখানে মৌলিক যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে একটি আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা। এটির বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য চুক্তির মধ্যে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল—পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। তিনটি জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি নিয়ে বিশেষ শাসিত অঞ্চল গঠন করা হবে। পাশাপাশি সেখানে অভ্যন্তরীণ ও ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন করা যেসব শরণার্থী আছে, তাদের পুনর্বাসন করা হবে—সেখানে যারা ভূমিহীন হয়েছে কিংবা ভূমি হারিয়েছে, যাতে তারা তাদের ভূমি ফিরে পায়। তাদের ভূমিবিরোধ-সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। ভূমি কমিশন এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেবে।
আঞ্চলিক পরিষদ ওই সব জেলার মধ্যে যেসব বিভাগ রয়েছে, সেগুলোর সমন্বয়, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবে। আঞ্চলিক পরিষদের কার্যপ্রণালি বিধি প্রণয়ন, জেলা পরিষদ আইন সংশোধন ও কার্যপ্রণালি বিধি প্রণয়ন, স্থানীয় ৩৩টি বিভাগের ৬৮টির কাজ জেলা পরিষদের হাতে হস্তান্তরের মতো সাধারণ বিষয়গুলো বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে। সরকার চুক্তির পর এ অঞ্চলকে আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল বললেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন ঘটছে না। আমরা আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল বলতে বোঝাই, এখানে যেসব আদিবাসী আছে, তারা যেন তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-স্বকীয়তা নিয়ে থাকতে পারে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি বরং নিরাপত্তাহীনতা, সমতল থেকে বাঙালি প্রতিস্থাপন, ভূমি হারানো, ভূমি জবরদখল—এ বিষয়গুলো বন্ধ হয়নি।
জনসংখ্যার অনুপাতের জরিপে ১৯৪৭ সালে পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি ছিল ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর বাঙালি ছিল আড়াই শতাংশ। ১৯৯৭ সালে চুক্তির সময় পাহাড়ি ছিল ৫৫ শতাংশ ও বাঙালি ছিল ৪৫ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে জনসংখ্যার অনুপাত হচ্ছে পাহাড়ি ৫১ শতাংশ আর বাঙালি ৪৯ শতাংশ। পাহাড়ি অঞ্চলে দিন দিন বাঙালি অনুপাতিক হারে বাড়ছে। ফলে আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা ও স্বকীয়তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
চুক্তিমতে, ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হলেও আঞ্চলিক পরিষদের কার্যপ্রণালি বিধি চুক্তির এক যুগ পার হলেও এখনো গঠন করা হয়নি। ২০০০ সালে অঞ্চলিক পরিষদ থেকে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল যে কার্যপ্রণালি বিধি কী হবে? কথা ছিল সরকার এ-সম্পর্কিত পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে ফেরত পাঠাবে, কিন্তু এখনো তা করা হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল, তা কোনো ধরনের ভূমিকাই পালন করতে পারছে না।
স্থানীয় সরকার পরিষদ, যেটি ১৯৮৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল, সেটির সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু জেলা পরিষদ দাবি করছে, আইনে আঞ্চলিক পরিষদের কথা উল্লেখ নেই। তাই আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ের দায়বদ্ধতা তাদের নেই। ১৯৯৮ সালে আইনের ১৬(ক) ধারা সংযোজন করে জেলা পরিষদের যে মূল কাঠামো ছিল, তাতে পরিবর্তন এনে অন্তর্বর্তীকালীন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। দেখা গেছে, যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের নির্বাচিত ব্যক্তিরাই সেই পরিষদের সদস্য হচ্ছেন। দলের মনোনীত হন বলে তাঁরা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। ফলে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের মধ্যে কোনো সমন্বয় হচ্ছে না। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বারবার বৈঠক ডাকার পরও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা সেসব বৈঠকে উপস্থিত হননি।
সরকারের পক্ষ থেকে যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি, তাই আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে না। জেলা পরিষদগুলোতে পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ২০ বছর হয়ে গেছে পরিষদগুলোতে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। জেলা পরিষদগুলো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে যে ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, তাও সম্ভব হচ্ছে না।
যারা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থী আছেন, তাঁদের ভূমি-সমস্যা সমাধানের জন্য সম্প্রতি চতুর্থবারের মতো টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কার্যপরিচালনার বিধি এখনো তৈরি করা হয়নি। টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান নিয়োগ সবই হয়েছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। পাশাপাশি ভূমি কমিশন গঠন করে ২০০১ সালে ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হয়েছে। চুক্তিমতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে যেকোনো আইন করতে হলে আঞ্চলিক পরিষদগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কিন্তু কোনো আলোচনা ছাড়াই তাড়াহুড়া করে যে আইনটি করা হয়, তা চুক্তির সঙ্গে ১৯টি বিষয়ে সাংঘর্ষিক।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিষয়গুলো উঠে আসায় ২২ তারিখে এক বৈঠকে আলোচনায় মূল যে বিষয়গুলো চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো পরিবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। আর যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির সব বিষয় বাস্তবায়ন করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
সম্প্রতি কমিশনের ভূমি জরিপ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভূমি কমিশন গঠনের ছয় মাসের মধ্যে কমিশনের বিধিমালা প্রস্তুত করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভূমি জরিপ আগে হবে, না পরে হবে, সে বিষয়ে ভূমি কমিশনার তাঁর একক মন্তব্য পেশ করছেন, যা পাহাড়ি জনগণের মধ্যে আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করছে।

আব্দুল কাইয়ুম
পার্বত্য অঞ্চলে লক্ষাধিক পরিবার এখনো উদ্বাস্তু। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আছে পাহাড়িরা। তাদের সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা প্রয়োজন। আলোচনার এ পর্যায়ে জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও খাগড়াছড়ি হেডম্যান সমিতির সভাপতি শক্তিপদ ত্রিপুরাকে অনুরোধ করছি বলার জন্য।

শক্তিপদ ত্রিপুরা
পাবর্ত্য চট্টগ্রামের যে রাজনৈতিক সমস্যা, তা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তি সম্পাদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। পাশাপাশি চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছি। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী অঙ্গীকারে চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। সরকার গঠনের পর তারা বারবার বলেছে, চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে। বর্তমান সরকারের মেয়াদ দুই বছরের কাছাকাছি। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যেমন—টাস্কফোর্স গঠন, ভূমি কমিশন গঠন, কিছু সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।
আজকের আলোচনায় দুটি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাগুলো কী কী এবং দ্বিতীয়ত কীভাবে চুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে, বর্তমান সময়ে সরকারের কর্মকাণ্ডের যে অগ্রাধিকার তালিকা রয়েছে, এর মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি নেই। যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন। এ মুহূর্তে পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নয়। যেমন—যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে, তেমনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। সরকারের বিশেষ অংশ বা আমলারা চাইছেন না, পাবর্ত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হোক অতিদ্রুত। তাঁরা সরকারকে বাধাগ্রস্ত করছেন চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।
সরকারের চুক্তি বাস্তবায়নে অনীহার পাশাপাশি চুক্তিবিরোধার্থক কিছু কার্যক্রম আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন—ভূমি কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকা পালন। চুক্তিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, ভূমি জরিপ কীভাবে করা হবে। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, শরণার্থী ও অন্যান্য যে ভূমিবিরোধ রয়েছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করার পরই সরকারের আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভূমি জরিপ করার কথা। কিন্তু ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পরই ভূমি জরিপের ঘোষণা দিলেন। এ ধরনের কমিশনের কর্মকর্তা ও আমলাদের চুক্তিবিরোধী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছিল। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বারবার আমরা দেখছি, মন্ত্রণালয় চুক্তিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চুক্তিমতে, আদিবাসীদের ও অগ্রজ বাসিন্দাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষেত্রেও চূড়ান্তভাবে স্থানীয় সরকারপ্রধানদের থাকার কথা। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পাশাপাশি স্থানীয় সরকারপ্রধান এই সার্টিফিকেট দেবেন। সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে এও বলা হচ্ছে, আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, উপজাতি শব্দ ব্যবহার করতে হবে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের চুক্তিবিরোধী কার্যক্রম আমরা দেখতে পাই।
কীভাবে চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, সে বিষয়ে কিছু প্রস্তাব দিতে চাই। প্রথমেই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। সরকারের কার্যক্রমের তালিকায় চুক্তির বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রণী বা মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের দেশে কোনো সমস্যারই সমাধান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া হয় না। তাই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা কামনা করছি পাবর্ত্য চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য। চুক্তিমতে, ভূমি কমিশনের আইন সংশোধন করতে হবে, পরবর্তীকালে ভূমি জরিপ করতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য আঞ্চলিক কাউন্সিল করতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য আঞ্চলিক কাউন্সিলকে তাদের ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের ৩৩টি বিভাগের দায়িত্ব তাদের হাতে হস্তান্তর করতে হবে।
আঞ্চলিক পরিষদের বিধিমালা প্রণয়ন করা দরকার। অস্থায়ী সেনাক্যাম্পাসগুলো প্রত্যাহার করতে হবে। এসব কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সরকারকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে সরকারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়ালকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষাগত অধিকারের যে দাবি উঠেছে, তা বাস্তবায়নে সরকারের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

আব্দুল কাইয়ুম
আদিবাসীদের জীবন ও তাদের সমস্যা সমাধানে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়ে এখন বলবেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।

সঞ্জীব দ্রং
সময় আসলে বয়ে যায়। আমরা অপেক্ষা করছি, কখন পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হবে। আদিবাসী পাহাড়ি মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনা চির অবসান করার অঙ্গীকার করেছিলেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে। প্রশ্ন, সময় চলে যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের তেমন কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। সরকার যদি চিন্তা করে, শুধু মুখে বাস্তবায়নের কথা বলে কালক্ষেপণ করবে, সময় পার করবে; বোকা আদিবাসী পাহাড়ি মানুষ শুধু তাদের অধিকারের কথা বলেই যাবে, আর তাদের আশা দিয়ে যাবে। সরকার সময় অতিবাহিত করবে। আবার আদিবাসীদের মধ্যে যেমন পাহাড়ি আদিবাসী ও সমতলের মধ্যে নতুন কিছু সমস্যা ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করবে। নির্দিষ্ট একটা সময় পার হওয়ার পর চুক্তি বাস্তবায়ন করার আর প্রয়োজন হবে না। এ রকম মনোভাব যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো চিন্তা করে থাকে, তবে এর চেয়ে বড় ভুল আর হবে না।
চুক্তির ১২ বছর পার হয়ে গেছে। এভাবে আরও অনেক দিন পার হবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। সরকার যদি ভাবে যে আদিবাসীদের ঠকাবে, প্রকৃত অর্থে সরকার নিজেই ঠকবে, নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতারণা করবে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে জনসংহতি সমিতিসহ আরও যেসব পাহাড়ি সংগঠন রয়েছে, তাদের নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা জরুরি। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে যুদ্ধাবস্থায় পাহাড়িদের হেলিকপ্টারে করে শহরে নিয়ে এসে ১৯-২০ বার বৈঠক করেছিল সরকার। তাহলে বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলোচনার উদ্যোগ নিতে কেন সরকার বিলম্ব করছে। জনগণ ও নাগরিক সমাজকে সচেতন হতে হবে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য।
পার্বত্য অঞ্চলের পাঁচজন সাংসদের মধ্যে যে তিনজন নির্বাচিত সাংসদ আছেন, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে সরকারকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য। আদিবাসীদের অধিকার তুলে ধরতে হবে সরকারের কাছে। সাংসদদের সুশীল সমাজ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মতৈক্য গড়ে তুলতে হবে।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, কিন্তু নতুন নতুন প্রকল্প সেখানে দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব রয়েছে। আমরা পাহাড়িরা নিশ্চয়ই সেটি চাই। কিন্তু এখন নয়। কারণ, পাহাড়ির মানুষ এখনো তৈরি হয়নি এ ধরনের বড় প্রকল্প গ্রহণের জন্য। আমরা জানি উন্নয়ন ভালো, কিন্তু এতে অনেক সময় মানুষের ক্ষতিও হয়। আপনাদের উন্নয়নের নামে আরেক অংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কাপ্তাই বাঁধের ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। পাহাড়ি মানুষের ও আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা না করেই নতুন নতুন প্রকল্প দেওয়া হচ্ছে। তা উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এতে পাহাড়িরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না, অন্যদিকে সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে। ব্রিটিশ আমল থেকে ঔপনিবেশিক সরকারের মতো যদি বর্তমান সরকারগুলো আচরণ করে, আমি মনে করি, সরকারের সাংঘাতিক ভুল হবে। আমার মতামত হচ্ছে, সরকারের মধ্যে একটি আত্মতুষ্টি ও আত্মঅহংকার চলে এসেছে, ভবিষ্যতে এই সরকারের মনোভাব হয়তো পরিবর্তন হবে না। বর্তমান সরকারের দুই বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও এখন পর্যন্ত জনসংহতি সমিতির সভাপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কোনো বৈঠক হয়নি। চুক্তি করার সময় দুই পক্ষের চমৎকার যে সম্পর্ক ছিল, তা অনেকটা ম্লান হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যেহেতু তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছেন, এর বাস্তবায়নও করবেন। আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখতে চাই। আশা করি, তিনি তাঁর কথার প্রতিফলন ঘটাবেন দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

আব্দুল কাইয়ুম
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের নেতাদের বৈঠক অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো কী, তা চিহ্নিত করে সমাধানে দুই পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তবিক সমস্যাগুলো কী কী, সে বিষয়ে বলবেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপমন্ত্রী মণিস্বপন দেওয়ান।

মণিস্বপন দেওয়ান
আমি বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। তাই আমার মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আমি যখন উপমন্ত্রী ছিলাম, তখন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আমি কী করতে পেরেছি, তা আপনারা জানেন। বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, সেখানে যেহেতু পার্বত্য চুক্তিটি আওয়ামী লীগ করেছিল, তাই পরবর্তী সময়ে বিএনপি তার বিরোধিতা করেছিল। আমি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে টিকিয়ে রেখেছিলাম।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শুধু পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়িদের সমস্যা নয়, এটি গোটা বাংলাদেশের সমস্যা। এ সমস্যা যদি এখনই দ্রুত সমাধান করা না হয়, তবে যতটা না পাহাড়িরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার চেয়ে বেশি গ্রতিগ্রস্ত হবে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সব মানুষ। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সবকিছুই খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির একটি আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঝড় ইত্যাদির কারণে অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন হচ্ছে, যার দরুন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলাফল হিসেবে ইরাকে হামলা, আফগানিস্তানে যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় আমরা দেখেছি। তবে আজকে চীন, আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অত্যন্ত হুমকির মধ্যে রয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদগুলো কিন্তু সমতলে ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রাকৃতিক সম্পদগুলো চলে আসছে গভীর সমুদ্র ও পাহাড়ি অঞ্চলে। সুতরাং এই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলো বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর গভীর সমুদ্র ও পাহাড়ি অঞ্চল লক্ষ করে এশিয়ান হাইওয়ের মতো বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আসছে।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি প্রবেশ করবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য। সরকারের এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যদি এখনই সমাধান করা না হয়, এ সমস্যাগুলো রেখে দেওয়া হয়, তবে পরাশক্তিগুলোর ‘লুক ইস্ট’ পলিসির অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ আকারে দেখা দেবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ কিন্তু অতি দ্রুত এসব ভূমিজনিত আদিবাসী সমস্যাগুলো সমাধান করছে। বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চলে অনারোহিত প্রাকৃতিক সম্পদকে আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে যোগ করতে চাই, তবে যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। সময় যত দীর্ঘায়িত হবে, তত বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
বর্তমানে জনসংহতি সমিতি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যত সময় যাবে, তত দলগুলোর বিভক্তির পরিমাণ বাড়বে এবং আলোচনার টেবিলে সমঝোতার জন্য তাদের আনা কঠিন হয়ে যাবে। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা জিইয়ে রেখে বাঙালি কিংবা পাহাড়িরা কেউই লাভবান হচ্ছে না। ১৯৭৯-৮০ সালে বাঙালিদের নিয়ে পাহাড়ে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়িদের দুর্বল করা এবং তাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পর বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলের যে দ্বন্দ্ব চলছে, তাতে সন্দেহ থেকে যায় সন্ত্রাসী দল জাগ্রত হওয়ার। যদি ধরা যাক, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি দলগুলো দুর্বল হয়ে গেলে এবং মুসলিম বাঙালির সংখ্যা যদি অত্যধিক বেড়ে যায় এবং পাহাড়ি জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণক্যাম্পের অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। যদি পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে গড়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের উভয়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দেবে, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর আক্রমণের শিকার হতে পারে। সুতরাং কোনো আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম না হয়, সে জন্য এ মুহূর্তে সরকারকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
পার্বত্য সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি আঞ্চলিক নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে। দল-মতনির্বিশেষে সবার মতৈক্যই পারে পার্বত্য সমস্যা সমাধানে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে।

আব্দুল কাইয়ুম
গণতন্ত্রের উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর করে জাতীয় স্বার্থে মতৈক্যের ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের সদস্য স্বপন আদনানকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

স্বপন আদনান
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় আইন বা বিধান প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেনি এখনো। এতে চুক্তির মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্থাপিত হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারছে না। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব দেখা গেছে বিগত দিনে। দেশে প্রচলিত আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা হচ্ছে না। যেমন—জেলা পরিষদ আইনের ৬৪ ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি হস্তান্তর করা যাবে না কোনোভাবেই জেলা পরিষদের সম্মতি ছাড়া। এ বিধানটি কাগজে-কলমে থাকলেও এটি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে নানাভাবে। পুরো বিষয়টি ডিসি অফিস কর্তৃক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। সর্বশেষে ফাইলটি জেলা পরিষদে পাঠানো হচ্ছে। ফলে জেলা পরিষদের সম্মতি থাক বা না থাক কাজগুলো সম্পন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে অনেকটা গায়ের জোরে জমিজমা হস্তান্তর হয়ে যাচ্ছে আইন থাকা সত্ত্বেও।
চুক্তি অনুযায়ী, পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের যেসব আইন করার কথা, সেগুলো করতে হলে আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমরা ভূমি কমিশনের আইন ও সমস্যাগুলো দেখলে বুঝতে পারি, সরকার আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আইনগুলো করছে। চুক্তি বাস্তবায়িত হোক বা না হোক প্রতিনিয়ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। যেসব কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত হয়েছিল। যেমন—জাতিগত সংঘাত, বিদ্রোহী দমন, ভূ-প্রক্রিয়া ইত্যাদি কিন্তু চুক্তির পরও অব্যাহত রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে বাইরে থেকে লোক অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি, পাহাড়িদের ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত ভূমি, জোর-দখল করা কিন্তু চলছে বেআইনিভাবে। ফলে সমস্যাগুলো বেড়েই চলছে।
বর্তমানে বাঙালি ভূমিদস্যুরা পার্বত্য অঞ্চলে শুধু পাহাড়িদের নয়, বাঙালিদের জমিও দখল করছে। ফলে ভূমিবণ্টনে একটি বৈষম্য দেখা দিচ্ছে। এটি অনবরত চলতে থাকলে তার ওপর একটি সামাজিক, রাজনৈতিক প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। যে প্রক্রিয়াগুলোর কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, সে প্রক্রিয়াগুলো অব্যাহত থাকার ফলে এ সমস্যাগুলো আরও সংকটময় করে তুলছে বর্তমান পরিস্থিতিকে। কোনো বাঙালি সরকারপ্রধানই পাহাড়িদের জমিগুলো দখলকারী বাঙালিদের কাছ থেকে তাদের ফিরিয়ে দিতে যাবে না। কারণ, যদি তারা তা করতে চায়, তবে পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালিসহ বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে সংকীর্ণ একটি গণ্ডি আছে, তাদের সমর্থন কিন্তু সে সরকার হারাবে। সেই সৎসাহস আমাদের রাজনীতিবিদদের আছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। আমার মতে, এটিই মূল বাধা হিসেবে কাজ করছে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য।
চুক্তির বাইরে বিশ্বের সমাজ, রাজনীতি যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এতে ক্রমেই এ চুক্তিটি অবান্তর ও অপ্রযোজ্য হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে। চুক্তির চেয়েও গভীর কিছু বিষয় ও অন্তরায় আছে, সেদিকে নজর দেওয়া খুব জরুরি। কিন্তু এ ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ নেই। কিছুদিন আগে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, তাঁদের স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। যদি এর প্রস্তাবগুলো সত্যিই বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে সমস্যা বাড়বে। শান্তিচুক্তিতে বলা হয়েছে, অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হবে। সেখানে এটি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য অঞ্চলে আবারও সেনা কর্তৃত্ব প্রতিস্থাপিত হবে।
ভূমি কমিশন বর্তমানে পাহাড়িদের নোটিশ দিচ্ছে। একতরফাভাবে তারা ভূমিবিরোধ মামলার নিষ্পত্তি করবে। এতে পাহাড়িদের জমি যারা দখল করেছে, তারাই শেষে আইনি কাগজ নিজেদের পক্ষে পেয়ে যাবে। এতে পার্বত্য চুক্তির বিরোধার্থক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বর্তমানে ভূমি কমিশন।
সবশেষে বলতে চাই, সরকার আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সংশোধনের প্রেক্ষাপটও তৈরি করতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে গভীর ভাবনা ও অব্যাহত আলোচনার প্রয়োজন। পার্বত্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কার্যত স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অবকাঠামোর উন্নয়ন দরকার। পার্বত্য অঞ্চলে সংঘর্ষ চলতে থাকলে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে কোনো প্রকার লাভ হবে না।

আব্দুল কাইয়ুম
পার্বত্য অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। যেসব বাঙালি অধিবাসী দীর্ঘদিন ধরে সেখানে আছে, তাদেরও সমস্যা রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির ১২ বছর পর এখন সেখানে অনেকটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলেও মাঝেমধ্যে সংঘাত দেখা যায়। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ও বাঙালিদের কী ভূমিকা পালন করা উচিত, সে বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কামালকে বলতে অনুরোধ করছি।

মো. জাহাঙ্গীর কামাল
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে প্রয়োজন স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিয়ে আরও অনেক আলোচনার আয়োজন করা। শুধু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সংঘাত-সংঘর্ষ দিয়ে কখনো সম্ভব নয়। বিভিন্ন আলোচনায় আমাদের সংগঠনের পক্ষে থেকে বলেছি, শান্তিচুক্তিটি আমরা মেনে নেব, যদি চুক্তির কিছু সাংঘর্ষিক ধারার পরিবর্তন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণ করে বাস্তবায়ন করা হয়। চুক্তির সুফল আদায়ের জন্য এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা ও কর্মকর্তারা দু-এক দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যাগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন না। পার্বত্য অঞ্চলে ২৫টি উপজেলা রয়েছে, যা বাংলাদেশের আয়তনের ১০ ভাগের এক ভাগ। সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী যে অতিকষ্টে জীবন যাপন করছে, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারছেন না। কিন্তু তাঁরা সেখানে সফরে গিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আসছেন। বাস্তবতার প্রেক্ষাপট কিন্তু অনেক ভিন্ন।
বাঙালিরা যে পাহাড়িদের জমি দখল করছে, এ অভিযোগ সত্য নয়। আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে এসব কাদা ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে এবং রাষ্ট্র পরিচালিত সেনাবাহিনী, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদের মতো সংস্থাগুলো অভ্যন্তরীণ কাদা ছোড়াছুড়ির ফলে এসব সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বাস্তবিক পক্ষে সাধারণ পাহাড়ি উপজাতি ও বাঙালির কেউই আসলে প্রকৃত অর্থে লাভবান হচ্ছে না।
সঞ্জিব দ্রং বলছেন, এই মুহূর্তে পাহাড়িদের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ আমি দেখেছি, অনেক পাহাড়ি উপজাতি আছেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পর কর্মসংস্থানের অভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন না। কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন না। এসব কারণে তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। কর্মসংস্থানের অভাবে তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন। কারণ, সেখানে কোনো শিল্প-কারখানা কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় আঞ্চলিক নেতারা আছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারা শুধু পাহাড়িদের নেতা নন। আপনারা পার্বত্য অঞ্চলের সব ছোট জাতিগোষ্ঠী ও পাহাড়ি বাঙালিদেরও নেতা। আপনাদের পার্বত্য অঞ্চলের সবার দায়দায়িত্ব নিতে হবে, তাদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পার্বত্য তরুণ সমাজ হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে শুধু কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে। তাই পার্বত্য অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে পাহাড়ি, বাঙালিসহ সক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী একত্র হয়ে মতৈক্য গড়ে সরকারের কাছে নিজের অধিকার তুলে ধরে তা আদায়ের জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
পার্বত্য অঞ্চলের জেলা পরিষদের নির্বাচনের আয়োজন করার মাধ্যমে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৯২ সালের পর থেকে জেলা পরিষদের কোনো নির্বাচন হয়নি। বর্তমানে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিরা জেলা পরিষদ পরিচালনা করছে, তাদের জবাবদিহি বলে কিছু নেই। জেলা পরিষদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সবার। ভূমি কমিশনের বিতর্কিত কার্যক্রমের ব্যাপারে সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক আমেনা মহসীনকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

আমেনা মহসীন
আমি খুব খুশি হতাম, যদি চুক্তিতে উল্লেখ থাকত, পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু চুক্তিতে কৌশলগতভাবে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় এলাকা। যদি আদিবাসী কথাটি চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকত, তবে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ সরাসরি ভূমি অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার পেয়ে যেত। সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। আদিবাসী শব্দটি যেন ব্যবহার না করা হয়। পাহাড়ি আদিবাসীদের একটি দাবি ছিল যে তারা একটি আলাদা জাতি। তখন তারা জুম্ম জাতি হিসেবে পরিচিতি পেতে চেয়েছিল। তখন এ ধরনের একটি বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছিল যে বাংলাদেশে একটি জাতি আছে এবং কিছু উপজাতি আছে। চুক্তিতে আদিবাসী ও উপজাতির বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত ছিল। প্রথমত, চুক্তিটি করার পর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ চুক্তিতে কাঠামোগত কিছু সমস্যা আছে। যেমন—চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়ালের একটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। আবার যদি এটির সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে চুক্তি-পরবর্তী যেসব প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ, এগুলোর কাঠামোগত গঠন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। সিএইচটি ম্যানুয়ালে ডিসিকে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদি ম্যানুয়াল ও চুক্তিটির সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে অবশ্যই সাংঘর্ষিক কিছু বিষয়ে আগে সংশোধনী আনতে হবে। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের সমস্যা বিষয়ে চুক্তিতে কোনো উল্লেখই নেই। তাই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অবশ্যই পাহাড়ি বাঙালিদের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে সমাধান করতে হবে। পাহাড়িদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে হলে অবশ্যই আগে চুক্তিটির সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো সংশোধন করতে হবে। তা না হলে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলেও চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও সেটি সব সময়ই রাখা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে, আগে যেমন ছিল বিশেষ কার্যাদি বিভাগ। অর্থাৎ গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রণালয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু আমরা সব সময়ই দেখেছি, এটি সরকারের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে প্রচণ্ড সংকটপূর্ণ অবস্থায় আছে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জেএসএস, ইউপিডিএফসহ সব সংগঠন বহুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যা চুক্তি বাস্তবায়নে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। আমাদের জাতীয় বড় দুটি রাজনৈতিক দল একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে। তেমনি পার্বত্য অঞ্চলে জেএসএস ও ইউপিডিএফ একে অপরকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলছে। পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজি ও জমি দখল অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে।
এনজিওগুলো সম্পর্কে পাহাড়িদের বিরূপ মনোভাব রয়ে গেছে। অথচ তারা পাহাড়ি এলাকার উন্নয়নের বিরুদ্ধে নয়। তাদের আশঙ্কা, উন্নয়নের নামে বাইরে থেকে আরও লোক সেখানে আনা হবে। উন্নয়নের নামে পাহাড়িরা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে—এই ভয় থেকে তারা উন্নয়নের বিরোধিতা করছে। এ ছাড়া পাহাড়িদের নিরাপত্তার প্রশ্নে সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠন করার। প্রত্রিকায় এ সংবাদ বেরিয়েছে। এটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে পার্বত্য অঞ্চল পুনরায় সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বে চলে আসবে। একদিকে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে, অন্যদিকে সেনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। আমাদের দেশের একটি অঞ্চলকে পেছনে রেখে জাতীয় কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ পার্বত্য অঞ্চলও বাংলাদেশের অংশ। তাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
পার্বত্য চুক্তির আগের সময় সেখানে যে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ হয়েছিল, সে বিষয়গুলো চুক্তিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই চুক্তিতে। পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পাহাড়িদের নিরাপত্তার জন্য একটি ‘মাল্টি এথনিক কমিউনিটি পলিসি’র প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। সবার সমন্বিত যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে পাহাড়ি ও বাঙালিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে পার্বত্য অঞ্চলে।

আব্দুল কাইয়ুম
আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেসব রক্ষার জন্য কী করা উচিত, সে বিষয়ে হিল উইমেনস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিরা দেওয়ানকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

ইলিরা দেওয়ান
বর্তমান সরকার নির্বাচনী অঙ্গীকারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে পাহাড়িদের যে আস্থা অর্জন করেছিল, বর্তমানে সে আস্থায় চিড় ধরেছে সরকারের উদ্যোগহীনতার কারণে। বর্তমান সরকার যে চুক্তি সম্পাদন করেছিল ১৯৯৭ সালে, সে চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমে আবার পাহাড়িদের আস্থা অর্জন করতে হবে সরকারকে। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা অর্থাৎ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা যাঁরা আছেন, তাঁদের নিরপেক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুলিশ বিভাগে যেমন কার্যক্রম শুরু করেছে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা উদ্যোগ নিতে পারেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য।
কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে ঘোষণা দিয়ে এসেছেন, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে ও চাঁদাবাজি রোধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। আমি মনে করি, পাহাড়ি জনগণ কখনো সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজিকে প্রশ্রয় দেয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি রোধের প্রশ্ন কেন? বিভিন্ন যে জঙ্গিঘাঁটি ও জঙ্গি তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাদের নির্মূলে অভিযান পরিচালনার কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় না কেন? এ ছাড়া জঙ্গিনেতা যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁরা রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। তাহলে এসব জঙ্গি দমনে পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
পার্বত্য অঞ্চলের নারীদের প্রতি সংঘাতময় যে আচরণ করা হয়েছিল তা এখনো চলছে, তা বন্ধে পার্বত্য অঞ্চলে নারী প্রতিনিধিত্ব অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে সংবিধানের যে সংশোধনীর প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে পাহাড়ি নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।
সবশেষে বলতে চাই, প্রথমে পাহাড়িদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, পরবর্তী সময়ে তাদের সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের সব রাজনৈতিক দল বর্তমানে চুক্তির বাস্তবায়ন চাইছে। এখন শুধু সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাই পারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে।

সুধাসিন্ধু খীসা
পার্বত্য চুক্তি এখনই যদি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা হলেও অনেক সময় লাগবে। আর চুক্তিটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে তো আরও সময়ের প্রয়োজন। অসুখের চিকিৎসা জরুরি, কিন্তু অসুধ অনেক দূরে, ছয় মাস লাগবে তা আনতে! পার্বত্য চুক্তির আজকের দিনে বয়স ১২ বছর সাত মাস ২৮ দিন।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে, তবু সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না চুক্তি বাস্তবায়নে। চুক্তি মোতাবেক আজও ভূমি কমিশন আইন তৈরি করা হয়নি। যদি চুক্তি মোতাবেক ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি আইন তৈরি না করে ভূমি কমিশন কার্যক্রম শুরু করে, তবে তা চুক্তিবিরোধী হওয়াই স্বাভাবিক। বর্তমানে সরকার ভূমিবিরোধ-সম্পর্কিত যে সংশোধনীর উাদ্যোগ নিয়েছে, তাতে আমি আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ, তারা জলে ভাসা জমির বিষয়ে এখনো মতৈক্যে পৌঁছায়নি। এ জমিগুলো হচ্ছে কাপ্তাই বাঁধে যেসব জমি শীতকালে পানি কমে গেলে ভেসে ওঠে, সেগুলো। পাহাড়িরা সেসব নিচু জমিতে চাষ করে থাকে। এ জমিগুলো সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। তাহলে সেই জমির ওপর পাহাড়িদের আর অধিকার থাকছে না। তৎকালীন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সে জমিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এসব জমি নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালির সংঘাতের দায়ভার কে নেবে, এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী তখন রাজি হলেও বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভোটার তালিকা না হওয়ায় জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে সরকার মনোনীত পাঁচ সদস্যের জেলা পরিষদ আজীবন চলতে থাকবে।
চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা প্রবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা হবে। সরকারের কাছে প্রথমেই সেই প্রবিধান রচনা করে পাঠানো হলেও কখনই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বিগত আমলের কোনো সরকারই চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা দেখায়নি, চুক্তির এক যুগ পার হওয়ার পরও। ১৯৭৯-৮০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়ালে একটি সংশোধনী এনে বলা হয়েছিল, কেউ ১৫ বছর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করলে তিনি স্থায়ী বাসিন্দা হবেন। ফলে রাজনৈতিক কারণে যাঁদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, তাঁদের স্থায়ী বাসিন্দা করার জন্য চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। ভূমি কমিশন কার্যকর করা হচ্ছে না, ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জায়গা স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দারা দখল করে আছে।
গত ৫ জুলাই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত প্রতিরোধে ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে একজন উপদেষ্টা কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম গঠন করা হবে, যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সব বিষয় বাস্তবায়নে কাজ করবেন। এ ছাড়া আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম সেখানে পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। কারণ এসব দলের নিবন্ধন নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে আছে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত না হয়, তবে ওই দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা যাবে না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সে দলগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। অথচ আইনের দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, খাগড়াছড়িতে কোনো আঞ্চলিক-রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। কারণ তাদের নিবন্ধন নেই।
প্রশাসন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কীভাবে পার্বত্য অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সরকারের সে বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সরকারের প্রশাসনের ব্যুরোক্রেসি বিভিন্ন কর্মকর্তা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের নামে হাজার হাজার একর জমি লিজ নিয়ে দখল করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটি বেশ কিছু জমির লিজ বাতিল করেছিল। বাতিল করার সিদ্ধান্ত আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা জমি দখল করছেন, তাঁরা কতটা শক্তিশালী, তা ওই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিষ্কার।
আমরা পাহাড়ি নেতারা, নেতিবাচক মনোভাব প্রত্যাহার করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বর্তমানে এগিয়ে আসছি চুক্তিটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনে। এখন সরকারের উচিত, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে। পাহাড়িদের বিপদের সময় তাদের পাশে থাকা উচিত। সরকারের সদিচ্ছাই পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে। বাঙালি সেনাবাহিনী তো পাহাড়িদের খাজনার টাকা দিয়েও পরিচালিত হয়। সুতরাং সেনাবাহিনী শুধু বাঙালিদের একার নয়, পাহাড়িদেরও। পাহাড়িদের নিরাপত্তা রক্ষায় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারের উচিত, চুক্তি অনুযায়ী জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া। সরকারের আন্তরিকতাই পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে।

বিনায়ক সেন
ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের প্রথম অর্থনৈতিক ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট প্রণয়নের কাজে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম, বিশ্বব্যাংকে কর্মরত অবস্থায়। আমি তখন দেখেছি, একটি রাজ্যের উন্নয়ন বিভাগ কীভাবে এগিয়ে যায়। যদি কোনো আন্দোলনের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা করার কেন্দ্র না থাকে, তবে সে আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারে না। বর্তমান বিশ্বায়নের এই যুগে যেকোনো দাবি আদায়ের জন্য অবশ্যই চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেন্দ্র থাকা দরকার।
ঝাড়খন্ড ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের তিন ভাগের এক ভাগ জোগান দিয়ে থাকে। সেখানে জামশেদপুরে টাটানগর রয়েছে। রাঁচির মতো বিশ্বখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু তার পরও এই রাজ্যে দারিদ্র্য দেখা যায়। বিশ্বায়নের এই যুগে আরেকটি ধারণা হচ্ছে, একটি মধ্যবিত্ত সমাজের আকার বাড়ানো, তারপর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, দরিদ্র ও পিছিয়ে যাওয়া অঞ্চলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সরকারের মধ্যে যদি এই মনোভাব থাকে, তবে তা পার্বত্য অঞ্চলের জন্য বেশ ভালো হবে। কারণ, অত্যন্ত দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের চেয়ে মধ্যবিত্ত সমাজে উত্তীর্ণ হওয়া অনেক ভালো।
আমাদের অসম্ভবকে সম্ভব করার উদ্যোগ নিতে হবে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে থেকে অসম্ভবকে সম্ভব করার কল্পনা করা সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষতিকর প্রত্যয়ে পরিণত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে থেকে মাল্টি এথনিক, একটি ইনক্লুসিভ কমিউনিটি প্রতিষ্ঠা করা কষ্টসাধ্য বিষয়।
পার্বত্য অঞ্চলের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে আঞ্চলিক নেতাদের মতৈক্যের ভিত্তিতে একত্র হয়ে একটি ‘স্ট্র্যাটেজিক ফ্রেমওয়ার্ক’-এর মধ্যে থাকতে হবে সরকারসহ সব পক্ষকে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উভয় পক্ষে আরও আলোচনা বাড়াতে হবে। সবাই একসঙ্গে বসে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেসব সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে হবে, যাতে পার্বত্য চুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

সুলতানা কামাল
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কতগুলো বাধা আমাদের সামনে উঠে এসেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের এক যুগ পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় প্রেক্ষাপট অনেকটা বদলে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চুক্তি যেভাবে স্বাক্ষর করা হয়েছিল, সেভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, নাকি যুগের পরিবর্তনে চুক্তিতে সময়োপযোগী সংশোধনী আনার মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হবে। এ অবস্থায় যদি দেখা যায় যে চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য চুক্তিতে কিছু সংশোধনী আনা দরকার, তাও সবাই মিলে ভাবা যেতে পারে। তবে চুক্তির মৌলিক বিষয়ে সংশোধন বা পরিবর্তনের কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না।
পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমানে পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত, পাহাড়িদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন নতুন সংগঠনের আবির্ভাব—সর্বোপরি পার্বত্য অঞ্চলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। চুক্তির সময়ে যে প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা যেত, বর্তমানে হয়তো সে প্রক্রিয়ায় চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই সরকারের উচিত, উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চুক্তির সাংঘর্ষিক ধারায় সংশোধনী এনে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে চুক্তির বাস্তবায়ন সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নিয়ে আসার জন্য আঞ্চলিক ও উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু পার্বত্য অঞ্চলেই নয়, সারা বাংলাদেশেই ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। কারণ অল্প আয়তনের এ দেশে জনসংখ্যা বিপুলসংখ্যক। সুতরাং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা না করে পার্বত্য অঞ্চলে যে বাঙালি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, এতে যে সংঘাত হয়েছিল, তা ছিল স্বাভাবিক। ভূমি কমিশন যদি জরিপ পরিচালনা করে, তবে অনেক পাহাড়ি তাদের ভূমির অধিকার হারাবে। কারণ তাঁদের ভূমির কোনো নির্দিষ্ট কাগজপত্র নেই। জোর করে দখলদারই ভূমির মালিকে পরিণত হবে।
দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়িরা বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার হয়ে এসেছে। তাদের এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। আদিবাসীদের অধিকারের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের উচিত, দেরি না করে এখনই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করা। পাহাড়ি মানুষের যে অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে, সে অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিতে চুক্তি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি।

আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনায় দীর্ঘসময় ধরে সবাই বিশদ বক্তব্য দিয়েছেন। এতক্ষণের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কোনো মতামত থাকলে তা খুব সংক্ষেপে বলার অনুরোধ করছি।

মণিস্বপন দেওয়ান
বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসন যেখানে দুর্বৃত্তায়িত, সেখানে আমাদের গণতন্ত্র সব সময় শঙ্কার মধ্যে থাকে। বিশ্বসংস্থাগুলোর পরামর্শ বাস্তবায়নের জন্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের আকার বড় করার কথা বলা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বলতে চাই, প্রশাসনে কর্মকর্তারা পার্বত্য অঞ্চলে ৪২ হাজার ৪৫০ একর জমি লিজ নিয়ে দখল করেছিলেন। এ ধরনের দুর্বৃত্তায়িত সমাজে বসবাস করে কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানে চুক্তি বাস্তবায়ন অতিদ্রুত করা সম্ভব, তা সবার ভাবা উচিত।

আমেনা মহসীন
আমাদের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু একসময় আমাদের নিজস্ব জাতীয়তাবোধের প্রয়োজন ছিল, সেটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তা ভুলে গেলে চলবে না।

বিনায়ক সেন
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট লক্ষ করলে দেখা যায়, ভারতে যারা নির্যাতিত জাতিসত্তা ছিল, তাদের মধ্যবিত্ত সমাজ উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেরা সামনে এগিয়ে এসেছিল। আমি এটি উদাহরণস্বরূপ বলতে চেয়েছি।

শক্তিপদ ত্রিপুরা
পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল ও চুক্তির সংশোধনী প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করতে হবে। বর্তমান সরকারের ভূমি কমিশনের কার্যক্রমের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে অবহেলা করছে। সরকারের ও সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা উচিত। চুক্তি বাস্তবায়নে সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের অস্তিত্ব রক্ষায়, তাদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাহাড়িদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

গৌতম দেওয়ান
আজকের বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাধাগুলো কী, সেগুলো উঠে এসেছে। আশা করছি, যাঁরা নীতিনির্ধারক আছেন, তাঁরা এ সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে, তা সমাধানে এগিয়ে আসবেন।

মো. জাহাঙ্গীর কামাল
স্থানীয় পার্বত্য রাজনীতিবিদদের পেছনে যাঁরা থাকেন, সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য। স্থানীয় সব নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সব পক্ষ ও সরকারকে।

ইলিরা দেওয়ান
আমাদের সবার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমি জাতি, আরেকজন উপজাতি—এই মনোভাব অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা ও মানসিকতা পরিবর্তন অতি জরুরি।

সঞ্জীব দ্রং
‘পাহাড়ি মানুষ যখন বলে, জীবন তার নয়’ কেন পাহাড়িরা এ কথা বলে, তা উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে সবাইকে বুঝতে হবে। পাহাড়িরা যখন নিজেদের অধিকার আদায়ের কথা বলে, তখন তারা মানুষ হিসেবে সেই দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও জাতিসংঘ যেসব অধিকারের কথা বলছে, পাহাড়িরা তা পাওয়ার অধিকার রাখে।

বিনায়ক সেন
সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় যেহেতু পার্বত্য সমস্যাটি নেই, তাই আমার মতামত হচ্ছে, আরও আলাপ-আলোচনা আয়োজনের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এ সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আনতে হবে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে দল-মতনির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে।

সুধাসিন্ধু খীসা
বাংলাদেশে মাথাপিছু চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০২২ একর। অপরদিকে পার্বত্য অঞ্চলে মাথাপিছু চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০১৪ একর। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের আয়তনের ১০ ভাগের এক ভাগ হলেও, অর্থাৎ পার্বত্য অঞ্চলে জমির পরিমাণ বেশি হলেও চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক কম। সুতরাং বলতে চাই, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারসহ সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বপন আদনান
আইনগতভাবে পার্বত্য অঞ্চলে যাদের অধিকার বেশি, তারা সুবিধা পাবে। সে ক্ষেত্রে পাহাড়িদের প্রথাগত আইনটি রাখলে তারা বেশি সুবিধা পাবে। এতে যদি কিছু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের অন্য কোথাও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে সরকারকে। শুধু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা হচ্ছে। এখানে বলতে পারি, নিরাপত্তার নামে যে নিরাপত্তা সেখানে দেওয়া হচ্ছে, তাতে পাহাড়িরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সুতরাং বাঙালিদের নিরাপত্তার পাশাপাশি পাহাড়িদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে সেনাবাহিনীর। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যে সংশোধনীর যে প্রশ্ন উঠছে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

মতিউর রহমান
আমাদের কথা হচ্ছে, বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা অনেকটা সংকটাপন্ন। এর মূল কারণ, পার্বত্য অঞ্চলের সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদ, দ্বিধাবিভক্তি, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অনাস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নেতাদের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে জনমত গড়ে তুলে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে আলোচনার আয়োজনের মাধ্যমে তাদের অধিকারের কথা সরকারের কাছে তুলে ধরতে হবে।

সুলতানা কামাল
চুক্তির যে মৌলিক বিষয়গুলো ছিল, অর্থাৎ যাদের অধিকার তা তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে, এ বিষয়ে কোনো আপস করা যাবে না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেসব সংশোধনী আনা দরকার, যা চুক্তি ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশোধনী আনতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়নে একত্র হয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। মানবিক সত্তা ও মানবিক অধিকারের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস করা যাবে না।

আব্দুল কাইয়ুম
পার্বত্য শান্তিচুক্তি যেহেতু হয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে আসার কোনো পথ খোলা নেই। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় থেকে থাকে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.