ছোট মামলায় বড় ভোগান্তি by আশরাফ-উল-আলম
ঢাকার ডেমরার পারডগাইর এলাকার বাসিন্দা মো. মফিজুর রহমান তাঁর জমিজমা যাতে অন্য কেউ দখল করতে না পারে সে জন্য প্রতিকার চেয়ে ২০০১ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন (নালিশি মামলা নম্বর ৩৮৭৯/২০০১)। এ মামলার বিবাদী নুর মোহাম্মদ খান, টুটুল ও বিপ্লব।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারায় দায়ের করা এই মামলার বিচারকাজ ১১ বছর ধরে চলছে।
এখন মামলাটি মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেই। বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগ পৃথক হওয়ার পর মামলাটি স্থানান্তরিত হয় ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সাড়ে তিন বছর ধরে মামলাটি ওই আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
মো. হাফিজউদ্দিন ওরফে হ্যাপি ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসিন্দা। তিনি তাঁর পজেশনকৃত দোকান থেকে তাঁকে যাতে উচ্ছেদ করতে না পারে এর ব্যবস্থা নিতে ২০০৩ সালের ২ নভেম্বর মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে (মামলা নম্বর ২৯৩৮/২০০৩, ধারা-১৪৫ ফৌজদারি কার্যবিধি)। এটিও একই কারণে স্থানান্তরিত হয়ে এখন ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার বয়স আট বছর পার হয়েছে; কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি। এ মামলায় বিবাদী সাতজন।
২০০৫ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ফুলজান বেগম তাঁর জমিতে ১৪৫ ধারা জারি চেয়ে মামলা করেন। ওই নালিশি জমিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেন। একই সঙ্গে থানা কর্তৃপক্ষকে নালিশি সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। জানা যায়, পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দেড় বছর আগে। ওই প্রতিবেদনের ওপর এখনো শুনানি হয়নি। প্রতি মাসে একবার মামলার তারিখ পড়ে। বাদী হাজিরা দেন; কিন্তু মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয় না।
জমি কেনাবেচা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭/১১৭(সি) ধারায় তিনটি মামলা করেন শরীফুজ্জামান শিকদার ও তাঁর ভাইবোন। তিন মামলায়ই বিবাদী নোটিশ পেয়ে হাজির হন। এই তিন মামলায় বিবাদীকে ঘুরতে হয়েছে তিন বছর। তারপর মামলা তিনটি নিষ্পত্তি হয়।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ওই ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি একটি বাড়ি কিনেছিলাম। বাড়িটি রেজিস্ট্রি করে দেননি মালিক। এ কারণে আমি দেওয়ানি আদালতে মামলা করি। এর জের ধরে শরীফুজ্জামান ও তাঁর ভাইবোন আমাকে ও আমার ভাইদের জড়িয়ে তিনটি মামলা দেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আমরা নাকি তাঁদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছি।' তিনি বলেন, এমন একটি মামলায় তিন বছর ঘুরতে হয়েছে। আইনজীবী, কোর্টের কর্মচারীদের টাকা দিতে হয়েছে। বাদীপক্ষ মামলা করে ঠিকমতো হাজিরা দেয়নি। এ কারণে শুনানি পিছিয়ে গেছে বারবার। এত ছোট মামলায় বাদী হাজির না হলে মামলা খারিজ হওয়ার কথা। অথচ এ মামলা খারিজ হতে তিন বছর লেগেছে। প্রায়ই দেখা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেই। তিনি নির্বাহী কাজে ব্যস্ত। তাই মামলা চলছে দীর্ঘদিন।
কেরানীগঞ্জের ফুলজান বলেন, 'মনে হচ্ছে, আমি বুড়ি হওয়ার পরও এ মামলা চলবে। মামলা করেই বেকায়দায় পড়েছি। গরিব মানুষ। সামান্য সম্পত্তি যেকোনো সময় প্রতিপক্ষ দখল করে নিতে পারে এই আশঙ্কায় মামলাটি করেছি। কিন্তু ছয় বছর মামলার পেছনে দৌড়াতে হবে জানলে এ কাজ করতাম না।'
শুধু এ কয়টি মামলাই নয়, ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কয়েক হাজার মামলা ঝুলে আছে। ঢাকা মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় উদ্ভূত বিভিন্ন অভিযোগ শুনানি গ্রহণের জন্য বর্তমানে বেশ কয়েকজন নির্বাহী হাকিম রয়েছেন। আর এসব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বর্তমানে চার হাজারেরও বেশি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির অপেক্ষাকৃত ছোট অপরাধের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্বাহী হাকিমদের। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা এসব মামলার বিচারের দাবি করায় সরকারকে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করতে হয়। এর পর থেকে ওই আইনের ৯৮, ১০০, ১০৭, ১১৭, ১৪৫, ১৫১ ধারার মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন নির্বাহী হাকিমরা। এসব ধারায় দায়ের করা মামলা হচ্ছে জমিজমার বিরোধ নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতি ও হুমকির বিষয় নিষ্পত্তি করা, দলিলপত্র উদ্ধারে কার্যকর আদেশ প্রদান, ভিকটিম উদ্ধারের আদেশ প্রদান, নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নে নালিশ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মুসলেকা আদায়ের প্রয়োজন হলে তা আদায় করা।
গত মার্চ মাসের একটি হিসাব থেকে দেখা গেছে, ঢাকার সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ ধরনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে ৩৯৮১টি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম আজাদের আদালতে ৫৩৪টি, শর্মিলা আরেফিনের আদালতে ৮৬২টি, ড. রহিমা খাতুনের আদালতে ১২১টি, শাকিল আহমেদের আদালতে ৫১৬টি, শাহে এলিদ মাইনুল আমিনের আদালতে ৪১২টি, মনোজ কুমার রায়ের আদালতে ৮৬৮টি ও দিল আফরোজা বেগমের আদালতে ৬৬৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
মার্চ মাসের ওই হিসাব থেকে আরো দেখা যায়, প্রতিটি আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত কম। প্রতি মাসে দায়ের হওয়া বা বদলি সূত্রে অন্য আদালত থেকে আসা মামলার সংখ্যা থেকে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা কম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনোজ কুমার রায়ের আদালতে মার্চ মাসে প্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ৩৬২টি, আর নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৮৮টি। দিল আফরোজা বেগমের আদালতে ওই মাসে নতুন দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১৭টি, নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ছয়টি। ম্যাজিস্ট্রেট শাহে এলিদ মাইনুল আমিনের আদালতে দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ৫৯টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫টি। ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহমেদের আদালতে দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ৯৯টি, অথচ নিষ্পত্তি করা হয়েছে মাত্র দুটি মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল আজাদের আদালতে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ৪১টি, বদলি সূত্রে পাওয়া মামলা পাঁচটি। ওই আদালতে মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬টি মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট শর্মিলা আরেফিনের আদালতে নতুন দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ২৮৩টি। এ আদালতে গত মার্চে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৩টি মামলা। আইনজীবীদের মতে, নতুন মামলার সংখ্যার তুলনায় কম নিষ্পত্তি হওয়ায় প্রতি মাসেই মামলার জট বাড়ছে।
আইনজীবীরা বলেন, ছোটখাটো মামলায় বছরের পর বছর আদালতে আসতে হওয়ায় ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারিক ব্যবস্থার ওপর বিচারপ্রার্থীদের আস্থা কমে যাচ্ছে। হয়রানির শিকারও হতে হচ্ছে তাদের। আবার টাকাও ব্যয় হচ্ছে হিসাব ছাড়া। এ কারণে নির্বাহী আদালতের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক বলেও মনে করেন আইনজীবীরা।
অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান বলেন, জোয়ার সাহারায় একটি জমিতে সীমানা প্রাচীর তুলতে গেলে তাঁর এক মক্কেলকে বাধা দেন পাশের জমির মালিক। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাঁর মক্কেল ২০০৯ সালে মামলা করেন। ওই মামলায় তারিখের পর তারিখ পেরিয়ে গেলেও শুনানি না হওয়ায় প্রতিপক্ষ মামলা বাতিলের জন্য হাইকোর্টে যায়। গত বছর হাইকোর্ট মামলাটি স্থগিত করেন।
নির্বাহী হাকিমরা কিভাবে মামলা করছেন, কত মামলা নিষ্পত্তি করছেন তার কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা আছে বলে মনে করেন না আইনজীবীরা। অ্যাডভোকেট মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলে ১০-১১ বছর ধরে এসব ছোটখাটো মামলা চলতে পারে না।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত হাকিমরা নির্ধারিত সময়ে এজলাসে না বসায় বারবার তারিখ পড়ে। এভাবেই পিছিয়ে যায় শুনানি। এ ছাড়া আদালতের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে ঘুষ নিয়ে মামলার নথিপত্র যথাসময়ে শুনানির জন্য হাকিমের কাছে উপস্থাপন না করার অভিযোগ।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা করতে গেলেই শোনা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট অমুক ডিউটি-তমুক ডিউটিতে ব্যস্ত আছেন। এ কারণে তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারলে আইন সংশোধন করে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে গেল কেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা? তিনি আরো বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এসব ছোটখাটো মামলা করতে কেউ আদালতে আসবে না।
অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা করাই বিড়ম্বনা। নির্ধারিত কোনো সময়সীমা নেই। ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রশাসনিক কাজ সেরে পরে আদালতে ওঠেন। মামলায় হাজিরা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা বসে থাকেন। এর অবসান হওয়া দরকার।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের প্রধান কারণ হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটদের সরকারি অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির বিষয়টি তাঁদের মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। শুনেছি ওখানে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম চলে না। দিনের পর দিন বিচারপ্রার্থীদের ঘুরতে হয়। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে যাতে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার না হন।
এখন মামলাটি মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেই। বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগ পৃথক হওয়ার পর মামলাটি স্থানান্তরিত হয় ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সাড়ে তিন বছর ধরে মামলাটি ওই আদালতে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
মো. হাফিজউদ্দিন ওরফে হ্যাপি ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসিন্দা। তিনি তাঁর পজেশনকৃত দোকান থেকে তাঁকে যাতে উচ্ছেদ করতে না পারে এর ব্যবস্থা নিতে ২০০৩ সালের ২ নভেম্বর মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে (মামলা নম্বর ২৯৩৮/২০০৩, ধারা-১৪৫ ফৌজদারি কার্যবিধি)। এটিও একই কারণে স্থানান্তরিত হয়ে এখন ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। এ মামলার বয়স আট বছর পার হয়েছে; কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি। এ মামলায় বিবাদী সাতজন।
২০০৫ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ফুলজান বেগম তাঁর জমিতে ১৪৫ ধারা জারি চেয়ে মামলা করেন। ওই নালিশি জমিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দেন। একই সঙ্গে থানা কর্তৃপক্ষকে নালিশি সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। জানা যায়, পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দেড় বছর আগে। ওই প্রতিবেদনের ওপর এখনো শুনানি হয়নি। প্রতি মাসে একবার মামলার তারিখ পড়ে। বাদী হাজিরা দেন; কিন্তু মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয় না।
জমি কেনাবেচা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭/১১৭(সি) ধারায় তিনটি মামলা করেন শরীফুজ্জামান শিকদার ও তাঁর ভাইবোন। তিন মামলায়ই বিবাদী নোটিশ পেয়ে হাজির হন। এই তিন মামলায় বিবাদীকে ঘুরতে হয়েছে তিন বছর। তারপর মামলা তিনটি নিষ্পত্তি হয়।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ওই ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি একটি বাড়ি কিনেছিলাম। বাড়িটি রেজিস্ট্রি করে দেননি মালিক। এ কারণে আমি দেওয়ানি আদালতে মামলা করি। এর জের ধরে শরীফুজ্জামান ও তাঁর ভাইবোন আমাকে ও আমার ভাইদের জড়িয়ে তিনটি মামলা দেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আমরা নাকি তাঁদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছি।' তিনি বলেন, এমন একটি মামলায় তিন বছর ঘুরতে হয়েছে। আইনজীবী, কোর্টের কর্মচারীদের টাকা দিতে হয়েছে। বাদীপক্ষ মামলা করে ঠিকমতো হাজিরা দেয়নি। এ কারণে শুনানি পিছিয়ে গেছে বারবার। এত ছোট মামলায় বাদী হাজির না হলে মামলা খারিজ হওয়ার কথা। অথচ এ মামলা খারিজ হতে তিন বছর লেগেছে। প্রায়ই দেখা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেই। তিনি নির্বাহী কাজে ব্যস্ত। তাই মামলা চলছে দীর্ঘদিন।
কেরানীগঞ্জের ফুলজান বলেন, 'মনে হচ্ছে, আমি বুড়ি হওয়ার পরও এ মামলা চলবে। মামলা করেই বেকায়দায় পড়েছি। গরিব মানুষ। সামান্য সম্পত্তি যেকোনো সময় প্রতিপক্ষ দখল করে নিতে পারে এই আশঙ্কায় মামলাটি করেছি। কিন্তু ছয় বছর মামলার পেছনে দৌড়াতে হবে জানলে এ কাজ করতাম না।'
শুধু এ কয়টি মামলাই নয়, ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কয়েক হাজার মামলা ঝুলে আছে। ঢাকা মহানগরসহ জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় উদ্ভূত বিভিন্ন অভিযোগ শুনানি গ্রহণের জন্য বর্তমানে বেশ কয়েকজন নির্বাহী হাকিম রয়েছেন। আর এসব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বর্তমানে চার হাজারেরও বেশি বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির অপেক্ষাকৃত ছোট অপরাধের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্বাহী হাকিমদের। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা এসব মামলার বিচারের দাবি করায় সরকারকে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করতে হয়। এর পর থেকে ওই আইনের ৯৮, ১০০, ১০৭, ১১৭, ১৪৫, ১৫১ ধারার মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন নির্বাহী হাকিমরা। এসব ধারায় দায়ের করা মামলা হচ্ছে জমিজমার বিরোধ নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিভিন্ন ধরনের ভয়-ভীতি ও হুমকির বিষয় নিষ্পত্তি করা, দলিলপত্র উদ্ধারে কার্যকর আদেশ প্রদান, ভিকটিম উদ্ধারের আদেশ প্রদান, নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নে নালিশ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মুসলেকা আদায়ের প্রয়োজন হলে তা আদায় করা।
গত মার্চ মাসের একটি হিসাব থেকে দেখা গেছে, ঢাকার সাতজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ ধরনের মামলা বিচারাধীন রয়েছে ৩৯৮১টি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম আজাদের আদালতে ৫৩৪টি, শর্মিলা আরেফিনের আদালতে ৮৬২টি, ড. রহিমা খাতুনের আদালতে ১২১টি, শাকিল আহমেদের আদালতে ৫১৬টি, শাহে এলিদ মাইনুল আমিনের আদালতে ৪১২টি, মনোজ কুমার রায়ের আদালতে ৮৬৮টি ও দিল আফরোজা বেগমের আদালতে ৬৬৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
মার্চ মাসের ওই হিসাব থেকে আরো দেখা যায়, প্রতিটি আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত কম। প্রতি মাসে দায়ের হওয়া বা বদলি সূত্রে অন্য আদালত থেকে আসা মামলার সংখ্যা থেকে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা কম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনোজ কুমার রায়ের আদালতে মার্চ মাসে প্রাপ্ত মামলার সংখ্যা ৩৬২টি, আর নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৮৮টি। দিল আফরোজা বেগমের আদালতে ওই মাসে নতুন দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ১৭টি, নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ছয়টি। ম্যাজিস্ট্রেট শাহে এলিদ মাইনুল আমিনের আদালতে দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ৫৯টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫টি। ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহমেদের আদালতে দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ৯৯টি, অথচ নিষ্পত্তি করা হয়েছে মাত্র দুটি মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল আজাদের আদালতে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা ৪১টি, বদলি সূত্রে পাওয়া মামলা পাঁচটি। ওই আদালতে মার্চ মাসে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬টি মামলা। ম্যাজিস্ট্রেট শর্মিলা আরেফিনের আদালতে নতুন দায়ের হওয়া ও বদলি সূত্রে পাওয়া মামলার সংখ্যা ২৮৩টি। এ আদালতে গত মার্চে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৩টি মামলা। আইনজীবীদের মতে, নতুন মামলার সংখ্যার তুলনায় কম নিষ্পত্তি হওয়ায় প্রতি মাসেই মামলার জট বাড়ছে।
আইনজীবীরা বলেন, ছোটখাটো মামলায় বছরের পর বছর আদালতে আসতে হওয়ায় ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারিক ব্যবস্থার ওপর বিচারপ্রার্থীদের আস্থা কমে যাচ্ছে। হয়রানির শিকারও হতে হচ্ছে তাদের। আবার টাকাও ব্যয় হচ্ছে হিসাব ছাড়া। এ কারণে নির্বাহী আদালতের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক বলেও মনে করেন আইনজীবীরা।
অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান বলেন, জোয়ার সাহারায় একটি জমিতে সীমানা প্রাচীর তুলতে গেলে তাঁর এক মক্কেলকে বাধা দেন পাশের জমির মালিক। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাঁর মক্কেল ২০০৯ সালে মামলা করেন। ওই মামলায় তারিখের পর তারিখ পেরিয়ে গেলেও শুনানি না হওয়ায় প্রতিপক্ষ মামলা বাতিলের জন্য হাইকোর্টে যায়। গত বছর হাইকোর্ট মামলাটি স্থগিত করেন।
নির্বাহী হাকিমরা কিভাবে মামলা করছেন, কত মামলা নিষ্পত্তি করছেন তার কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা আছে বলে মনে করেন না আইনজীবীরা। অ্যাডভোকেট মো. হাফিজুর রহমান বলেন, মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলে ১০-১১ বছর ধরে এসব ছোটখাটো মামলা চলতে পারে না।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত হাকিমরা নির্ধারিত সময়ে এজলাসে না বসায় বারবার তারিখ পড়ে। এভাবেই পিছিয়ে যায় শুনানি। এ ছাড়া আদালতের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে ঘুষ নিয়ে মামলার নথিপত্র যথাসময়ে শুনানির জন্য হাকিমের কাছে উপস্থাপন না করার অভিযোগ।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা করতে গেলেই শোনা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট অমুক ডিউটি-তমুক ডিউটিতে ব্যস্ত আছেন। এ কারণে তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারলে আইন সংশোধন করে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে গেল কেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা? তিনি আরো বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এসব ছোটখাটো মামলা করতে কেউ আদালতে আসবে না।
অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা করাই বিড়ম্বনা। নির্ধারিত কোনো সময়সীমা নেই। ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রশাসনিক কাজ সেরে পরে আদালতে ওঠেন। মামলায় হাজিরা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা বসে থাকেন। এর অবসান হওয়া দরকার।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাহী আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের প্রধান কারণ হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটদের সরকারি অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির বিষয়টি তাঁদের মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। শুনেছি ওখানে নিয়মিত আদালতের কার্যক্রম চলে না। দিনের পর দিন বিচারপ্রার্থীদের ঘুরতে হয়। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে যাতে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানির শিকার না হন।
No comments