ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন-প্রকল্প এগোয় না, খরচ বাড়ে by আনোয়ার হোসেন
দূরত্বের হিসাবে ৩০ কিলোমিটার। ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। নির্মাণকাজ শুরু হয়নি এখনো। অথচ এর মধ্যেই ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ২৪০ কোটি টাকা। এই হিসাবটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের একাংশের।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার পথের কাজ শুরুই করা যায়নি। অথচ নতুন করে কাজ শুরু করতে হলে ২৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগবে বলে হিসাব দিয়েছে সওজ কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে নতুন দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে।
জয়দেবপুর-মাওনা কেবল নয়, পুরো প্রকল্পের কাজেই ধীরগতি। ৮৮ কিলোমিটার পথ চার লেন করার কাজের মধ্যে মাওনা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে। ১৭ মাস চলে গেলেও কাজ হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অথচ ৩০ মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরগতির কারণে মাওনা-ময়মনসিংহ অংশের কাজেরও ব্যয় বেড়ে যাবে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার জন্য গত বছর তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৮৭৯ কোটি টাকার চুক্তি করে সওজ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—চীনের হেবাই রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (এইচআরবিসি) ও বাংলাদেশের ইন্ট্রাকো বিডি, চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ও বাংলাদেশের প্রজেক্ট বিল্ডার্স (পিবিএল) এবং মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন অব চায়না লিমিটেড (এমসিসিসি), শামীম এন্টারপ্রাইজ ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রথম গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১১ সালের মার্চে। আর শেষের দুই গ্রুপের সঙ্গে ওই বছর জানুয়ারি মাসে চুক্তি হয়।
কাজের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ফিরোজ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, অর্থসংকটসহ অনেক কিছুই আছে। সবকিছু বলা যায় না। বড় প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন।
ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে ফিরোজ ইকবাল বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দেখেশুনেই ব্যয় প্রাক্কলন করেছে। এ ছাড়া আগে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, সেটি ২০০৮ সালের। এখন তো সবকিছুর দাম বেড়েছে।’ এক বছরের ব্যবধানে এত বৃদ্ধি যৌক্তিক কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কম-বেশি হতে পারে।’
সওজের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের জন্য ৩২৯ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয় এইচআরবিসি এবং ইন্ট্রাকো বিডিকে। মাওনা থেকে ত্রিশালের রায়মণি পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের জন্য এমবিইসি ও পিবিএলের সঙ্গে চুক্তি হয় প্রায় ২৮৪ কোটি টাকার। রায়মণি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বাকি ২৭ দশমিক ৩৩ কিলোমিটারের কাজ পায় এমসিসিসি, শামীম এন্টারপ্রাইজ ও তমা কনস্ট্রাকশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২৬৬ কোটি টাকায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের পাশে অনেক স্থাপনা। এখনো জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। মাওনা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত কিছু দূর বাদে বাদে মাটি ভরাটের কাজ হয়েছে। অনেক স্থানে এখনো চার লেনের কাজের চিহ্ন দেখা যায়নি। কিছু কিছু কালভার্ট অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় আছে। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটিসহ অনেক অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, পিবিএল ও এসইএল এবং তমা কনস্ট্রাকশন চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ পেলেও এখানে চীনা কোনো বিনিয়োগ নেই। চীনা কোম্পানির প্রকৌশলীদের নির্মাণকাজ তদারকির কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কোনো রকম বিনিয়োগ না করার পরও কেবল কোম্পানির নাম ব্যবহারের জন্যই বিদেশি মুদ্রায় লভ্যাংশ দেওয়া হবে চীনা কোম্পানিকে।
জানতে চাইলে শামীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনারা মাঠে নেই। তবে পরিকল্পনা তৈরিতে আছে। বিনিয়োগ আমরাই করেছি। চীনারা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।’
প্রকল্প পরিচালক ফিরোজ ইকবাল দাবি করেন, মন্ত্রণালয়ের সভা ও ঠিকাদারদের প্রকল্প কার্যালয়ে গিয়ে তিনি চীনাদের দেখেছেন। তবে বিনিয়োগ করেছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব তাঁর না।
৩০ কিলোমিটারের জন্য নতুন প্রাক্কলন: নতুন করে দরপত্র আহ্বানের আগে জয়দেবপুর-মাওনা অংশের জন্য নতুন ব্যয়ও প্রাক্কলন করেছে সওজ। প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ৩০ কিলোমিটার পথ চার লেন করার জন্য নতুন করে ৫৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই অংশের জন্য এইচআরবিসি-ইন্ট্রাকোকে গত বছরের মার্চে ৩২৯ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মাসের ব্যবধানে ঠিকাদারের সঙ্গে করা চুক্তির চেয়ে ২৪০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
শুরুতেই গলদ: জয়দেবপুর-মাওনা অংশের জন্য এইচআরবিসি-ইন্ট্রাকোকে নিয়োগের পর অভিযোগ ওঠে, ইন্ট্রাকো জালিয়াতি করে দরপত্রে অংশ নিয়েছে। কারণ, তাদের সঙ্গে চীনা এইচআরবিসি যৌথভাবে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে, তা সত্য নয়। গত বছরের জুন মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সওজের একটি দল চীনে গিয়ে তদন্ত করে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটিকে এইচআরবিসি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, তারা দরপত্রে অংশ নেয়নি। ইন্ট্রাকো তাদের কাগজপত্র জালিয়াতি করে দরপত্রে অংশ নেয়। এরপর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ঘোষণা দেন, ইন্ট্রাকোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে এবং তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে। এই জটিলতার পর ইন্ট্রাকো সালিসি আদালতে (আরবিট্রেশন) যায়। এখনো সালিস শেষ হয়নি এবং কাজও শুরু করা যায়নি। সালিস চলা অবস্থাতেই নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের হেবাই ও বাংলাদেশের ইন্ট্রাকোর মধ্যে প্রধান ঠিকাদার হচ্ছে হেবাই, ইন্ট্রাকো তাদের সহযোগী। ২০১১ সালে সড়ক ভবনে হেবাইয়ের প্রতিনিধি ছাড়াই ইন্ট্রাকো চুক্তি সই করে। এ সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তৎকালীন যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খান ও সওজের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী শাহাবউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। প্রধান ঠিকাদারের প্রতিনিধি না থাকার পরও কোনো রকম প্রশ্ন না তুলেই চুক্তি করা হয়।
সওজের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কাজ পাওয়ার জন্য ইন্ট্রাকোর কর্মকর্তারা সওজের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে মোটা অঙ্কের ঘুষও দেন। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের লেনদেনের জন্য রুষ্ট হয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন। এরপর চীনা কোম্পানিও সরে দাঁড়ায় এবং জানিয়ে দেয়, তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে নেই।
ইন্ট্রাকোর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনার পর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি কাজ পাইয়ে দিতে যে সওজের ওই কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছিলেন, তা সাবেক যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খানকে জানিয়ে দেন। আলোচিত ওই কর্মকর্তা তখন ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রী হয়ে রাজেন্দ্রপুরে সওজের রেস্ট হাউসে ইন্ট্রাকোর সঙ্গে বৈঠক করে পুনরায় কাজ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা পর মন্ত্রী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সে সময় বলেছিলেন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগসহ পেছনের খবর তিনি জানতেন না। তাই কাজ করার নির্দেশ দিয়ে তা স্থগিত করা হয়েছে।
ইন্ট্রাকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবর আলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কাজ পাওয়ার পর চীনা কোম্পানির চারজন প্রতিনিধি প্রকল্প এলাকা ঘুরে গেছেন। চীনা কোম্পানি যে তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে কাজ করার চুক্তি করেছে, এর প্রমাণ আছে। তবে সরকার অন্য ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে চীনা কোম্পানির ওপর চাপ প্রয়োগ করে চার লেন প্রকল্পে দরপত্রে অংশ নেয়নি—এমন স্বীকারোক্তি আদায় করে।
জয়দেবপুর-মাওনা কেবল নয়, পুরো প্রকল্পের কাজেই ধীরগতি। ৮৮ কিলোমিটার পথ চার লেন করার কাজের মধ্যে মাওনা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে। ১৭ মাস চলে গেলেও কাজ হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অথচ ৩০ মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, ধীরগতির কারণে মাওনা-ময়মনসিংহ অংশের কাজেরও ব্যয় বেড়ে যাবে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন করার জন্য গত বছর তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৮৭৯ কোটি টাকার চুক্তি করে সওজ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—চীনের হেবাই রোড অ্যান্ড ব্রিজ গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (এইচআরবিসি) ও বাংলাদেশের ইন্ট্রাকো বিডি, চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ও বাংলাদেশের প্রজেক্ট বিল্ডার্স (পিবিএল) এবং মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন অব চায়না লিমিটেড (এমসিসিসি), শামীম এন্টারপ্রাইজ ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। প্রথম গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১১ সালের মার্চে। আর শেষের দুই গ্রুপের সঙ্গে ওই বছর জানুয়ারি মাসে চুক্তি হয়।
কাজের ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ফিরোজ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, অর্থসংকটসহ অনেক কিছুই আছে। সবকিছু বলা যায় না। বড় প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন।
ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে ফিরোজ ইকবাল বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দেখেশুনেই ব্যয় প্রাক্কলন করেছে। এ ছাড়া আগে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, সেটি ২০০৮ সালের। এখন তো সবকিছুর দাম বেড়েছে।’ এক বছরের ব্যবধানে এত বৃদ্ধি যৌক্তিক কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কম-বেশি হতে পারে।’
সওজের নথিপত্র থেকে জানা গেছে, জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত ৩০ দশমিক ২৫ কিলোমিটারের জন্য ৩২৯ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয় এইচআরবিসি এবং ইন্ট্রাকো বিডিকে। মাওনা থেকে ত্রিশালের রায়মণি পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটারের জন্য এমবিইসি ও পিবিএলের সঙ্গে চুক্তি হয় প্রায় ২৮৪ কোটি টাকার। রায়মণি থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত বাকি ২৭ দশমিক ৩৩ কিলোমিটারের কাজ পায় এমসিসিসি, শামীম এন্টারপ্রাইজ ও তমা কনস্ট্রাকশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২৬৬ কোটি টাকায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়দেবপুর থেকে মাওনা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের পাশে অনেক স্থাপনা। এখনো জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। মাওনা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত কিছু দূর বাদে বাদে মাটি ভরাটের কাজ হয়েছে। অনেক স্থানে এখনো চার লেনের কাজের চিহ্ন দেখা যায়নি। কিছু কিছু কালভার্ট অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় আছে। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটিসহ অনেক অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, পিবিএল ও এসইএল এবং তমা কনস্ট্রাকশন চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ পেলেও এখানে চীনা কোনো বিনিয়োগ নেই। চীনা কোম্পানির প্রকৌশলীদের নির্মাণকাজ তদারকির কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। কোনো রকম বিনিয়োগ না করার পরও কেবল কোম্পানির নাম ব্যবহারের জন্যই বিদেশি মুদ্রায় লভ্যাংশ দেওয়া হবে চীনা কোম্পানিকে।
জানতে চাইলে শামীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চীনারা মাঠে নেই। তবে পরিকল্পনা তৈরিতে আছে। বিনিয়োগ আমরাই করেছি। চীনারা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।’
প্রকল্প পরিচালক ফিরোজ ইকবাল দাবি করেন, মন্ত্রণালয়ের সভা ও ঠিকাদারদের প্রকল্প কার্যালয়ে গিয়ে তিনি চীনাদের দেখেছেন। তবে বিনিয়োগ করেছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব তাঁর না।
৩০ কিলোমিটারের জন্য নতুন প্রাক্কলন: নতুন করে দরপত্র আহ্বানের আগে জয়দেবপুর-মাওনা অংশের জন্য নতুন ব্যয়ও প্রাক্কলন করেছে সওজ। প্রকল্প কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ৩০ কিলোমিটার পথ চার লেন করার জন্য নতুন করে ৫৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই অংশের জন্য এইচআরবিসি-ইন্ট্রাকোকে গত বছরের মার্চে ৩২৯ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ মাসের ব্যবধানে ঠিকাদারের সঙ্গে করা চুক্তির চেয়ে ২৪০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।
শুরুতেই গলদ: জয়দেবপুর-মাওনা অংশের জন্য এইচআরবিসি-ইন্ট্রাকোকে নিয়োগের পর অভিযোগ ওঠে, ইন্ট্রাকো জালিয়াতি করে দরপত্রে অংশ নিয়েছে। কারণ, তাদের সঙ্গে চীনা এইচআরবিসি যৌথভাবে কাজ করার যে কথা বলা হয়েছে, তা সত্য নয়। গত বছরের জুন মাসে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সওজের একটি দল চীনে গিয়ে তদন্ত করে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটিকে এইচআরবিসি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, তারা দরপত্রে অংশ নেয়নি। ইন্ট্রাকো তাদের কাগজপত্র জালিয়াতি করে দরপত্রে অংশ নেয়। এরপর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ঘোষণা দেন, ইন্ট্রাকোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে এবং তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে। এই জটিলতার পর ইন্ট্রাকো সালিসি আদালতে (আরবিট্রেশন) যায়। এখনো সালিস শেষ হয়নি এবং কাজও শুরু করা যায়নি। সালিস চলা অবস্থাতেই নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনের হেবাই ও বাংলাদেশের ইন্ট্রাকোর মধ্যে প্রধান ঠিকাদার হচ্ছে হেবাই, ইন্ট্রাকো তাদের সহযোগী। ২০১১ সালে সড়ক ভবনে হেবাইয়ের প্রতিনিধি ছাড়াই ইন্ট্রাকো চুক্তি সই করে। এ সময় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তৎকালীন যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খান ও সওজের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী শাহাবউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। প্রধান ঠিকাদারের প্রতিনিধি না থাকার পরও কোনো রকম প্রশ্ন না তুলেই চুক্তি করা হয়।
সওজের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কাজ পাওয়ার জন্য ইন্ট্রাকোর কর্মকর্তারা সওজের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে মোটা অঙ্কের ঘুষও দেন। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের লেনদেনের জন্য রুষ্ট হয়ে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেন। এরপর চীনা কোম্পানিও সরে দাঁড়ায় এবং জানিয়ে দেয়, তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে নেই।
ইন্ট্রাকোর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আনার পর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি কাজ পাইয়ে দিতে যে সওজের ওই কর্মকর্তা মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছিলেন, তা সাবেক যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খানকে জানিয়ে দেন। আলোচিত ওই কর্মকর্তা তখন ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রী হয়ে রাজেন্দ্রপুরে সওজের রেস্ট হাউসে ইন্ট্রাকোর সঙ্গে বৈঠক করে পুনরায় কাজ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা পর মন্ত্রী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সে সময় বলেছিলেন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগসহ পেছনের খবর তিনি জানতেন না। তাই কাজ করার নির্দেশ দিয়ে তা স্থগিত করা হয়েছে।
ইন্ট্রাকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবর আলী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কাজ পাওয়ার পর চীনা কোম্পানির চারজন প্রতিনিধি প্রকল্প এলাকা ঘুরে গেছেন। চীনা কোম্পানি যে তাদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে কাজ করার চুক্তি করেছে, এর প্রমাণ আছে। তবে সরকার অন্য ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে চীনা কোম্পানির ওপর চাপ প্রয়োগ করে চার লেন প্রকল্পে দরপত্রে অংশ নেয়নি—এমন স্বীকারোক্তি আদায় করে।
No comments