আরেক আলোকে-ওসামা হত্যা, অতঃপর! by ইনাম আহমেদ চৌধুরী

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী ফল ও প্রভাব ফেলবে। এটা ঠিক, তিনি আল কায়দার অপারেশনাল কমান্ডে ছিলেন না বা বিভিন্ন দেশে আল কায়দা কার্যক্রম তার নির্দেশের মুখাপেক্ষী ছিল না, অন্তত গত কয়েক বছর ধরে।


১৯৯৮ সালে কেনিয়ায়, ২০০০ সালে আমেরিকায় এবং ২০০১ সালের ৯/১১-এর ঘটনায় তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা এবং নির্দেশনা প্রদান সর্বজনবিদিত। বস্তুতপক্ষে তাকে ঘটনাগুলোর 'মাস্টারমাইন্ড' বলা হতো


রোববার ১ মে রাতে অনেকটা নাটকীয়ভাবেই প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করলেন_ একটি বিশেষ আমেরিকান অপারেশনে পাকিস্তানের এবোটাবাদ শহরের উপকণ্ঠে বেলাল-টাউনে একটি সুরক্ষিত গৃহে হেলিকপ্টার আক্রমণ এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। আমেরিকার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনাকে প্রেসিডেন্ট ওবামা ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অঙ্গীকার পরিপূরণের জীবন্ত স্বাক্ষর বলে উল্লেখ করে গর্ব ও আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে বলেন_ এটা প্রমাণ করল আমাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে জানি, এবং বারবার তা সম্ভবপর হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, সারা আমেরিকা বর্তমানে ভাসছে আনন্দের জোয়ারে। ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোববার বেশ রাতেই লোক জড়ো হতে শুরু হয়ে যায়। ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের পাশে, নিউইয়র্কে টাইম স্কয়ারে এবং বিশেষ করে টুইন টাওয়ারের ভূতপূর্ব অবস্থানস্থল গ্রাউন্ড জিরোতে। দেখা যায়, আনন্দ-উচ্ছল আত্মপ্রত্যয়ী আমেরিকানদের ক্রমবর্ধমান সমাবেশ আজকের ইউনিপোলার বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তিধর আমেরিকার প্রত্যয়ে প্রদীপ্ত মুখচ্ছবি। তাদেরই সহায়তায় ন্যাটো বাহিনী একদিন আগেই ত্রিপোলিতে দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা হামলা করে মুয়াম্মার গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র এবং তিন সম্পূর্ণ নিরপরাধ অপ্রাপ্তবয়স্ক নাতি-নাতনিকে হত্যা করেছে। তাতে ওঠেনি কোনো বিশ্বব্যাপী শোরগোল, এমনকি প্রতিবাদের কোনো লক্ষ্যযোগ্য কণ্ঠস্বর।
প্রেসিডেন্ট ওবামা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জারদারির সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন এবং তিনি তার বক্তৃতায় পাকিস্তানের সহযোগিতার সকৃতজ্ঞ উল্লেখ করলেন। এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান, পাকিস্তান সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, সহযোগিতা, এমনকি সমর্থন ব্যতিরেকে এ ধরনের কোনো সফল কার্যক্রম নেওয়া আমেরিকান আর্মির কোনো বিশেষ ইউনিটের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। এ সুদক্ষ ইউনিট কি নেভির, না সিআইএর, না প্যারাস্ট্রপার কমান্ডোদের তা এখনও জানা যায়নি_ তবে তারা একাধিক হেলিকপ্টার গানশিপ সহকারে সম্ভবত আফগানিস্তানের কোনো ঘাঁটি থেকে এসেছে এবং গ্রাউন্ড সহকারীদের সহযোগিতা নিয়েছে। কোনো আমেরিকান হতাহত হয়নি। তবে বিন লাদেনের এক পুত্র এবং দুই সহযোগীর মৃত্যু হয়েছে। দু'একজন মহিলাও আহত হয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। তারা হয়তো মানববর্ম হয়ে ওসামার জীবন রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকান বুলেট আঘাত করার আগেই পূর্ব নির্দেশ অনুসারে ওসামার এক দেহরক্ষীর গুলিতেই তার জীবনাবসান হয়েছিল। পরে কী হলো জানা যায়নি। তবে মৃতদেহগুলো বর্তমানে আমেরিকার হেফাজতে এবং সম্ভবত আফগান কোনো ঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি মুখপাত্র এ আক্রমণ ও মৃত্যুর নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। কাবুলে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছেন_ আমি সবসময়ই বলেছি, বিন লাদেন আফগানিস্তানে নেই। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘটনাটিকে পরম স্বস্তিদায়ক বলে উল্লেখ করেছেন। উল্লসিত হয়েছেন সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, বিল ক্লিনটন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও। সৌদি আরব এবং পাকিস্তান এখনও কোনো সরকারি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তবে কোনো সন্দেহ নেই, তাদের শাসক মহলে ওবামার বিদায় যথেষ্ট স্বস্তি ও সন্তুষ্টির উদ্রেক করবে। বস্তুত বিন লাদেনের আল কায়দা তো এ দুই দেশের সংস্থাপন-প্রশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাই করেছিল। তদুপরি মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও যেখানে শরিয়া শাসনের আশঙ্কা রয়েছে, সেখানেও নেতৃবর্গ এ ঘটনাকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভবত ইতিবাচক বলে গণ্য করবেন।
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী ফল ও প্রভাব ফেলবে। এটা ঠিক, তিনি আল কায়দার অপারেশনাল কমান্ডে ছিলেন না বা বিভিন্ন দেশে আল কায়দা কার্যক্রম তার নির্দেশের মুখাপেক্ষী ছিল না, অন্তত কয়েক বছর ধরে। ১৯৯৮ সালে কেনিয়ায়, ২০০০ সালে আমেরিকায় এবং ২০০১ সালের ৯/১১-এর ঘটনায় তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা এবং নির্দেশনা প্রদান সর্বজনবিদিত। বস্তুতপক্ষে তাকে ঘটনাগুলোর 'মাস্টারমাইন্ড' বলা হতো। পরে বালি, মাদ্রিদ, লন্ডন বা ইয়েমেনে সংঘটিত বোমা হামলাগুলোতে তার প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে উদ্দীপনার উৎস হিসেবে নিশ্চয়ই তার অদৃশ্য ভূমিকা থেকে গিয়েছিল। এখন তার চিরবিদায়ে তাই আল কায়দার কর্মকাণ্ডে সরাসরি তার অভাব অনুভূত বা দৃশ্যমান হবে না। তবে চিন্তাভাবনার উৎস হিসেবে তিনি আরও কিছুকাল থাকবেন, নিশ্চিত। অনেকে ধারণা করছেন, ধীরে ধীরে বিন লাদেনের পরোক্ষ প্রভাবও (সম্ভবত কয়েকটি আকস্মিক প্রতিক্রিয়াসুলভ বিস্ফোরণদাতা) ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর বা অন্যান্য স্থানে যে গণঅভ্যুত্থান সূচিত হয়েছে বা হচ্ছে, তাতে জনমনে ধর্মীয় উপাদান প্রায় অনুপস্থিত। মূলত এসব অভ্যুত্থান গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরিবর্তন কিংবা জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্পর্কিত। যথেষ্ট স্থানীয় এবং ধর্মাচারবহির্ভূত। বিন লাদেনের মতাদর্শ মুখ্যত ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেত এবং তা মূলত ইসলামী শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত। সব দেশের সরকারই, বিশেষ করে পাকিস্তানও তা প্রগতির পরিপন্থী বলে জ্ঞান করে।
অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, বিন লাদেন কী করে এ প্রকাশ্য স্থানে জনপদের ভিড়ে ৫.৫ মিটার উঁচু দেয়ালঘেরা তার জন্য, বিশেষ করে নির্মিত সুরক্ষিত একটি গৃহে বসবাস করছিলেন। টোরা-রবা পর্বতে নয়, কোনো গিরি-কন্দরে নয়, পাক-আফগান সীমান্তের কোনো দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে নয়, বরং পাকিস্তানের রাজধানীর অদূরবর্তী একটি জনবহুল স্থানে, পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীর সনি্নকটে সপারিষদ আস্তানা গাড়লেন। তিনি বা তার উপদেষ্টারা কি বুঝতে পারেননি, অদূর ভবিষ্যতে তা নিশ্চয়ই জানাজানি হবে। নিশ্চয়ই প্রশাসন বা গোয়েন্দা বাহিনীর অগোচরে তা থাকতে পারে না। তবে এটা কি সম্ভব যে, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তার পরিসমাপ্তির দিন সনি্নকটে। ওবামা বলেছেন, মার্চ মাসে পাঁচবার তিনি ওসামাসংক্রান্ত ব্যাপারে জরুরি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং গত শুক্রবার প্রত্যক্ষ আক্রমণের নির্দেশ দেন। পাকিস্তান সেনা বা এয়ারফোর্সের অগোচরে এসব কী করে থাকতে পারে? সম্ভবত সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক এবং স্ট্র্যাটেজিস্ট বা সব দিক বিবেচনা করে সর্বোৎকৃষ্ট মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ওসামা বিন লাদেনের এ মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস জোগাবে, সন্দেহ নেই। তবে এটা লাগামহীন যাতে না হয়, সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে বিবেচনার অভাব পরিলক্ষিত হবে। বিন লাদেনের চিরবিদায় নিঃসন্দেহে আান্তর্জাতিক শরিয়া প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা প্রচেষ্টাকে দুর্বলতর এবং ক্ষীণতর করবে। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ইতিমধ্যে বলেছেন, কায়দা-সহায়তাপুষ্ট তালেবানরা এখন বাইরের শক্তি আহরণ করতে বিশেষ সক্ষম হবে না এবং তা তার দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। পাকিস্তানে আমেরিকান পাইলটবিহীন ড্রোন আক্রমণের কারণ অনেক কমে যাবে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকান সম্পর্ক সহজতর হয়ে উঠবে বলে মনে হয়।

ইনাম আহমদ চৌধুরী :সাবেক সচিব
 

No comments

Powered by Blogger.