সমকালীন প্রসঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ওসামা বিন লাদেন ও গাদ্দাফির সন্তানদের খুন করেছে by বদরুদ্দীন উমর

ভালো কাজের জন্য ধর্ম বিশ্বাস, জাতি, গায়ের রঙ ইত্যাদি যেমন কোনো ব্যাপার নয়, তেমনি ক্রিমিনাল কাজের সঙ্গেও ধর্ম, জাতি, গায়ের রঙের কোনো সম্পর্ক নেই। শ্রেণী, দল ও ব্যক্তিগত স্বার্থে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের ক্রাইম করে থাকে। বর্তমানে আমরা আরব বিশ্বে যে ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করছি, সেখানকার বিভিন্ন দেশের
প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের যে সম্পর্ক দেখছি তার মধ্যেও এ সত্যেরই প্রতিফলন ঘটছে


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে খুন করেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউস থেকে এক বিশেষ বক্তৃতায় তাদের এই কৃতিত্ব অর্জনের সংবাদ দেন। তার নির্দেশেই পাকিস্তানের বানু প্রদেশের এবোটাবাদে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। লাদেনের লাশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ডিএনএ ইত্যাদি পরীক্ষা করে তারা এখন নিশ্চিন্ত!
২০০১ সালে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে এবং ওয়াশিংটনে পেন্টাগনের হেড কোয়ার্টারে বিমান হামলার পরমুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট বুশ এক ঘোষণার মাধ্যমে ওসামা বিন লাদেনকে এর জন্য দায়ী করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। লাদেন ইসলামী মৌলবাদী হিসেবে আরব বিশ্বের বিভিন্ন মুসলমানপ্রধান দেশে মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও তৎপরতা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের প্রচারণার মোকাবেলা করার জন্য জিহাদ ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্তভাব কিছু সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করেন। কিন্তু ২০০১ সালে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে উপরোক্ত বিমান হামলা পরিচালনার কোনো ক্ষমতাই তার ছিল না। এ ঘটনার অনেক আগে থেকেই লাদেন আফগানিস্তানের বিভিন্ন গুহায় বাস করতেন এবং এভাবে গুহায় বাস করে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে বিমান হামলা সংঘটিত করা যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব, এটি চিন্তা করাও এক অতি অবাস্তব ব্যাপার। আসলে সেই বিমান হামলার সঙ্গে লাদেনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। কোনো সম্পর্ক থাকার বিন্দুমাত্র প্রমাণ প্রেসিডেন্ট বুশ ও মার্কিন সরকার আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিযোগই যথেষ্ট, তার জন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এ অবস্থান গ্রহণ করে তারা আফগান সরকার ও সরকারপ্রধান মোল্লা ওমরকে হুকুম করেন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে। এর জবাবে মোল্লা ওমর বলেন, প্রেসিডেন্ট বুশ যদি সেই বিমান হামলায় লাদেনের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ দিতে পারেন তাহলে তিনি অবশ্যই তাকে আমেরিকার হাতে সমর্পণ করবেন। কোনো প্রমাণ দিতে অক্ষম প্রেসিডেন্ট বুশ এর জবাবে বলেন, প্রমাণের কোনো প্রয়োজন নেই। তারা জানেন, এ কাজ ওসামা বিন লাদেনের। কাজেই তাকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। মোল্লা ওমর প্রদত্ত যুক্তিসঙ্গত শর্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূরণ না করায় তিনি লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরই প্রেসিডেন্ট বুশ আফগানিস্তান আক্রমণ করেন ও সামরিক শক্তির জোরে আফগানিস্তান দখল এবং মোল্লা ওমর ও তালেবানদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেন। আফগানিস্তান এখনও আমেরিকার দখলে এবং ন্যাটো সামরিক বাহিনী ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষাধিক সৈন্য সেখানে মোতায়েন আছে। তাদের সামরিক শক্তি সত্ত্বেও যতই তাদের অবস্থা বেকায়দা হচ্ছে ততই তারা আফগানিস্তানে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। যারা নিজেদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার লোক মনে করেন তাদের অনেকে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটায় মহাখুশি হয়েছিলেন। কারণ তালেবানরা ধর্মীয় মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল! তালেবানরা ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও প্রগতিশীল হিসেবে যুক্তিসঙ্গতভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয় যেভাবে তালেবানরা উৎখাত হয়েছে তাকে সমর্থন করা। শুধু ধর্মীয় মৌলবাদী ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলরাই একমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নয়। তার থেকেও বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে দুনিয়ায় আছে তার বড় প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং তাদের মিত্র বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাদের উৎখাতের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা চীন ও ফ্রান্সে গিয়ে বাইরের কোনো শক্তির অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও সামরিক হামলা সমর্থনযোগ্য। যে কোনো দেশে গণবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ট শাসকশক্তি উচ্ছেদ করার দায়িত্ব কোনো বাইরের শক্তির নয়, সে দায়িত্ব হলো সেই বিশেষ দেশের লোকদের নিজেদের। বাইরের কোনো শক্তি যখনই অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে সে দেশ আক্রমণ ও দখল করে তখন সে দেশের ওপর আরও বড় ধরনের বিপদ দেখা দেয়। এ বিপদ যে আফগানিস্তান ও ইরাকের ক্ষেত্রে ঘটেছে, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এ বিতর্ক যারা করে তারা কোনো না কোনো প্রকারে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী। অনেকে নিজেদের অজান্তেই এ অবস্থান গ্রহণ করে। তারা মনে করে, এসব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করে তারা প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরোধিতা করতে দাঁড়িয়ে প্রগতিশীলতার ধারক-বাহকের কাজ করছে!
আরব বিশ্বে তিউনিসিয়া থেকে নিয়ে মিসর, ইয়েমেন, বাহরাইন, লিবিয়া ও সিরিয়ায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার চিত্র এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। প্রত্যেক দেশেই সেখানকার শাসক চক্রের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদীরা, বিশেষত তাদের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এজেন্সিদের মাধ্যমে অতিশয় ধূর্ততার সঙ্গে গণবিক্ষোভ সৃষ্টি করে এ দেশগুলোতে নিজেদের অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করছে। যেসব দেশে ইতিমধ্যেই তাদের সুসংগঠিত এজেন্টরা আছে, সেখানে কারা মূলত তাদের মাধ্যমেই এ কাজ করে, যেমন সেটা তারা করেছে তিউনিসিয়া, মিসর ও বাহরাইনে এবং করতে যাচ্ছে ইয়েমেনে। অন্যদিকে লিবিয়ার মতো দেশে যেখানে তাদের সে সুযোগ নেই, সেখানে তারা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে অবলম্বন করে বিক্ষোভ সৃষ্টির পর দ্রুত সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং লিবিয়ার জনগণকে গাদ্দাফির 'গণহত্যা'র হাত থেকে রক্ষার জন্য তারা এখন লিবিয়ায় নির্বিচারে বিমান থেকে বোমা হামলা করে শত শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে এবং তাদের প্রচারমাধ্যমে তারা এ হত্যাকাণ্ডকে গাদ্দাফির ঘাড়ে চড়িয়ে নিজেদের 'মানবিক' চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখছে! সাম্রাজ্যবাদের এ লীলাখেলা নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকে তারা নিয়মিতভাবেই নিজেদের স্থূল স্বার্থরক্ষার জন্য এ ধরনের হামলা অন্য দেশের ওপর করে আসছে। অন্য কত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিশিষ্ট নেতাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ হত্যা করেছে তার হিসাব নেই। কিন্তু হিসাব না থাকলেও এটা এক পরিচিত ব্যাপার হিসেবে সব মহলেই, এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল মহলেও স্বীকৃত।
১ মে চালকবিহীন মার্কিন বিমান ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির বাসভবনে হামলা চালিয়ে তার ছোট ছেলে সাইফ গাদ্দাফি ও তার তিন নাতি-নাতনিকে হত্যা করেছে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের আমলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফির বাসভবনে আক্রমণ চালিয়ে তার এক শিশুকন্যাকে হত্যা করেছিল। অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা অন্য কোনো উপায়ে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পেরে এখন তাকে হত্যার মাধ্যমে লিবিয়া দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। স্বৈরশাসক হিসেবে কঠোরহস্তে শাসন কাজ পরিচালনা করলেও গাদ্দাফি লিবিয়ার জনগণের জন্য সার্বিকভাবে ও বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। পানীয় জল সর্বত্র সহজলভ্য করেছেন। কর্মসংস্থান, আবাসন ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন এবং সর্বোপরি লিবিয়ার স্বাধীনতা সাম্রাজ্যবাদী হামলা থেকে রক্ষা করে এসেছেন। লিবিয়ার সম্পদ তাদের দ্বারা লুণ্ঠিত হতে দেননি। এখন যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক হামলা চালিয়ে কিছুসংখ্যক স্থূলবুদ্ধি ও মতলববাজ লিবিয়ানের সহযোগিতায় লিবিয়া দখল করতে যাচ্ছে তাতে লিবিয়ার স্বাধীনতা বলে আর কিছুই থাকবে না। শুধু তাই নয়, গাদ্দাফি শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্য, পানীয় জল ইত্যাদির যে ব্যবস্থা লিবিয়ার জনগণের জন্য করেছেন, সে ব্যবস্থার কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে। এই সঙ্গে সেখানে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতন ও দমন-পীড়ন নতুন মাত্রা অর্জন করবে। এ পরিণতিই লিবিয়ার জনগণের জন্য এখন অপেক্ষা করছে।
ভালো কাজের জন্য ধর্মবিশ্বাস, জাতি, গায়ের রঙ ইত্যাদি যেমন কোনো ব্যাপার নয়, তেমনি ক্রিমিনাল কাজের সঙ্গেও ধর্ম, জাতি, গায়ের রঙের কোনো সম্পর্ক নেই। শ্রেণী, দল ও ব্যক্তিগত স্বার্থে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের ক্রাইম করে থাকে। বর্তমানে আমরা আরব বিশ্বে যে ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করছি, সেখানকার বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের যে সম্পর্ক দেখছি তার মধ্যেও এ সত্যেরই প্রতিফলন ঘটছে।
২.৫.২০১১

No comments

Powered by Blogger.