শ্রম ও কর্মসংস্থান-মে দিবস ও আজকের বাংলাদেশ by মোঃ ইসরাফিল আলম
আমাদের জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি হিসেবে শ্রমিক সমাজকে সংগঠিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত করতে তাদের কল্যাণ ও অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে।
অবারিত করতে হবে তাদের ট্রেড ইউনিয়ন ও দর কষাকষি করার মতো মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের পথ
একশ' পঁচিশ বছর আগে ১ মে ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে মকরম্যাক রিপার ওয়ার্কস নামক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনরত শ্রমিকদের রক্তদানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল মহান মে দিবস। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুগ যুগ ধরে শ্রমিক সমাজকে অনেক রক্ত ও প্রাণ দিতে হয়েছে, যার শেষ আজও হয়নি। তাদের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নির্যাতন, নিপীড়ন ও ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শাসকশ্রেণীর নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব হারিয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েন। ১৮৮৬ সালের মে মাসের ৪ তারিখে হে মার্কেট স্কয়ারে প্রতিবাদের জন্য আয়োজিত সমাবেশে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শোষকশ্রেণীর কতিপয় সন্ত্রাসী চক্র বোমা নিক্ষেপ করলে শ্রমিক ও কয়েকজন পুলিশ মারা যায়। ১৮৮৬ সালের দ্বিতীয়ার্থে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সুশৃঙ্খল ও সুনির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার নামক সংগঠন গড়ে ওঠে। পরিবেশে ওয়ালস হিভেল অ্যাক্ট এবং ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট প্রণীত হয়, যার মাধ্যমে ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদনের দাবি স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীকালে শ্রমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। জন্মলগ্ন থেকে আইএলও এ পর্যন্ত প্রায় ১৮৯টি সাধারণ কনভেনশন এবং ৮টি কোর কনভেনশন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ৩৩টি সাধারণ ও ৭টি কোর কনভেনশন স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। তবে কর্মক্ষেত্রে নূ্যনতম বয়স নির্ধারণ সম্পর্কিত ১৩৮ নম্বর কোর কনভেনশন অনুসমর্থন না করলেও বাংলাদেশের শিশু শ্রমনীতি ২০১০ এবং শ্রম আইন ২০০৬-এর মধ্যে যেহেতু ওই কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শ্রমিকের নূ্যনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে, সেহেতু অবশিষ্ট কোর কনভেনশনটি অনুসমর্থন করতে বাংলাদেশের ঝুঁকি বা সমস্যা নেই। তাই ১৩৮ নম্বর কোর কনভেনশনটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অনুসমর্থন করা উচিত।
্ববর্তমান বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এসব শ্রমিকের নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, চাকরির নিশ্চয়তা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বলতে কোনো কিছুই নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে কৃষিনির্ভর অথচ কৃষি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন তো দূরের কথা কোনো সংগঠনই নেই। প্রতি বছর ৫ ভাগের ৪ ভাগ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান পায়। দেশের রাজধানী ঢাকা শহরেই কর্মরত মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ২ লাখ থেকে ২.৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, বেসরকারি পর্যায়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ, আত্মকর্মসংস্থানে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ এবং বর্তমানে প্রবাসে প্রতি বছর ৪ লাখ থেকে ৪.১৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে (যদি বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে)। প্রতি বছর আমাদের প্রায় ৪-৫ লাখ শ্রমশক্তি কর্মসংস্থানের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজারে এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করাটাই এই বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হতে পারে।
স্বাধীনতার পর নগরায়ন ও নগরবাসীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির পাঁচ শতাংশের কম প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। যে কারণে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠনগুলো দুর্বল এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য বহুভাগে বিভক্ত। তাই বাংলাদেশে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের সর্বস্তরে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বের দক্ষতা ও গুণগত মান এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক স্তরে উপনীত হয়েছে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সেক্টরে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও মজুরি কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চরম অমানবিক পর্যায়ে নিমজ্জিত থাকলেও শ্রমিক আন্দোলনের সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের জন্য অর্থবহভাবে কিছুই করা যাচ্ছে না।
দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করেন। এই শিল্প থেকে গত ১০ বছরে সরকার বিভিন্ন হেডে মাত্র ২২২ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। এ সেক্টরের শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও কল্যাণে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, যে কারণে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে শ্রমিকরা মৃত্যুবরণ করেন, অনেকে হন আহত ও পঙ্গু; আবার অনেক অঘটনের খবর যথাযথভাবে প্রকাশও হয় না। কারণ, মালিকপক্ষ খুবই সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী এবং তাদের ভাগ্য রাতারাতি আলাদিনের চেরাগের মতো বদল হচ্ছে, কিন্তু শ্রমিকদের দুর্দশার আঁধার রাতের সকাল হচ্ছে না। শ্রমিক সংগঠন এবং তাদের অনুকূলের শক্তি দুর্বল। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির আশীর্বাদ তৈরি পোশাক শিল্প আশির দশকে ৫০টি পোশাক কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এ সেক্টরটি বর্তমানে আমাদের জাতীয় রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ অবদান রাখে এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে। এ সেক্টরটি দ্রুত এমন উন্নয়নশীল সেক্টর হিসেবে স্থান করে নিয়েছে যে, আগামী ১০ বছরে যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে তা হলে আরও ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে। এ সেক্টরের বিশেষত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-সমাজকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করা। কারণ, এ সেক্টরে কর্মরত প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৭০ ভাগ মহিলা শ্রমিক। এ শিল্পের শ্রমিকদের অধিকাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুল্লেখযোগ্য। দেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষ এ সেক্টরের অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
আমাদের দেশে শ্রমিকদের কল্যাণে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তার অনেক কিছুই আলোর মুখ দেখে না। ফলে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ও শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ শক্তি লাভবান হয়। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তথা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাসের ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিক কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মহাজোট সরকারের আমলে গৃহীত পদক্ষেপগুলো দ্রুত সম্পন্ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রায় আট লাখ শূন্য পদে জনবল নিয়োগের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্নকরণ করতে হবে। ওভার অল লেবার ডিপার্টমেন্টকে আপডেট করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কারণ দেশে প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প-কারখানা এবং দোকানপাটগুলোর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও পরিদর্শনসহ শ্রম প্রশাসনের কাজের ব্যাপ্তি অনুপাতে এই পরিদফতরের বর্তমান কলেবর একেবারেই অপ্রতুল। শ্রম আইনের আওতাধীন লেবার কোর্ট দ্রুত জেলা আদালতের সহকারী বা সাব-জজ আদালতের এখতিয়ারাধীন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মোবাইল কোর্টের আওতাধীন করতে না পারলে শ্রম আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হবে।
জগএ সহ ঊচত-এর শ্রমিকদের শ্রম আইনের সুরক্ষা ও সুবিধা দেওয়া উচিত। দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসএমই ঋণব্যবস্থাকে শহরমুখী লবিংবাজদের খপ্পর থেকে বের করে এনে সমাজের হতদরিদ্র, অদক্ষ, অসহায়, শিক্ষিত বেকার ও কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের মধ্যে সম্প্রসারিত করা দরকার। অপ্রাতিষ্ঠানিক তথা অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তির পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, বীমা, পেনশনসহ অন্যান্য শ্রম আইনের আওতায় শ্রমিক হিসেবে তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা উচিত।
যে পাঁচ দশমিক পাঁচ কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে, সেখানে শ্রমজীবী মানুষের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা উচিত। কারণ, দেশের জাতীয় শ্রমবাজারের নারীর অংশগ্রহণ ও উপস্থিতির হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের গৃহীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা মানবিক ও নারীবান্ধব হওয়ায় জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনের মূল স্রোতধারায় নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গবল্পুব্দ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে 'বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে' এই দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ উচ্চারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। মহান মে দিবসের চেতনা এবং বঙ্গবল্পুব্দর স্বপ্নের শোষণহীন ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক ও শিল্পবান্ধব এক দক্ষ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান নির্দিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন, যে কারণে তার শাসনামলে শিল্পক্ষেত্রে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি শ্রমিক অসন্তোষও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে রফতানি বাণিজ্যসহ জিডিপি, রেমিটেন্স ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান এবং দক্ষ মানবসম্পদ বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণেই তার গৃহীত শ্রমিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমগুলো গতিশীল ও জনসম্পৃক্ত করার কর্মকৌশল সঠিকভাবে গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করাটাই এখন সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি হিসেবে শ্রমিক সমাজকে সংগঠিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত করতে তাদের কল্যাণ ও অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে। অবারিত করতে হবে তাদের ট্রেড ইউনিয়ন ও দর কষাকষি করার মতো মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের পথ। মহান মে দিবসের শিক্ষা শুধু শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শাণিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া নয়, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আর্থসামাজিক মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করার বিষয়টিও এদিনের অঙ্গীকারের অংশ হওয়া উচিত।
মোঃ ইসরাফিল আলম এমপি : সভাপতি
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
একশ' পঁচিশ বছর আগে ১ মে ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে মকরম্যাক রিপার ওয়ার্কস নামক শিল্প প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনরত শ্রমিকদের রক্তদানের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল মহান মে দিবস। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুগ যুগ ধরে শ্রমিক সমাজকে অনেক রক্ত ও প্রাণ দিতে হয়েছে, যার শেষ আজও হয়নি। তাদের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নির্যাতন, নিপীড়ন ও ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শাসকশ্রেণীর নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব হারিয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েন। ১৮৮৬ সালের মে মাসের ৪ তারিখে হে মার্কেট স্কয়ারে প্রতিবাদের জন্য আয়োজিত সমাবেশে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শোষকশ্রেণীর কতিপয় সন্ত্রাসী চক্র বোমা নিক্ষেপ করলে শ্রমিক ও কয়েকজন পুলিশ মারা যায়। ১৮৮৬ সালের দ্বিতীয়ার্থে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সুশৃঙ্খল ও সুনির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার নামক সংগঠন গড়ে ওঠে। পরিবেশে ওয়ালস হিভেল অ্যাক্ট এবং ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট প্রণীত হয়, যার মাধ্যমে ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদনের দাবি স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীকালে শ্রমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। জন্মলগ্ন থেকে আইএলও এ পর্যন্ত প্রায় ১৮৯টি সাধারণ কনভেনশন এবং ৮টি কোর কনভেনশন গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে ৩৩টি সাধারণ ও ৭টি কোর কনভেনশন স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন করেছে। তবে কর্মক্ষেত্রে নূ্যনতম বয়স নির্ধারণ সম্পর্কিত ১৩৮ নম্বর কোর কনভেনশন অনুসমর্থন না করলেও বাংলাদেশের শিশু শ্রমনীতি ২০১০ এবং শ্রম আইন ২০০৬-এর মধ্যে যেহেতু ওই কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শ্রমিকের নূ্যনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে, সেহেতু অবশিষ্ট কোর কনভেনশনটি অনুসমর্থন করতে বাংলাদেশের ঝুঁকি বা সমস্যা নেই। তাই ১৩৮ নম্বর কোর কনভেনশনটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অনুসমর্থন করা উচিত।
্ববর্তমান বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এসব শ্রমিকের নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, চাকরির নিশ্চয়তা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বলতে কোনো কিছুই নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে কৃষিনির্ভর অথচ কৃষি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন তো দূরের কথা কোনো সংগঠনই নেই। প্রতি বছর ৫ ভাগের ৪ ভাগ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান পায়। দেশের রাজধানী ঢাকা শহরেই কর্মরত মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়। তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ২ লাখ থেকে ২.৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, বেসরকারি পর্যায়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ, আত্মকর্মসংস্থানে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ এবং বর্তমানে প্রবাসে প্রতি বছর ৪ লাখ থেকে ৪.১৫ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে (যদি বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে)। প্রতি বছর আমাদের প্রায় ৪-৫ লাখ শ্রমশক্তি কর্মসংস্থানের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজারে এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি করাটাই এই বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হতে পারে।
স্বাধীনতার পর নগরায়ন ও নগরবাসীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির পাঁচ শতাংশের কম প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। যে কারণে শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠনগুলো দুর্বল এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য বহুভাগে বিভক্ত। তাই বাংলাদেশে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের সর্বস্তরে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বের দক্ষতা ও গুণগত মান এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক স্তরে উপনীত হয়েছে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সেক্টরে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও মজুরি কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চরম অমানবিক পর্যায়ে নিমজ্জিত থাকলেও শ্রমিক আন্দোলনের সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের জন্য অর্থবহভাবে কিছুই করা যাচ্ছে না।
দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে অনেক শ্রমিক কাজ করেন। এই শিল্প থেকে গত ১০ বছরে সরকার বিভিন্ন হেডে মাত্র ২২২ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে। এ সেক্টরের শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও কল্যাণে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, যে কারণে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে শ্রমিকরা মৃত্যুবরণ করেন, অনেকে হন আহত ও পঙ্গু; আবার অনেক অঘটনের খবর যথাযথভাবে প্রকাশও হয় না। কারণ, মালিকপক্ষ খুবই সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী এবং তাদের ভাগ্য রাতারাতি আলাদিনের চেরাগের মতো বদল হচ্ছে, কিন্তু শ্রমিকদের দুর্দশার আঁধার রাতের সকাল হচ্ছে না। শ্রমিক সংগঠন এবং তাদের অনুকূলের শক্তি দুর্বল। আমাদের জাতীয় অর্থনীতির আশীর্বাদ তৈরি পোশাক শিল্প আশির দশকে ৫০টি পোশাক কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এ সেক্টরটি বর্তমানে আমাদের জাতীয় রফতানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ অবদান রাখে এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে। এ সেক্টরটি দ্রুত এমন উন্নয়নশীল সেক্টর হিসেবে স্থান করে নিয়েছে যে, আগামী ১০ বছরে যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে তা হলে আরও ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে। এ সেক্টরের বিশেষত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-সমাজকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করা। কারণ, এ সেক্টরে কর্মরত প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৭০ ভাগ মহিলা শ্রমিক। এ শিল্পের শ্রমিকদের অধিকাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুল্লেখযোগ্য। দেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষ এ সেক্টরের অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
আমাদের দেশে শ্রমিকদের কল্যাণে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তার অনেক কিছুই আলোর মুখ দেখে না। ফলে একদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ও শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ শক্তি লাভবান হয়। তাই এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তথা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাসের ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিক কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মহাজোট সরকারের আমলে গৃহীত পদক্ষেপগুলো দ্রুত সম্পন্ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রায় আট লাখ শূন্য পদে জনবল নিয়োগের কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্নকরণ করতে হবে। ওভার অল লেবার ডিপার্টমেন্টকে আপডেট করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কারণ দেশে প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প-কারখানা এবং দোকানপাটগুলোর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও পরিদর্শনসহ শ্রম প্রশাসনের কাজের ব্যাপ্তি অনুপাতে এই পরিদফতরের বর্তমান কলেবর একেবারেই অপ্রতুল। শ্রম আইনের আওতাধীন লেবার কোর্ট দ্রুত জেলা আদালতের সহকারী বা সাব-জজ আদালতের এখতিয়ারাধীন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মোবাইল কোর্টের আওতাধীন করতে না পারলে শ্রম আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হবে।
জগএ সহ ঊচত-এর শ্রমিকদের শ্রম আইনের সুরক্ষা ও সুবিধা দেওয়া উচিত। দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসএমই ঋণব্যবস্থাকে শহরমুখী লবিংবাজদের খপ্পর থেকে বের করে এনে সমাজের হতদরিদ্র, অদক্ষ, অসহায়, শিক্ষিত বেকার ও কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষের মধ্যে সম্প্রসারিত করা দরকার। অপ্রাতিষ্ঠানিক তথা অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তির পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, বীমা, পেনশনসহ অন্যান্য শ্রম আইনের আওতায় শ্রমিক হিসেবে তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা উচিত।
যে পাঁচ দশমিক পাঁচ কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে, সেখানে শ্রমজীবী মানুষের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা উচিত। কারণ, দেশের জাতীয় শ্রমবাজারের নারীর অংশগ্রহণ ও উপস্থিতির হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের গৃহীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা মানবিক ও নারীবান্ধব হওয়ায় জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনের মূল স্রোতধারায় নারীর অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি পাবে।
বঙ্গবল্পুব্দ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে 'বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে' এই দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জ উচ্চারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। মহান মে দিবসের চেতনা এবং বঙ্গবল্পুব্দর স্বপ্নের শোষণহীন ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সরকারপ্রধান হিসেবে ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক ও শিল্পবান্ধব এক দক্ষ রাষ্ট্রনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান নির্দিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন, যে কারণে তার শাসনামলে শিল্পক্ষেত্রে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি শ্রমিক অসন্তোষও হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে রফতানি বাণিজ্যসহ জিডিপি, রেমিটেন্স ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান এবং দক্ষ মানবসম্পদ বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণেই তার গৃহীত শ্রমিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমগুলো গতিশীল ও জনসম্পৃক্ত করার কর্মকৌশল সঠিকভাবে গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করাটাই এখন সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি হিসেবে শ্রমিক সমাজকে সংগঠিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত করতে তাদের কল্যাণ ও অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে হবে। অবারিত করতে হবে তাদের ট্রেড ইউনিয়ন ও দর কষাকষি করার মতো মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের পথ। মহান মে দিবসের শিক্ষা শুধু শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে শাণিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া নয়, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের জাতীয় আর্থসামাজিক মুক্তির পথকে ত্বরান্বিত করার বিষয়টিও এদিনের অঙ্গীকারের অংশ হওয়া উচিত।
মোঃ ইসরাফিল আলম এমপি : সভাপতি
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
No comments