মে দিবস-শ্রমজীবীদের স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের দিন
আজ মে দিবস, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। দুনিয়াব্যাপী এদিনটি নানা উৎসব-আয়োজনে পালিত হবে। বাংলাদেশে আজ রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন। সরকারও এদিনটি পালনের জন্য যথেষ্ট উদ্যোগী। অনেক আড়ম্বরপূর্ণ কর্মসূচিরও আয়োজন হয়ে থাকে এদিনে।
কিন্তু এ থেকে এমন ধারণা করা ঠিক হবে না যে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে কিংবা মে দিবস তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের মূল দাবি নিয়ে সংঘটিত এ আন্দোলন বিজয় অর্জনের পর সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের কাছেই এর আবেদন বেশি ছিল। তারা সমাজ বিপল্গবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এদিনে নতুন করে শপথ গ্রহণ করত। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে নতুন ও জোরদার লড়াইয়ের ডাক দিত; কিন্তু এখন এর পরিসর আরও ব্যাপক। শুধু কলকারখানার শ্রমিক নয়, কায়িক শ্রমে যুক্ত সবার কাছেই এখন মে দিবস অনুপ্রেরণার দিন। এমনকি কৃষি খাতে নিযুক্ত মজুরদের কাছেও পেঁৗছে গেছে এ দিবসের মর্মবাণী_ ৮ ঘণ্টা কাজ চাই। উন্নত জীবনধারণের মতো মজুরি চাই। সমৃদ্ধ দেশগুলোর শিল্প শ্রমিকরা অনেক আগেই এ অধিকার আদায় করে নিয়েছে। কোথাও কোথাও সপ্তাহে শ্রমঘণ্টা ৪০ ঘণ্টারও কম। আধুনিক প্রযুক্তি তাদের জন্য এ সুবিধা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরাও এ অধিকার ভোগ করছে। কিন্তু যে হাজার হাজার অসংগঠিত ও ছোট-মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ শ্রমিক কাজ করছে, সেখানে এ অধিকার দারুণভাবে উপেক্ষিত। নানা কৌশলে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কিংবা তার চেষ্টা চলছে। প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের তৈরি পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এখানে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রদানের জন্য চাপ আসছে এ পোশাকের ক্রেতা দেশগুলোর দিক থেকে। দশকের পর দশক ধরে শ্রমিকশ্রেণী যে আদর্শবাদের চেতনাকে ক্রমাগত শাণিত করে এসেছে তা যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়নের যুগে শ্রমিক শ্রেণী ছিল উৎপাদন সম্পর্কের কেন্দ্রে। সমাজ পরিবর্তনে তাদের অগ্রণী শুধু নয়, নেতৃত্বের ভূমিকাও স্বীকৃত হচ্ছিল দেশে দেশে। কিন্তু এখন যেন সবই অতীতের বিষয়। কায়িক শ্রমে যুক্ত মানুষগুলো আধুনিকতার বেশ কিছু সুফল ভোগ করছে ঠিকই; কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাফল্য প্রয়োগ করে অর্থনীতির যে অভাবিত উন্নতি ঘটছে, তার সুফল ভোগে তারা একেবারেই প্রান্তিক অবস্থানে। মানবজাতির সম্মিলিত ভাণ্ডারে কিংবা দেশে দেশে যে বিপুল সম্পদ জমা হচ্ছে, তার বণ্টনে রয়েছে প্রবল বৈষম্য। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। এখানে আর্থ-সামাজিক উন্নতির মাত্রা লক্ষণীয় নয় বটে, তবে চরম দারিদ্র্য কমছে। কিন্তু তারপরও মোট জনসংখ্যার অন্তত এক-পঞ্চমাংশ জীবন কাটায় চরম দারিদ্র্যের পরিবেশে। তারা কাজ করতে চায়; কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট। যেখানে কাজ আছে, তার অনেক প্রতিষ্ঠানেই সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার অনেক সময় উপেক্ষিত থাকে। এবারের মে দিবসে এদিকে মনোযোগ বাড়বে, এমন প্রত্যাশা থাকবে। ট্রেড ইউনিয়নের নামে নৈরাজ্য কিংবা বিশৃঙ্খলা কেউ সমর্থন করবে না। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থা শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে এবং তা অর্থনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনার সহায়ক। মে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের শ্রমজীবী প্রতিটি মানুষকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তাদের জীবনে আসুক সুখ, সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি।
No comments