তথ্য অধিকার আইন-তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব কে নেবেন by মশিউল আলম
২৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক তথ্য জানার অধিকার দিবস উপলক্ষে দেশের নাগরিক-সমাজের হতাশার কথা জানা গেল। অনেকগুলো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত তথ্য অধিকার ফোরাম নামের একটি যৌথ মঞ্চ সেদিন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করেছে।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের মার্চ মাসে তথ্য অধিকার আইন নামের যে আইন পাস করেছে, সেটির বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে তাঁরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে দ্রুততম সময়ে তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা আরও দাবি করেছেন, তথ্য কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক, তা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হোক। এ ছাড়া জনস্বার্থে সম্পাদিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হোক এবং সেগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক।
৩ অক্টোবর আগারগাঁও গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভবনে বাংলাদেশ তথ্য কমিশনের কার্যালয়ে প্রধান তথ্য কমিশনার এম জমির জানালেন, কমিশন গত মার্চ মাসে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেটি সংসদকে দেওয়া হয়েছে; সংসদ সদস্যরা তথ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের জুলাইতে তথ্য কমিশন গঠন থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ মাস কমিশন কী কী কাজ করেছে তার বিবরণ রয়েছে। কমিশনের প্রধান কাজের মধ্যে ছিল জেলায় জেলায় গিয়ে আইনটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সভা-বৈঠক করা। কিন্তু আইন অনুযায়ী কাজটি তথ্য কমিশনের প্রধান দায়িত্ব নয়। প্রধান কাজ হলো, নাগরিকরা তথ্য চেয়ে না পেলে তার প্রতিকার করা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তথ্য কমিশনে কোনো নাগরিক গিয়ে বলেননি যে তিনি তথ্য চেয়ে পাননি, তাই কমিশনের কাছে আরজি নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ এখনো শুরু হয়নি বললেই চলে।
আইনটি বাস্তবায়নের জন্য একদম প্রথমেই যে কাজ করা প্রয়োজন তা হলো, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থ ব্যয় করে বা বিদেশি সাহায্য পায়, তথ্য অধিকার আইনে যাদের ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেসব কর্তৃপক্ষের প্রত্যেক ইউনিটে একজন করে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। এই কর্মকর্তা নিয়োগ না করা পর্যন্ত তথ্য চেয়ে আবেদন করারই কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ শুরুই করা যায় না। তাই তথ্য অধিকার আইনে স্পষ্ট ভাষায় সময় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব ইউনিটে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা নিয়োগ করতে হবে। ৬০ দিন অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যেই যে কাজটি সম্পন্ন করার নির্দেশনা খোদ আইনেই দেওয়া আছে, সেটি সম্পন্ন হয়নি ১৪ মাসেও।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মোট কতজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে সে হিসাব কারও কাছে নেই। তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিমের অনুমান, এ সংখ্যা হবে প্রায় ছয় লাখ। অবশ্য অনেকের ধারণা, এত বেশি নয়। তবে যা-ই হোক না কেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এই সংখ্যা দুই লাখের বেশি হতে পারে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। তথ্য কমিশন বলছে, প্রতিদিনই নিয়োগ চলছে, নতুন নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম তাঁদের কাছে প্রতিদিনই আসছে। এগুলো হচ্ছে সরকারি পর্যায়ে। বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগে বড়ই অনীহা লক্ষ করছে তথ্য কমিশন। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, যেসব এনজিও এতকাল তথ্য অধিকার আইন পাসের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তাদের মধ্যেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগে গড়িমসি প্রবল। প্রধান তথ্য কমিশনার এম জমির জানালেন, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে মাত্র ১০টি এনজিও তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছিল। তারপর কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিকবার কড়া ভাষায় তাগাদা দেওয়ার পর আরও কিছু এনজিও কাজটি করেছে, কিন্তু এখনো সে সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। অনেক বড় বড়, খ্যাতিমান এনজিও তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেনি বলে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন প্রধান তথ্য কমিশনার।
যতক্ষণ পর্যন্ত তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ হতে পারছে না। এভাবে আইনের একটি নির্দেশনা দীর্ঘ সময় ধরে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বা অধীনস্থ অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা কার্যালয় ও উপজেলা কার্যালয়কে একজন করে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। কাজটি কোথাও আগে হচ্ছে, কোথাও পরে হচ্ছে, কেন সব ইউনিটে একই সঙ্গে হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিন মাসের মধ্যে যে কাজ শেষ করার কথা, ১৪ মাসে সম্পন্ন হয়েছে তার অতি সামান্য অংশ—এটি একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে।
প্রধান তথ্য কমিশনার এই ক্ষেত্রে কতকগুলো বাস্তবিক সমস্যা লক্ষ করেছেন। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি ইতিমধ্যে কোনো না কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, তাঁর ওপর বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে যখন তথ্য প্রদানের দায়িত্ব আরোপ করা হবে তখন তিনি কেন তা গ্রহণে উৎসাহ বোধ করবেন? এটি প্রধান তথ্য কমিশনের জিজ্ঞাসা। কারণ এই দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো কর্মকর্তাকে বাড়তি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর তথ্য কমিশনকে জানাতে হবে, তিনি তথ্য প্রদানসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেটি ব্যবহার করবেন, কিন্তু সেই খরচ তাঁকে সরকার দেবে না। এটি একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, একটি অফিসের সব বিষয়ে তথ্য জনগণকে জানানোর দায়িত্ব পালন করা এক বিরাট দায়িত্ব। আইন অনুযায়ী কোনো নাগরিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো তথ্য চেয়ে আবেদন করলে আবেদনপত্র গ্রহণের দিন থেকে পরবর্তী ২০ দিনের মধ্যে সেই তথ্য তাঁকে সরবরাহ করতে হবে। তথ্যটি কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা যেমন একটি সমস্যা, তেমনই নিয়মিত অন্যান্য স্থায়ী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদনকারীকে তথ্য দিতে না পারেন, যদি অসুস্থ হন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে অন্যভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁর তথ্য প্রদানের দায়িত্ব পালন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কীভাবে সম্ভব? প্রধান তথ্য কমিশনার বললেন, বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা উচিত: দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কিছু আর্থিক প্রণোদনা, নিদেনপক্ষে মোবাইল ফোনের খরচ দেওয়া হলে তাঁরা উৎসাহিত বোধ করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, প্রত্যেকটি ইউনিটে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একজন করে বিকল্প কর্মকর্তা থাকা উচিত, যাতে একজনের অনুপস্থিতি বা অসুস্থতার সময় বিকল্প কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করতে বাস্তবিক ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন তিনি হচ্ছেন তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একজন নাগরিক তথ্য চাইতে সর্বপ্রথমে হাজির হবেন তাঁরই দুয়ারে। তিনি তথ্যপ্রার্থী নাগরিকের প্রতিপক্ষ নন, বরং সহযোগী। এই সহযোগিতার দ্বারা তিনি জনসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। প্রার্থিত তথ্য যেন তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্যপ্রার্থী নাগরিকের হাতে তুলে দিতে পারেন, তার সব ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বস্তুত সে লক্ষ্যে কোনো কাজই এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সার্বিক সামর্থ্য বাড়াতে হবে; হাতের কাছেই যেন সব তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত থাকে, যেন নাগরিকেরা চাওয়ামাত্র তিনি তা সরবরাহ করতে পারেন, যেন তাঁকে অপারগতা প্রকাশ করতে না হয় এবং সে জন্য তথ্য কমিশনের সামনে আসামির মতো হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে না হয়, সে রকম একটি সমৃদ্ধ তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ সামনে রয়েছে। এই কাজটি বিরাট। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের দায়িত্ব সরকারের (তথ্য কমিশনের নয়)। এর একদম প্রাথমিক প্রস্তুতির ধাপটি হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। যত দ্রুত সম্ভব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের কাজটি শেষ করা প্রয়োজন। কারণ এরপর তাঁদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজগুলো করতে হবে দ্রুতগতিতে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
৩ অক্টোবর আগারগাঁও গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভবনে বাংলাদেশ তথ্য কমিশনের কার্যালয়ে প্রধান তথ্য কমিশনার এম জমির জানালেন, কমিশন গত মার্চ মাসে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেটি সংসদকে দেওয়া হয়েছে; সংসদ সদস্যরা তথ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওই প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের জুলাইতে তথ্য কমিশন গঠন থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ মাস কমিশন কী কী কাজ করেছে তার বিবরণ রয়েছে। কমিশনের প্রধান কাজের মধ্যে ছিল জেলায় জেলায় গিয়ে আইনটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সভা-বৈঠক করা। কিন্তু আইন অনুযায়ী কাজটি তথ্য কমিশনের প্রধান দায়িত্ব নয়। প্রধান কাজ হলো, নাগরিকরা তথ্য চেয়ে না পেলে তার প্রতিকার করা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তথ্য কমিশনে কোনো নাগরিক গিয়ে বলেননি যে তিনি তথ্য চেয়ে পাননি, তাই কমিশনের কাছে আরজি নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ এখনো শুরু হয়নি বললেই চলে।
আইনটি বাস্তবায়নের জন্য একদম প্রথমেই যে কাজ করা প্রয়োজন তা হলো, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থ ব্যয় করে বা বিদেশি সাহায্য পায়, তথ্য অধিকার আইনে যাদের ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, সেসব কর্তৃপক্ষের প্রত্যেক ইউনিটে একজন করে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। এই কর্মকর্তা নিয়োগ না করা পর্যন্ত তথ্য চেয়ে আবেদন করারই কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ আইনের প্রয়োগ শুরুই করা যায় না। তাই তথ্য অধিকার আইনে স্পষ্ট ভাষায় সময় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব ইউনিটে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা নিয়োগ করতে হবে। ৬০ দিন অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যেই যে কাজটি সম্পন্ন করার নির্দেশনা খোদ আইনেই দেওয়া আছে, সেটি সম্পন্ন হয়নি ১৪ মাসেও।
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মোট কতজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে সে হিসাব কারও কাছে নেই। তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিমের অনুমান, এ সংখ্যা হবে প্রায় ছয় লাখ। অবশ্য অনেকের ধারণা, এত বেশি নয়। তবে যা-ই হোক না কেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এই সংখ্যা দুই লাখের বেশি হতে পারে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। তথ্য কমিশন বলছে, প্রতিদিনই নিয়োগ চলছে, নতুন নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম তাঁদের কাছে প্রতিদিনই আসছে। এগুলো হচ্ছে সরকারি পর্যায়ে। বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগে বড়ই অনীহা লক্ষ করছে তথ্য কমিশন। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, যেসব এনজিও এতকাল তথ্য অধিকার আইন পাসের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তাদের মধ্যেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগে গড়িমসি প্রবল। প্রধান তথ্য কমিশনার এম জমির জানালেন, ২০০৯ সালের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে মাত্র ১০টি এনজিও তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছিল। তারপর কমিশনের পক্ষ থেকে একাধিকবার কড়া ভাষায় তাগাদা দেওয়ার পর আরও কিছু এনজিও কাজটি করেছে, কিন্তু এখনো সে সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। অনেক বড় বড়, খ্যাতিমান এনজিও তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেনি বলে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন প্রধান তথ্য কমিশনার।
যতক্ষণ পর্যন্ত তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ হতে পারছে না। এভাবে আইনের একটি নির্দেশনা দীর্ঘ সময় ধরে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বা অধীনস্থ অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয় কার্যালয়, আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা কার্যালয় ও উপজেলা কার্যালয়কে একজন করে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। কাজটি কোথাও আগে হচ্ছে, কোথাও পরে হচ্ছে, কেন সব ইউনিটে একই সঙ্গে হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিন মাসের মধ্যে যে কাজ শেষ করার কথা, ১৪ মাসে সম্পন্ন হয়েছে তার অতি সামান্য অংশ—এটি একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে।
প্রধান তথ্য কমিশনার এই ক্ষেত্রে কতকগুলো বাস্তবিক সমস্যা লক্ষ করেছেন। যেমন, একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি ইতিমধ্যে কোনো না কোনো দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, তাঁর ওপর বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে যখন তথ্য প্রদানের দায়িত্ব আরোপ করা হবে তখন তিনি কেন তা গ্রহণে উৎসাহ বোধ করবেন? এটি প্রধান তথ্য কমিশনের জিজ্ঞাসা। কারণ এই দায়িত্ব পালনের জন্য কোনো কর্মকর্তাকে বাড়তি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর তথ্য কমিশনকে জানাতে হবে, তিনি তথ্য প্রদানসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেটি ব্যবহার করবেন, কিন্তু সেই খরচ তাঁকে সরকার দেবে না। এটি একটি দিক। আরেকটি দিক হলো, একটি অফিসের সব বিষয়ে তথ্য জনগণকে জানানোর দায়িত্ব পালন করা এক বিরাট দায়িত্ব। আইন অনুযায়ী কোনো নাগরিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো তথ্য চেয়ে আবেদন করলে আবেদনপত্র গ্রহণের দিন থেকে পরবর্তী ২০ দিনের মধ্যে সেই তথ্য তাঁকে সরবরাহ করতে হবে। তথ্যটি কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা যেমন একটি সমস্যা, তেমনই নিয়মিত অন্যান্য স্থায়ী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদনকারীকে তথ্য দিতে না পারেন, যদি অসুস্থ হন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে অন্যভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁর তথ্য প্রদানের দায়িত্ব পালন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কীভাবে সম্ভব? প্রধান তথ্য কমিশনার বললেন, বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা উচিত: দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কিছু আর্থিক প্রণোদনা, নিদেনপক্ষে মোবাইল ফোনের খরচ দেওয়া হলে তাঁরা উৎসাহিত বোধ করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি মনে করেন, প্রত্যেকটি ইউনিটে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের একজন করে বিকল্প কর্মকর্তা থাকা উচিত, যাতে একজনের অনুপস্থিতি বা অসুস্থতার সময় বিকল্প কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করতে বাস্তবিক ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন তিনি হচ্ছেন তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। একজন নাগরিক তথ্য চাইতে সর্বপ্রথমে হাজির হবেন তাঁরই দুয়ারে। তিনি তথ্যপ্রার্থী নাগরিকের প্রতিপক্ষ নন, বরং সহযোগী। এই সহযোগিতার দ্বারা তিনি জনসেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। প্রার্থিত তথ্য যেন তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্যপ্রার্থী নাগরিকের হাতে তুলে দিতে পারেন, তার সব ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বস্তুত সে লক্ষ্যে কোনো কাজই এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সার্বিক সামর্থ্য বাড়াতে হবে; হাতের কাছেই যেন সব তথ্য সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত থাকে, যেন নাগরিকেরা চাওয়ামাত্র তিনি তা সরবরাহ করতে পারেন, যেন তাঁকে অপারগতা প্রকাশ করতে না হয় এবং সে জন্য তথ্য কমিশনের সামনে আসামির মতো হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে না হয়, সে রকম একটি সমৃদ্ধ তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ সামনে রয়েছে। এই কাজটি বিরাট। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের দায়িত্ব সরকারের (তথ্য কমিশনের নয়)। এর একদম প্রাথমিক প্রস্তুতির ধাপটি হচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। যত দ্রুত সম্ভব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের কাজটি শেষ করা প্রয়োজন। কারণ এরপর তাঁদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজগুলো করতে হবে দ্রুতগতিতে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
No comments