শহীদ সাবেরকে যেন ভুলে না যাই by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শহীদ সাবের জেলে যান ১৯৫০ সালে, যখন তিনি সদ্য ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন, চট্টগ্রামে। সেকালের অসংখ্য রাজবন্দির মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। তারপর বিনা বিচারে চার বছর আটক ছিলেন কারাগারে। বন্দি অবস্থা থেকে আইএ পাস করেন; প্রস্তুতি নিয়েছেন প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে বিএ পরীক্ষা দেওয়ার।


মুক্তি পেয়েছেন ১৯৫৪ সালে। কিন্তু আক্রান্ত হয়েছেন অর্থনৈতিক সংকটে, যে সংকট রাষ্ট্র তৈরি করেছে সাধারণ মানুষের জন্য। শুধু আপনার ছেলেই নয়, সমাজেরও। রাজবন্দি হয়ে বিনা বিচারে একটানা চার বছর জেলে কাটাতে হয়েছে, যাঁর কথা ভাবলে একই সঙ্গে দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ হতে হয়। দুঃখ ও ক্ষোভ রাষ্ট্রের নিপীড়নকারী চরিত্রটি দেখে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কেমন নিষ্ঠুর ছিল তার অসংখ্য নিদর্শন আমাদের চারদিকে ছড়ানো রয়েছে_সেগুলোর একটি হলো শহীদ সাবেরের জীবন ও মৃত্যু। একাত্তরের ৩১ মার্চ তিনি শহীদ হন।
কলেজপড়ুয়া বন্দি অল্প বয়সী ছেলেটি কী পরিষ্কারভাবে সমাজব্যবস্থাটাকে বুঝে নিয়েছে। বাবা বলেছেন জাতীয় সরকার দেশ শাসন করছে; উল্টো সন্তান বলেছে, 'এটা আমাদের জাতীয় সরকার নয়, এ সরকার ইস্পাহানী-হারুনদের, পীরদের-মীরদের, বড় বড় ধনীদের। তারা জাতি নয়, তার বাইরে রয়েছে মধ্যবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, প্রভৃতি বুদ্ধিজীবী শোষিত শ্রেণী। বর্তমান সরকার তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না।' শ্রেণী ও জাতি যে এক নয়, এবং পাকিস্তানি শাসকরা যে শ্রেণীশোষণকে আড়াল করার জন্যই জাতি গঠনের হট্টগোল বাধিয়েছিল, সে সত্যটি শহীদ সাবেরের কাছে মোটেই অস্পষ্ট ছিল না। অথচ সে তখন কলেজে পড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত এবং সময়টা হচ্ছে বায়ান্নার আগে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখনো হয়নি, স্বাধীনতা এনে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র। শহীদ সাবেরের সর্বাধিক পরিচিত, ছোট কিন্তু চাঞ্চল্যকর 'আরেক দুনিয়া থেকে' নামের রচনাটি। এটি তিনি চট্টগ্রাম জেলে বন্দি অবস্থায়ই লিখেছেন এবং কারামুক্ত হওয়ার আগেই তা তখনকার দিনে কলকাতার সবচেয়ে প্রগতিশীল বলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মাসিক পত্রিকা নতুন সাহিত্যে প্রকাশিত হয়। কারারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে এটি বাইরে পাঠানো হয়েছিল, বাংলা ১৩৫৭ অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৫১ সালে। আর বলাবাহুল্য, শহীদ সাবেরের নিজের নামে তা প্রকাশিত হয়নি, লেখক হিসেবে নাম ছাপা হয়েছিল জনৈক জামিল হোসেনের। রচনাটি রাজবন্দির রোজনামচা ধরনের লেখা। উভয় বাংলার পাঠক, লেখকের পরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়েছিলেন। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটির প্রশংসা করে এবং ওই নতুন লেখককে স্বাগত জানিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখেছিলেন।
শহীদ সাবের ১৯৫৪ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হন। তখন তাঁর হাতে অনেক কাজ। সেই ব্যস্ত সময়ে আমি তাঁকে দেখেছি। থাকতেন আমাদের পাড়াতেই। ঢাকার পশ্চিমপ্রান্তের আজিমপুরে সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক এলাকায়। শহীদ সাবেরের বাবার বাসা আমাদের বাসার কাছেই ছিল। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি স্বভাবতই বাবার বাসায় উঠেছিলেন। খুব যে ব্যস্ত সেটা বোঝা যেত তাঁকে কম দেখার ব্যাপারটা থেকেই। পরে জেনেছি তিনি একসঙ্গে অনেক কাজ করছিলেন। জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করলেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলে এবং লিখেছেন_ছোটগল্প, কিশোরদের জন্য রচনা, কবিতা, অনুবাদ। অল্প সময়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি। ১৯৫৫ সালেই তাঁর ছোটগল্পের চমৎকার একটি সংকলন বের হয় 'এক টুকরো মেঘ' নামে; 'ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান' নাম দিয়ে কিশোরদের জন্য একটি সুখপাঠ্য গ্রল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে; তিনটি বিদেশি রচনার অনুবাদও সম্পন্ন করেছিলেন অল্প সময়ে এবং 'কালো মেয়ের স্বপ্ন' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, গানও আছে তাঁর। আইএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিতে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে। জেলের ভেতরে রাষ্ট্রের চেষ্টাটা হলো মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখতে, জেলের বাইরেও সেই একই চেষ্টা চলছিল। অথচ শহীদ সাবের বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন সংঘবদ্ধ হবেন, আন্দোলন করবেন, যোগ দেবেন সমাজ বদলের প্রচেষ্টায়। তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়ে রাষ্ট্র নিজের কর্তব্য করেছে, তাঁকে আটক করেছে জেলখানায়, যাতে তিনি বিচ্ছিন্ন থাকেন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে। জেলখানায় যে তরুণ নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেননি, জেলের বাইরে এসে তিনি কিন্তু দেখেন ভিন্ন অবস্থা। রাজনৈতিক আন্দোলন তখন দেশে নেই। হ্যাঁ, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় হয়তো তাঁর মুক্তিকে সম্ভব করেছে, কিন্তু যুক্তফ্রন্ট তো টেকেনি, খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে; দেশে সামরিক শাসন চলে এসেছে, আবার আত্মগোপনে চলে গেছেন কমিউনিস্টরা; রাষ্ট্র যাঁদের এক নম্বরের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে, একেবারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। অন্যদিকে তাঁর ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে বাবাকে সাহায্য করার। এক কথায় প্রয়োজন দেখা দেয় উপার্জনের। সমাজের জন্য কাজ করবেন কী, নিজের জন্যই কাজ করা জরুরি কর্তব্য হয়ে পড়ে। কারাবন্দি অবস্থায় উপার্জনের প্রয়োজন ছিল না, এরপর তো উপার্জন ছাড়া চলবে না। অন্যদের থেকে তো বটেই, নিজের পরিবার থেকেই তাঁর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম। তিনি তখন কলেজে ভর্তি না হয়েই বিএ পাস করেছেন, চাকরি নিয়েছেন স্কুলে। কেন্দ্রীয় সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিসের (সিএসএস) জন্য পরীক্ষা দেবেন বলে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু চোখের রোগের দরুন অযোগ্য বিবেচিত হবেন মনে করে পরীক্ষা দিলেন না। শহীদ সাবেরের যে মেধা তাঁর রচনাগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে, তা পাঠ করলে কোনো সন্দেহ থাকে না যে পরীক্ষা দিলে তিনি অকৃতকার্য হতেন না। চোখের চিকিৎসা অসম্ভব ছিল বলে অনুমান করি না, কিন্তু সে জন্য ব্যয় করার মতো আর্থিক সংগতি তাঁর নিশ্চয়ই ছিল না। কেন্দ্রীয় ইনফরমেশন সার্ভিসের জন্য পরীক্ষা দিলেন; সে বছরের কৃতকার্যদের ভেতর তাঁর অবস্থান ছিল শীর্ষে; কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দরুন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো না। যে সংশ্লিষ্টতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য শহীদ সাবেরকে বিনা বিচারে চার বছর আটক করে রাখা হয়েছিল, সেই একই অপরাধে পরবর্তীতে সম্মানজনক জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়।
তদুপরি রাষ্ট্র তাঁকে শাস্তি দিচ্ছিল। জেলে পাঠিয়ে শাস্তি দিয়েছে; শাস্তি দিয়েছে বেকার রেখে এবং শেষ পর্যন্ত শাস্তি দিল তাঁকে হত্যা করে। একাত্তরের ৩১ মার্চ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়; শহীদ সাবের তখন ওই অফিসে ছিলেন। অগি্নদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। সংসারী হওয়া তো পরের কথা, তাঁর জন্য কোনো আশ্রয়ই ছিল না। অথচ মেরুদণ্ড শক্ত ছিল, আশাবাদ ছিল প্রচণ্ড। ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না_এমনই ছিল মনোভাব। কারারুদ্ধ অবস্থায় কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, সেগুলোর প্রতিটিতে তাঁর আশাবাদ দেখা যায়। আশা ছিল আন্দোলন বেগবান হবে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতা পাবে। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে সাবের দেখলেন আন্দোলন নেই। ওদিকে অভাব, দারিদ্র্য ও কর্তব্যবোধ দুই দিক থেকে তাঁকে তাড়া করেছে। সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিলেন। সেকালে সাংবাদিকতায় আয় ছিল সীমিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়মিত। তত দিনে তাঁর বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। কর্তব্যপরায়ণ জ্যেষ্ঠপুত্র দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন, বাসা ভাড়া করে মা-বাবা, ভাইবোনদের ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন; কিন্তু আয়ের স্বল্পতার দরুন সঙ্গে রাখতে পারেননি, তাঁরা আবার গ্রামে ফিরে যান। বুকের ভেতর আগুন ছিল, ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। অপচয় ঘটল উভয়েরই। তাঁর নিজের কারণে নয়, রাষ্ট্রের দৌরাত্ম্য। তাঁর লেখাগুলো পড়লে অত্যন্ত গভীর বেদনা জাগে; যার একটা কারণ ওই অপচয়, লেখার সময় পেলেন না। কিন্তু যা লিখেছেন তা হারিয়ে যাবে না 'আরেক দুনিয়া থেকে' তো অবশ্যই। ছোটগল্পগুলোও অসাধারণ।
কারাগারে গিয়ে শহীদ সাবের মনে করেছিলেন সমাজ বদলাবে। সে জন্য করণীয় কী তাও জানা হয়ে গিয়েছিল। সংঘবদ্ধ হতে হবে, লেখার মধ্য দিয়ে তো বটেই, রাজনৈতিক কাজের মধ্য দিয়েও। জেলখানায় থাকাকালে তাঁর খাতায় কয়েকটি উদ্ধৃতি লিখে রেখেছিলেন। উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে একটি ছিল, 'কর্মই হচ্ছে চিন্তার উদ্দেশ্য। যে চিন্তাকে কর্মের দিকে প্রেরণা দেয় না, সে পণ্ডশ্রম। প্রবঞ্চনা মাত্র। অতএব চিন্তার সেবক যদি আমরা হয়ে থাকি, তবে কর্মেরও সেবক আমাদের হতেই হবে।' উদ্ধৃতিটি লেনিনের লেখা থেকে নেওয়া। বোঝা যায় শহীদ সাবেরের চিন্তাধারাটা কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তিনি কেবল চিন্তা নয়, কর্মের সঙ্গেও যুক্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। কারণ, রাষ্ট্র ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং সমাজ-বিপ্লবীরা ছিলেন বিচ্ছিন্ন ও বিভ্রান্ত। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাংলা একাডেমী তাঁকে ছোটগল্পের জন্য মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান করে। সে কাজটি খুবই যথার্থ হয়েছিল বটে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলে রাষ্ট্র কি পারত আগের রাষ্ট্রের কৃতকর্মের চিহ্নগুলো মুছে ফেলে শহীদ সাবেরের জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্তকরণসহ তাঁকে পুনর্বাসিত করতে? মনে হয় না পারত। কেননা, রাষ্ট্র ততটা বদলায়নি, যতটা বদলাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। বদলানোর দায়িত্বটা অবশ্য সেই সব ছেলেমেয়েরই, যারা কেবল নিজ নিজ পরিবারেরই সদস্য নয়, সদস্য সমাজেরও।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.