সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও পুলিশের জবাবদিহি

২ জুন ২০১২ প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও পুলিশের জবাবদিহি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।
আলোচনা আব্দুল কাইয়ুম


সবাই লক্ষ করছি, সাম্প্রতিক সময় পুলিশ খুব বেপরোয়া আচরণ করছে। ইদানীং সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেছে। আদালত প্রাঙ্গণে এক পরিবারকে হেনস্তা করা হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল হরতালের সময় খুলনায় বিএনপির দুজন কর্মীকে থানায় দড়িতে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছিল। ফেনিতে ওসির হাতে অপদস্ত হলেন এসি ল্যান্ড। এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
অন্যদিকে, পুলিশের অনেক সমস্যা আছে। অনেক সময় তাদের ১৫-১৬ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এরপর ব্যারাকে ফিরে দেখে ঘুমোনোর জায়গা নেই। নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয়করণ ও আঞ্চলিকতায় মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হন। এসব কারণে পুলিশের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এসব ঘটনা কীভাবে দেখছেন সা’দত হুসাইন?

সা’দত হুসাইন
আজকে এখানে যে আলোচনা হচ্ছে, এটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হওয়ার কথা। এটা যে শুধু দুটি রাজনৈতিক দলের সমস্যা তা নয়, পুলিশ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। পুলিশের ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে প্রসাশনিক ও সামাজিক সমস্যা। কোনো দেশের পুলিশ বাহিনীর জন্য এটা বিশেষ উদ্বেগের কারণ। যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। আজকে দেশের সব মানুষ চিন্তিত। সবাই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
হঠাৎ করে বা এক দিনে এ সমস্যা তৈরি হয়নি। সম্ভবত কালীগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনায় ওসিকে বলা হয়েছে পাগল। আরও কিছু কিছু জায়গায় এ রকম আছে। দীর্ঘ সময় ধরে এ প্রক্রিয়া চলে আসছে। নিজের ওপর আঘাত আসেনি বলে হয়তো খেয়াল করা হয়নি। আজকে সাংবাদিকের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করায় এত আলোচনা হচ্ছে। একই ঘটনা নিরীহ মানুষের ক্ষেত্রে হচ্ছে। কিন্তু সেটা আলোচনায় আসছে না। এসব কারণে পুরা বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পুলিশ বাহিনীর কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে, চেইন অব কামান্ড ভেঙে পড়ছে। অনেকে মনে করছে, সে তার ওপরের কমকর্তার নির্দেশ পালনে বাধ্য নয় বা তার কোনো অদৃশ্য শক্তি আছে, যে কারণে সে আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে। যারা এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তী সময় সবকিছু খতিয়ে দেখার পর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর এরা কোথা থেকে এসেছে, তাদের পারিবারিক-সামাজিক অতীত (ব্যাকগ্রাউন্ড) দেখতে হবে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একজন মোবাইল ফোন চুরি করেছিল। তখন তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, তাদের একজনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট করে বলা আছে, সে ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এখন পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ-প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের পোস্টিং কোথায় ছিল, সেখানে তাদের রেকর্ড কী—এগুলো দেখতে হবে।
আরেকটি বিপজ্জনক বিষয় হলো, কর্তৃপক্ষ এটিকে সমস্যা হিসেবে স্বীকারই করছে না। বিষয়টি নিয়ে যাদের চিন্তা করার কথা, অনুধাবন করার কথা, স্বীকার করার কথা, তাঁরা সেটা করছেন না। এটা নিয়ে অনেক সময় তাঁরা হাসিঠাট্টা করছেন। কোনো চিন্তাভাবনা করে কথা বলছেন না। তাঁরা পুলিশ থেকে দূরে থাকার কথা বলছেন। এ ধরনের সস্তা কথা বললে কখনো সমস্যার সমাধান হবে না।
বিষয়টি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোনো শ্রেণী-পেশার মানুষের সমস্যা নয়। বিষয়টি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব দলের, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। সবার আন্তরিকতা থাকলে সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু সমস্যাকে হালকা করে দেখে হাসাহাসি করে উড়িয়ে দিলে তা সবার জন্য বিপদ ডেকে আনবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা খুব শঙ্কিত, ভবিষ্যতে এটি কোন পর্যায়ে যায়। দেশের জন্য পুলিশ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পুলিশ বাহিনীর যত ক্ষমতা আছে, অন্য কারও এত ক্ষমতা নেই। এই প্রতিষ্ঠানে চেইন অব কমান্ড না থাকলে, শৃঙ্খলা না থাকলে দেশের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে।
তিনটি প্রাতিষ্ঠান (অর্গানাইজেশন) —পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচার বিভাগ—দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখে। এর কোনো একটি যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, দেশের মানুষের জন্য সেটি খুব শঙ্কার কারণ হয়। পুলিশের যাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তাঁরা আমাদের মতোই শঙ্কিত। তাঁরা নিশ্চয়ই চান না, তাঁদের বাহিনীর খারাপ কোনো পরিণতি হোক। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সম্পূর্ণ পেশাগত দিক থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ও তার পরে আরও কয়েক মাস দায়িত্বে ছিলাম। সব আদেশ দিতাম আইজি সাহেবকে। কোনো দিন কোনো এসপি বা অন্য কাউকে সরাসরি আদেশ দিইনি। তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের সময় সচিব ছিলাম। পরে যিনি এলেন, তিনি ওপর-নিচে সব জায়গায় আদেশ দিতেন। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় চলেও যেতেন। এসব পদ যাঁরা ধারণ করেন, তাঁরা অনেক সময় তাঁদের মর্যাদা বুঝতে পারেন না। পরে অবশ্য তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ভালো-খারাপ কিছু না বলে শুধু বলেছিলাম, তিনি এই পদের যোগ্য নন। সব সময় নিয়ম মানার চেষ্টা করতাম।

আব্দুল কাইয়ুম
পুলিশের কাছে অস্ত্র ও লাঠি থাকে। প্রায় সময় এগুলো মানুষের ওপর নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আত্মরক্ষার্থে পুলিশ অবশ্যই গুলি চালাতে পারে। ওপরের দিক থেকে নির্দেশ কী থাকে, কীভাবে পুলিশ সেটি পালন করে। এ বিষয়ের ওপর বলবেন নুরুল হুদা।

নুরুল হুদা
প্রথমে দুটি ঘটনার বিষয় উল্লেখ করব। একটি দেশের, অন্যটি দেশের বাইরের। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয়েছিল। সে সময় কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ জন সাংবাদিককে পিটিয়ে প্রেসক্লাবের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ড. কামল হোসেন পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক দল এটাকে নিজেদের স্বার্থে দেখেছে। তারা ভেবেছে, এই পুলিশই আমাদের দরকার। সেদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই আজকে মনে হচ্ছে পুলিশ খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর শুরু অনেক আগে থেকেই।
সাংবাদিকেরা জনসাধারণের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন। এ জন্য ঘটনাস্থলের দূরে থাকার উপায় নেই। পুলিশের একটা অভিযোগ হলো, অন্যপক্ষ তাদের আক্রমণ করতে থাকে। যে কারণে পুলিশ কঠিন হতে বাধ্য হয়।
কিন্তু ক্যামেরা শুধু পুলিশের কাজকর্ম ধারণ করে। তাঁরা এমনভাবে চারপাশ ঘিরে থাকেন যে অনেক সময় প্রসাশনিক দায়িত্ব পালন করতে অসুবিধা হয়। পুলিশদের যারা আক্রমণ করছে, তাদের ছবি খুব একটা তোলা হয় না। সেটাও হয়তো একটু ভেবে দেখার বিষয়। এমন কিছু সময় আসে, যখন লাঠি ব্যবহার করা যায় না। লাঠি হয়তো চার থেকে পাঁচ ফুট। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ ফুট দূরে যে মানুষ আছে, তার কাছে ইট-পাথর প্রভৃতি থাকে। এ ক্ষেত্রে তাকে ধরা এবং নিজেকে রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। ক্যামেরায় দুই দিকই আসা উচিত। যেমন, চট্টগ্রামে খেলার সময় পুলিশ কর্মকর্তা একজনকে ঘুষি মেরেছিল। ওই কর্মকর্তার অভিযোগ, সাংবাদিকেরা শুধু ঘুষি মারাটা দেখালেন, কিন্তু এর আগে কী হয়েছিল, তার কিছু দেখালেন না।
মনে হয় যে চেইন অব কামান্ডে কোনো সমস্যা হচ্ছে। জ্যোতি বসুকে একবার বলা হয়েছিল, ‘আপনাকে তো রাত ১০টার পর পাওয়া যায় না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে পাওয়ার তো দরকার নেই। আমাকে দরকার হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজি আছেন কেন। তাঁদের বেতন তো আমাকে দেওয়া হয় না!’ আমাদের দেশে রাত একটা, দুইটার সময় ডাকা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ করে। শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৃঙ্খলা মেনে কাজ করা উচিত। জেলার প্রধানের মাধ্যমে কাজ করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সাম্প্র্রতিক ঘটনার কারণ হলো তত্ত্বাবধানে কোথায়ও শৈথিল্য আছে। শৈথিল্যের কারণ হতে পারে নিয়োগ-প্রক্রিয়া ঠিকমতো না মানা। সঠিকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়া। তা ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত অতীত খুঁজে দেখতে হবে। যখনই কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়, তখনই সাজার ব্যবস্থা করা উচিত। সাজার ব্যবস্থা না থাকলে অন্যরা শিখবে না। রুবেল হত্যার ঘটনায় এসি আকরামের অন্যায় ছিল। এফআইআরের আগেই তাঁকে আটক করা হয়েছিল। তখন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গুরুত্ব না থাকলে শৃঙ্খলা থাকে না।
বাংলাদেশের মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, এ লোক আমার, ও লোক তোমার। সরকারি কর্মচারীরা কখনো আমার-তোমার হতে পারেন না। তাঁরা হবেন সবার। যত দিন পর্যন্ত আমার-তোমার ধারা চলতে থাকবে, তত দিন আইনশৃঙ্খলাসহ সব ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হবে।
পুলিশের কাজ যদি পেশাগতভাবে মূল্যায়ন না করা হয়, এ বাহিনীর পেছনে যদি বিনিয়োগ করা না হয়, এর উৎকর্ষ যদি বৃদ্ধি করা না হয়, তাহলে এ পেশায় নিচু মান থেকে যাবে। নিচু মানের লোকজন মনে করবে, এটিই তাদের প্রকৃত জায়গা। মানুষও একে নিচু মানের কাজ হিসেবে দেখবে। তারা মনে করবে না যে এটি একটি দায়িত্বশীল কাজ, মানসম্মানের কাজ।
পুলিশ বাহিনী একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ বাহিনী। এর মধ্যে জবাবদিহির যথেষ্ট জায়গা আছে। পুলিশের খসড়া আইনে একটি বিষয়ের উল্লেখ আছে, যেটির সঙ্গে আমি একমত। বিষয়টি হলো, সাধারণ জনগণ, বিচার বিভাগ ও নারী প্রতিনিধি নিয়ে একটি বড় পরিসরে (ব্রড বেজড) অভিযোগ কমিশন গঠন করতে হবে। তারা পুলিশের ব্যত্যয় খতিয়ে দেখবে। এ প্রস্তাব পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে এসেছে। সরকার এটি বিবেচনায় নিতে পারে।
জবাবদিহি যে হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। তেজগাঁঁও পলিটেকনিকের ঘটনায় ১০ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত নয়জনের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্মকর্তা বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৬ প্রয়োগ করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত কঠিন আইন, যেখানে ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া যায়। পরে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এর বিরুদ্ধে কোনো আপিল গ্রহণ করা হয় না। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটি আরও দ্রুত নিতে হবে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে অন্যরা বুঝতে পারে, এগুলো করে পার পাওয়া যাবে না। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে, তাদের নিয়োগ কেমন করে হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ঠিক ছিল কি না এবং কর্মস্থলে তাদের কাজের রেকর্ড কী। কিছু খারাপ কর্মী সব চাকরিতে থাকে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
ওপরের দিক থেকে যাদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রত্যয় থাকে এবং সেভাবে যদি নিচের দিকে নির্দেশ থাকে, তাহলেও কি নিচের দিকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের আশঙ্কা থাকে? অর্থাৎ ওপরের কর্মকর্তার ভূমিকা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

নুরুল হুদা
অনেক সময় হয়তো আমরা সঠিক নির্দেশ দিতে পারি না। কিন্তু এর দায়িত্ব যিনি আমাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর। নিচের মানুষেরা যদি বোঝেন তাঁর চাকরি, পদোন্নতি, বদলি ও বিদেশে যাওয়া রাজনৈতিক নেতারাই ঠিক করে দেবেন, স্থানীয় সাংসদ ঠিক করবেন কোন ওসি তাঁর থানায় কাজ করবেন, সে ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা (চেইন অব কমান্ড) ভেঙে পড়ে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই যিনি নির্দেশ দেবেন, তাঁর স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ থাকতে হবে। এমনও দেখা গেছে, একজন কর্মকর্তা দলের জন্য ক্ষতিকর। সেই দলেরই একজন নেতা বলছেন, ওই খারাপ কর্মকর্তাকে তাঁর জেলায় বদলি করতে। ওই নেতা কর্মকর্তাকে দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান। দলের ক্ষতি তাঁর কাছে কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে কি না। এই হচ্ছে তথাকথিত নেতা আর কর্মকর্তার। এই চক্র থেকে বের হতে না পারলে সমস্যা থেকেই যাবে।
কোনো এলাকায় মন্ত্রী গেছেন। নিজের কাজ বাদ দিয়ে সারা দিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাঁর সার্কিট হাউসে পড়ে আছেন। তাঁদের দেখে দেখে জুনিয়ররা একই কাজ করেন। কর্মকর্তাদের পেশাগত দায়িত্ব অনুধাবন করে তা পালনের সাহস অর্জন করতে হবে। রাজনীতিকে যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদেরও বুঝতে হবে, সরকারি কর্মচারী কোনো দলের নয়, তাঁরা দেশের মানুষের সেবক। দেশের মানুষের পয়সার তাঁদের বেতন হয়, কোনো দলের পয়সায় নয়।

আব্দুল কাইয়ুম
পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্যের অন্যায় হলে বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয় তদন্তের জন্য। এই তদন্ত নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। পুলিশের দোষত্রুটি ধরার উপায় কী?

ড. শাহদীন মালিক
সাম্প্রতিক সময় পুলিশের বেশ কিছু অনিয়ম সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। কিন্তু বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। নব্বইয়ের দশকে ইয়াসমিন ও রুবেলের ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি সংকটের মুখে পড়েছিল। ইয়াসমিনের ঘটনায় একজনের ফাঁসি এবং দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। রুবেলের ঘটনায়ও পুলিশের শাস্তি হয়েছিল। এখন যেমন পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, দেশে হত্যা, গুমের মতো ঘটনা ঘটছে, নব্বইয়ের দশকের পরে আর মনে পড়ে না এ রকম হয়েছে।
এ খারাপ অবস্থার জন্য তিনটি কারণ আমার কাছে মনে হয়। এক. গত এক দশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা। দুই. ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টে প্রায় ৫০ জনের মতো মারা গিয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই ৫০ জন মানুষ মারার অপরাধ থেকে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ এ অপরাধে তাদের কখনো বিচার করা যাবে না। এই প্রথম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখল যে তারা যা-ই করুক, তাদের কোনো বিচার হবে না। বুঝে হোক না বুঝে হোক, সবচেয়ে খারাপ কাজের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত র‌্যাব-পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সমাজে এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। এখন অন্যদের মধ্যেও ধারণা হয়েছে যে খারাপ কাজ করে পার পাওয়া যেতে পারে। তিন. এই বাহিনীতে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি।
ফৌজদারি কার্যবিধির ২০৬ থেকে ২২০ পর্যন্ত ১৫টি ধারা ছিল। এই ধারাগুলো প্রাথমিকভাবে আটক হওয়া ব্যক্তিকে সাহায্য করত। পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে, কেন আটক করা হয়েছে, কী তার অপরাধ, তার বিরুদ্ধে কী সাক্ষী আছে এই ১৫টি ধারা দিয়ে বিচারক আটকের যৌক্তিকতা যাচাই করতে পারতেন। পুলিশের আইন সংস্কারের সময় এ ধারাগুলো তুলে দেওয়া হয়। ফলে পুলিশের ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। এখন পুলিশ যে কাউকে আটক করে যেকোনো মামলার সঙ্গে জড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিচারকের কিছুই করার থাকে না। অর্থাৎ পুলিশ প্রাথমিকভাবে কারও নাম লিখলে তাকে হাজতে যেতে হবে। ১০ বছর ধরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা লক্ষ করছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পুলিশ বিভাগে সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থা অনেকের পছন্দ হবে, অনেকের হবে না। তার পরও এ সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। পুলিশি মামলায় দোষী সাব্যস্তের হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই হতাশাজনক। পুলিশের প্রতি ছয়টি মামলার একটি মামলায় আসামি দোষী সাব্যস্ত হন। পাঁচটি মামলায় সবাই খালাস পেয়ে যান। পাঁচটি মামলায় নির্দোষ প্রমাণ হতে হতে বিচারকসহ সবার যে পরিমাণ সময় এবং অর্থ নষ্ট হয়, সেটি দেশের জন্য বড় ক্ষতির বিষয়। পুলিশি মামলার এটি একটি খারাপ দৃষ্টান্ত।

আব্দুল কাইয়ুম
শাহদীন মালিকের আলোচনা থেকে আইনের কিছু বিষয়, পুলিশের একচ্ছত্র ক্ষমতার কিছু বিষয় জানা গেল। এবার বলবেন ইসমাইল হোসেন।

ইসমাইল হোসেন
পুলিশের সমস্যা আজ জাতীয় সমস্যা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে পুলিশ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে তাদের সমস্যা তাৎক্ষণিক কে দেখবে। সরকার, আইজি, সুশীল সমাজ, না সবাই মিলে দেখবে। সমস্যাটা সবার কাছে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য যে কাজগুলো করা দরকার সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই। সবাই একটি কথা বলেছেন, এটি একদিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। এখন এর গোড়া খুঁজে বের করতে হবে যে কেন এসব হচ্ছে।
গোড়া খুঁজতে গেলে প্রথমে আসবে নিয়োগ-পদ্ধতি। অভিজ্ঞতা থেকে জানি নিয়োগ-পদ্ধতিতে যথেষ্ট অনিয়ম রয়েছে। নিয়োগের সময় প্রার্থীর লেখাপড়া, অতীত, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে যত দিন দলীয় তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে, তত দিন এই সমস্যা থাকবে। যত কথাই বলি এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না।
প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। প্রশিক্ষণ বলতে শুধু কুচকাওয়াজ (লেফ্ট-রাইট) করা বোঝায় না। কর্মপরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়, মানবাধিকার, শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন—এসবের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তা না হলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হবে, আদালত প্রাঙ্গণে নারীকে অপমান করা হবে। যাঁরা এসব অন্যায় করছেন, তাঁরা বোঝেন কি না যে এটি অন্যায়, আজকে সেটিও একটি প্রশ্ন। এসব কারণে তার উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের মধ্যে শুধু আইনের কিছু ধারা থাকলে হবে না। বর্তমান যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
থানার কর্মকর্তারা কীভাবে পরিচালিত হবেন। তাঁরা কী আইনের, না রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশের দ্বারা পরিচালিত হবেন, সেটি একটি প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক নেতারা কতখানি অপব্যবহার করবেন তাঁদের, সেটি একটি বিষয়। কর্মকর্তারা তাঁদের নির্দেশ শুনতে বাধ্য। কারণ, তাঁদের নির্দেশ না শুনলে তাঁরা বদলি হবেন, পদোন্নতি হবে না, বহিষ্কারসহ নানাবিধ সমস্যা হবে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা নিজেরই ছিল।
যত দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ হাসিলের কাজে পুলিশকে ব্যবহার করবে, তত দিন পুলিশের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে না। এখন অনেকেই মনে করেন সরকার পরিবর্তন হলে আমি তো আর থাকব না। তাহলে রাজনৈতিক নেতারা কী পরিমাণ নিয়মবহির্ভূত কাজে তাঁকে ব্যবহার করেন যে তিনি ভাবতে থাকেন সরকার বদল হলে তাঁর পেশায় থাকা সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক নেতাদেরও এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
পুলিশের সংস্কার নিয়ে সব সরকারের সময় কথা হয়। যে সরকারই আসুক সংস্কার বলতে বোঝে পুলিশের সদস্য নিয়োগ বা কোনো বিশেষ এলাকায় পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো। আসল সংস্কার যে তাদের মানসিক পরিবর্তনে, প্রশিক্ষণে, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যে, আচরণে ইত্যাদি বিষয় এ পর্যন্ত কোনো সরকার তা বোঝেনি। পুলিশের দুর্নীতির কথা বলা হয়। পুলিশের মৌলিক প্রয়োজনের জন্য যদি টাকা বরাদ্দ না থাকে তাহলে সে অনিয়ম করবে।
চেইন অব কমান্ডের কথা অনেকে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে যিনি নির্দেশ দেবেন, তাঁর যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নিজের যদি যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সাহস না থাকে, তাহলে তিনি কীভাবে নির্দেশ দেবেন। ঢাকা শহরের সবাই কমবেশি ট্রাফিক সমস্যায় ভোগেন। ট্রাফিকে পরিদর্শকের কাজ শুরু হয় ডেপুটি কমিশনার ট্রাফিক থেকে। ঢাকা শহরে যতজন ডেপুটি কমিশনার ট্রাফিক আছেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন তাঁরা ট্রাফিক ট্রেনিংয়ের ‘ট’ জানেন কি না। তাহলে এই লোকটা কী কমান্ড করবেন। আর তাঁর কমান্ডে কিই বা ভেঙে পড়বে। কেউ কোথাও ভালো না করলে বলা হয়, যাও তুমি ট্রাফিকে যাও। যাও তুমি সারদায় ট্রেনিংয়ে যাও। সংস্কারের জন্য অনেক সুপারিশ এসেছে। তার কোনোটাই প্রয়োগ করা হয়নি। আজকে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, নারী নির্যাতন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পরিপত্র জারি করলে হবে না। পুলিশের সংস্কৃতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। এবং এর জন্য যা যা করা দরকার তার সবকিছু করতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সবাই আলোচনা করেছেন। এখন জবাবদিহির বিষয়ে অল্প কথায় যদি কিছু বলতে চান।

সা’দত হুসাইন
সম্প্রতি কিছু পুলিশ কর্মকর্তা যেসব কাজ করছেন তার সবই যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা কিন্তু নয়। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হচ্ছে। ওই দিন কোনো হরতাল-অবরোধ ছিল না। বিরোধী দলের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। সেখানে গিয়ে সাংবাদিকদের মারা, ছাত্রদের বেধড়ক পেটানো— এটার উদ্দেশ্য কী? এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বাহবা পাওয়ার কথা নয়। কাদেরের ঘটনা পড়ার সময় দেখলাম খিলগাঁও থানার ওসি মারতে মারতে একপর্যায়ে বলছেন, ‘দেখি নতুন চাপাতিটা, ওটা একটু পরীক্ষা করি।’ বলেই নতুন চাপাতি দিয়ে কাদেরের পায়ে কোপ দিলেন। এর অর্থ কী, এখানে কি রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য আছে? চট্টগ্রামে এক ক্যাডার কর্মকর্তা বিদেশি মহিলার মুঠোফোন চুরি করেছেন। ওই মহিলা তাঁকে মার দিয়েছেন। পুলিশ ক্যাডারে ঢোকার জন্য ধানমন্ডিতে একজন মহিলা আইনজীবীকে খুন করা হয়েছিল। এখন যা দরকার তা হলো, এদের পারিবারিক ইতিহাস খুঁজে দেখা। এলাকায় এদের কর্মকাণ্ড কী ছিল। চাকরির ক্ষেত্রে কোথায় কী করেছে—সবকিছু খতিয়ে দেখতে হবে। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কেন এরা এই অপকর্মগুলো করে থাকে। কী চায় এরা, এদের সমস্যা কোথায়। মনে হয় নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছু খতিয়ে দেখলে আসল কারণ বেরিয়ে আসবে।

নুরুল হুদা
দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে মেধাবী ও দায়িত্বশীলদের নিয়োগ দেওয়া দরকার। বাস্তবে দেখি, সব পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নীতিনির্ধারকদের ইশারায় এগুলো হচ্ছে। এখন কার কাছ থেকে কী আমরা আশা করব, কে আমাদের ভালো সেবা দেবে। পুলিশের পেশাটাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হয় এ জন্য যে পুলিশই একমাত্র বাহিনী, যে আমার স্বাধীনতাকে কেড়ে নিতে পারে। ৫৪ ধারা দিয়ে যে কাউকে পুলিশ আটক করতে পারে। এত বড় ক্ষমতা যাকে-তাকে না দিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দেওয়া উচিত। নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় গলদ থাকার জন্য রাষ্ট্রের এত বড় ক্ষমতা যার-তার হাতে চলে যাচ্ছে। যে কারণে আজ পুলিশের কাজকর্ম প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
পদানুসারে পুলিশের প্রত্যেক সদস্য আইন কাঠামোর মধ্যে আছেন। ওপরের কর্মকর্তা নিচের কর্মকর্তাকে আইনের বাইরে কোনো নির্দেশ দিতে পারেন না। দিলে তিনি শুনতে বাধ্য নন। এমন না যে আমি সাব ইন্সপেক্টর, উনি আইজি, ওনার কথা আমার শুনতেই হবে। সবাই সবার জায়গায় সম্পূর্ণ স্বাধীন। অনেক সময় শুনে থাকি—পদস্থ কর্মকর্তার আদেশ হলে করতে পারি। এটা বলাই বে-আইনি। ওই কর্মকর্তাকে স্যালুট করা দাপ্তরিক শৃঙ্খলার অংশ। আইনত যে কাজ, তার জন্য কোনো স্যালুট নেই।

আব্দুল কাইয়ুম
আদালতে এক পুলিশ কর্মকর্তা আইনজীবীকে বললেন, ‘ধর বেটাকে, জঙ্গি মামলায় ঢুকায়া দে।’ এই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর কি কেউ নেই, যিনি বলবেন যে এটা তোমার অন্যায় কাজ হয়েছে। কেউ অপরাধ করার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরের কর্মকর্তা যদি তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে তুমি কেন এটা করেছ, তাহলেও পুলিশের অন্যায় অনেকটা কমে আসবে।

নুরুল হুদা
জবাবদিহির যথেষ্ট জায়গা আছে। প্রয়োগ হচ্ছে কি না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। একজন ওসি যদি অপরাধ করেন, সে ক্ষেত্রে অ্যাসিসট্যান্ট, ডেপুটি, অ্যাডিশনাল, জয়েন্ট ও কমিশনারের কাছে তাঁর জবাবদিহি করার আছে। এলাকার যে বিচারিক ব্যবস্থা আছে তাঁরা দেখতে পারেন। সরকার তো দেখতেই পারে। জবাবদিহি করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। ব্যক্তির বিচ্যুতি থাকলে জবাবদিহি কার্যকর হবে না। ম্যাজিট্রেটরা ইচ্ছা করলে জামিন দিতে পারেন। কিন্তু আমরা দেখি, অনেক নিরাপরাধ মানুষ জামিন পাচ্ছেন না। আজকাল নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে আলাদা একটা কমিশন তৈরি হতে পারে, যাঁরা এ বিষয়গুলো দেখবেন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ইসমাইল হোসেন
কেউ তদন্ত ঠিকমতো করেনি। কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। কেউ রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করেছে। এগুলো দেখার জন্য পুলিশের নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। এ কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেটা দেখার জন্য আইজি, অতিরিক্ত আইজিদের সুপারভিশন থাকতে হবে।

সা’দত হুসাইন
পিএসসিতে থাকার সময় পুলিশের অনেক ডিসিপ্লিন কেস আমাদের কাছে যেত। এ বিষয়ে অনেক লিখেছি। অনেকের দোষ প্রমাণ হয়ে সাজাও হয়েছে। পুলিশের মধ্যে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত একটা বিষয় খেয়াল করেছি, যদি চাকরি না যায় তাহলে সাজাকে ওরা কিছু মনে করে না। ওরা শুধু দেখে চাকরি গেছে কি না। সাত বছর পর ফিরে এসে সুন্দর করে লিখছে তার শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
তাই শাস্তি যেটা দিতে হবে সেটা দৃষ্টান্তমূলক দিতে হবে। আমি আবারও নিয়োগ-প্রক্রিয়ার কথা বলব। নিয়োগের ক্ষেত্রে, স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। এমনও দেখা যায়, প্রশিক্ষণ চলাকালে তাকে তুলে এনে পোস্টিং দেওয়া হয়।

ইসমাইল হোসেন
পদোন্নতির বিষয়ে একটি কথা বিশেষ জোর দিয়ে বলতে চাই। তা হলো, পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতির যে ধারা বা পদ্ধতি, তা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এখানে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কৃতিত্ব বা কার্যসম্পাদনের ওপর নির্ভর করে পদোন্নতি হয়। একজন পুলিশ সদস্যের প্রতিবছরের কাজ রেকর্ড করা হবে। বছর শেষে মূল্যায়ন করা হবে এবং ভালো কাজের আলোকে পদোন্নতি হবে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দিলে কাজ না করে সময় পার করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। পদোন্নতির সেকেলে এই পদ্ধতির এখনই পরিবর্তন করতে হবে।

শাহ্দীন মালিক
দীর্ঘদিন ধরেই পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। মনে হয় এখন আলোচনার মধ্যে থাকার সময় নেই। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

আব্দুল কাইয়ুম
পুলিশকে কার্যকর করতে হলে এর ভেতরের যে জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে তার সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।
আপনারা সবাই মূল্যবান আলোচনা করেছেন। পুলিশের নিয়োগ-প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ, বদলি, পদোন্নতি ও সংস্কারের মতো মৌলিক বিষয়গুলো এখানে আলোচনায় এসেছে। পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব করে তুলতে হলে আলোচিত বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আপনাদের সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

যাঁরা অংশ নিলেন
সা’দত হুসাইন
সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
ইসমাইল হোসেন
সাবেক আইজিপি
নুরুল হুদা
সাবেক আইজিপি
ড. শাহ্দীন মালিক
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.