হৃদয়নন্দন বনে-কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা by আলী যাকের
এখনকার ডিজিটাল যুগে ক্যামেরার চাকতি ঘুরিয়েই সব ছবি দেখা যায়। এক এক করে ছবিগুলো দেখি আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হই। কত রঙিন, কত প্রাণবন্ত এই বনের ছবি! তবুও আমার মনে হয় যে, এই বনের ছবি ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক শ্রেয়।
কারণ তাতে করে কেবল 'কী পাইনি' তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে আমরা সদাই উৎকণ্ঠিত থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বলা যায়, 'এই যদি পেলাম, তাহলে সবই তো পেয়ে গেলাম।' সেক্ষেত্রে রঙিন ছবিগুলো আমাদের আশাব্যঞ্জক এক ইশারায় ব্রতী করতে পারে বৈকি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সবই নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনার ওপর
সপ্তাহান্তে ছুটির দিন এলেই আমি বেরিয়ে পড়ি নিসর্গে, সুন্দরের সন্ধানে। আমার এই পাগলামি, এমনকি এবারের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড তাপকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে ঠিক সেই একই রকম আছে। আমি যখনই ঢাকার বাইরে যাই, আমার সঙ্গে চিরসঙ্গী থাকে আমার ক্যামেরা। কোনো একটি দৃশ্য, কি কোনো মানুষ অথবা অতি ক্ষুদ্র বনফুল, যা-ই আমার ভালো লাগে, আমি আমার ক্যামেরার বোতাম টিপে তার একটা স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। এই তো সেদিন গাজীপুরে একটি সবুজ ঘাসওয়ালা মাঠের ওপরে বসে রৌদ্রের তাপকে উপেক্ষা করে একের পর এক ক্ষুদ্রকায় ফুলের ছবি তুলছিলাম। সবুজ, সাদা, বেগুনি, হলুদ, গোলাপি, কত বাহারি রঙেই না এরা ফুটে থাকে ঘন সবুজ ঘাসের আড়ালে-আবডালে। আমি অনেক সময় ভেবেছি যে, এসব ফুল যদি আরও শক্তপোক্ত হতো, তাহলে আমাদের দেশের মেয়েরা এগুলো দিয়ে নাকফুল, কি কানের দুল তৈরি করতে পারত অনায়াসে।
যা হোক, আমি দীর্ঘদিন আগে প্রয়াত আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমেদের সঙ্গী হিসেবে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলাদেশের বুনোফুলের সন্ধানে। অনেক ছবি তুলেছি সে সময়, প্রায় পাঁচ বছর কাজ করে। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু ছবি নিয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজিতে, ঞযব ডরষফ ঋষড়বিৎং ড়ভ ইধহমষধফবংয নামে। তবুও বনফুলে আমার আগ্রহ একটুও কমেনি। আমি যখন ওই ফুলগুলোকে অনেক কাছ থেকে দেখি, তখন আমার বড় দুঃখ হয়। মনে হয় ওই বেচারারা কত আগ্রহ নিয়ে ফোটে, কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকে ওপরের দিকে, মানুষের দেখার আশায়; কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা যে, এই ফুলগুলোকে দেখেও দেখি না। অনেক সময় জানিও না যে, এই ধরনের এত ফুল আমাদের পায়ের নিচে অবলীলায় মাড়িয়ে আমরা নিজেদের গন্তব্যের দিকে চলে যাই। ওরা আশাও করে না। মানুষ তো কাজে-কর্মে যাবেই। ওরা হয়তো ভাবে যে, মানুষগুলো আমাদের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না? আমরা কত সাগ্রহে ওদের জন্য ফুটি। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি সামান্য স্বীকৃতির আশায়।
ওই দিন ওই বুনোফুলের ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ মনে হলো যে, খবরের কাগজে পড়েছি, সম্প্রতি আমাদের রাজেন্দ্রপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে একটি 'প্রজাপতি পার্ক' তৈরি করা হয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে রাজেন্দ্রপুর উদ্যান খুব বেশি দূরে নয়। ভাবলাম, যাই, দেখা করেই আসি প্রজাপতিদের সঙ্গে। রাজেন্দ্রপুর পেঁৗছে গেটে প্রহরীদের কাছে জিজ্ঞেস করতেই তারা সদয় অনুমতি দিল আমায়। দীর্ঘদিন পরে আমি রাজেন্দ্রপুর পার্কে এলাম। ভারি ভালো লাগল। এখনও বর্ষাকাল আসেনি। তবে কী যেন একটা আছে প্রকৃতির মধ্যে যে, ওরা ঠিকই বুঝে যায়, কোন ঋতু যাচ্ছে আর কে আসছে। তাই বর্ষার আগমনের খবর পেয়েই ক্ষুদ্র চারা থেকে শুরু করে বৃহৎ বৃক্ষ_ সবই পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ভাওয়ালের মতো লাল মাটির অঞ্চলে একটি বিশেষ বুনোফুল সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়, যা 'ইন্ডিয়ান রোডডেন্ড্রন' নামে পরিচিত। দেখলাম ফুটে আছে সেই ফুল তার অসাধারণ বেগুনি বর্ণে, চারদিকে। লোকমুখে জিজ্ঞেস করে করে পেঁৗছে গেলাম প্রজাপতি উদ্যানে। এই উদ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে এবং তত্ত্বাবধানে অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওখানে প্রবেশ এখনও তত সহজ হয়ে ওঠেনি। মোবাইলে এর তত্ত্বাবধায়কদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে হলো। তারপর অনুমতি পাওয়া গেল ভেতরে প্রবেশ করার। অতি অল্প জায়গা নিয়ে রচনা করা হয়েছে এই প্রজাপতি উদ্যান। জানা-অজানা নানা ফুলসজ্জা রচিত হয়েছে, যার অনেকগুলো ফুলই আমাদের অতি পরিচিত। আমি জানতাম না যে, এই ফুলগুলো প্রজাপতিদের অত্যন্ত প্রিয়। তা-ই হবে। কেননা সারা উদ্যান ঘুরে যার দেখা মেলেনি, সেই রঙবেরঙের প্রজাপতিরা, দেখতে পেলাম নেচে নেচে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। কত রঙের ছোটখাটো নানা ফুলে ভরা এ বাগান। আর কত ধরনের ছবির মতো দেখতে প্রজাপতি। আমি একাগ্রচিত্তে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। বড় ভালো কাজ হয়েছে এই উদ্যানটির প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের বাগান করতে হলে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য একটু উর্বর জায়গাকে তৈরি করে নিয়ে সেখানে বিশেষ শ্রেণীর ফুল এবং গাছ লাগাতে হয়। তাহলেই অবাক কাণ্ড, প্রজাপতিরা সব ভিড় করে আসে সেই বাগানে! আমাদের মধ্যে যাদেরই এই ধরনের সামান্য জায়গা আছে, তারা হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, জেলা পর্যায়ে প্রতিটি শহরে সরকার সামান্য উদ্যোগেই এমন উদ্যান রচনা করতে পারেন।
ছবি তুলতে তুলতে কখন যে ঘেমে নেয়ে উঠেছি, বলতে পারব না। ভাবলাম বিশ্রামের প্রয়োজন। অতএব, একটি বড় শালগাছে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। কত উদ্ভট ধরনের চিন্তাই না মাথায় ভিড় করে আসে! এই যে আজকে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে এই বিকেল পর্যন্ত এমন নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের এক অভিজ্ঞতা, তার তুলনা মেলা ভার। প্রচণ্ড তাবদাহে শরীরী যে যন্ত্রণা, তাকে কত সহজে দূরে সরিয়ে রেখে একেবারে মনের আনন্দে সেই সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ কাজে-অকাজে সময় কাটিয়ে দিলাম। অথচ শহরে যখন থাকি, ইট-পাথরের জঙ্গলে, অনেক সময় তাপানুকূল পরিবেশে, তখন প্রায় ভুলেই যাই যে, এমন সুন্দর সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আমাদেরই এই প্রায় অবাসযোগ্য শহরের চারদিকে। মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের এই শহরেরও ভেতর-বার আছে। প্রায় অন্দরমহল-বহির্মহলের মতোই। অর্থাৎ আমরা যারা অন্দরমহলে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তারা বহির্মহলে যেতে ভয় পাই। সেখানে নিরাপত্তার অভাববোধ করি বিভিন্ন কারণে। মনে হয় কেবল যে আমরা দুর্জনের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি তা-ই নয়, আবহাওয়ার বড় বেশি নিয়ন্ত্রণ বহির্মহলে। তাই সেই আক্রমণ আমাদের বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, অন্দরমহলের এই নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যদি চলে যেতে পারি বাইরের নিসর্গ নিয়ন্ত্রিত ভুবন দেখতে, তাহলে হয়তো অনেক সহনীয় হয়ে যেতে পারে আমাদের সদা শঙ্কাময় জীবন। কেবলই 'নেই' যেখানে রাজত্ব করে অবলীলায়, সেখানে বাইরের প্রকৃতি আমাদের এই প্রত্যয় দিতে পারে যে, কিছুই হারিয়ে যায়নি। সবই আছে।
হঠাৎ মনে হয় আজকের তোলা ছবিগুলো দেখি। এখনকার ডিজিটাল যুগে ক্যামেরার চাকতি ঘুরিয়েই সব ছবি দেখা যায়। এক এক করে ছবিগুলো দেখি আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হই। কত রঙিন, কত প্রাণবন্ত এই বনের ছবি! তবুও আমার মনে হয় যে, এই বনের ছবি ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক শ্রেয়। কারণ তাতে করে কেবল 'কী পাইনি' তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে আমরা সদাই উৎকণ্ঠিত থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বলা যায়, 'এই যদি পেলাম, তাহলে সবই তো পেয়ে গেলাম।' সেক্ষেত্রে রঙিন ছবিগুলো আমাদের আশাব্যঞ্জক এক ইশারায় ব্রতী করতে পারে বৈকি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সবই নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনার ওপর। তখনই সেই অমোঘ বাক্য, যা রবীন্দ্রকাব্যে আমরা পড়েছি, তা মূর্ত হয়ে দেখা দেয়_ 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে...।' আমরা নিজের মধ্যেই, শত হতাশা পরিবৃত হয়েও আশায় দীপ্ত এক ভুবন আবিষ্কার করি। এই সুখ থাকতে, সর্বত্র ছড়িয়ে, কেন নিজের ভেতরেই ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হই আমরা?
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সপ্তাহান্তে ছুটির দিন এলেই আমি বেরিয়ে পড়ি নিসর্গে, সুন্দরের সন্ধানে। আমার এই পাগলামি, এমনকি এবারের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড তাপকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে ঠিক সেই একই রকম আছে। আমি যখনই ঢাকার বাইরে যাই, আমার সঙ্গে চিরসঙ্গী থাকে আমার ক্যামেরা। কোনো একটি দৃশ্য, কি কোনো মানুষ অথবা অতি ক্ষুদ্র বনফুল, যা-ই আমার ভালো লাগে, আমি আমার ক্যামেরার বোতাম টিপে তার একটা স্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। এই তো সেদিন গাজীপুরে একটি সবুজ ঘাসওয়ালা মাঠের ওপরে বসে রৌদ্রের তাপকে উপেক্ষা করে একের পর এক ক্ষুদ্রকায় ফুলের ছবি তুলছিলাম। সবুজ, সাদা, বেগুনি, হলুদ, গোলাপি, কত বাহারি রঙেই না এরা ফুটে থাকে ঘন সবুজ ঘাসের আড়ালে-আবডালে। আমি অনেক সময় ভেবেছি যে, এসব ফুল যদি আরও শক্তপোক্ত হতো, তাহলে আমাদের দেশের মেয়েরা এগুলো দিয়ে নাকফুল, কি কানের দুল তৈরি করতে পারত অনায়াসে।
যা হোক, আমি দীর্ঘদিন আগে প্রয়াত আলোকচিত্রী ড. নওয়াজেশ আহমেদের সঙ্গী হিসেবে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলাদেশের বুনোফুলের সন্ধানে। অনেক ছবি তুলেছি সে সময়, প্রায় পাঁচ বছর কাজ করে। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু ছবি নিয়ে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজিতে, ঞযব ডরষফ ঋষড়বিৎং ড়ভ ইধহমষধফবংয নামে। তবুও বনফুলে আমার আগ্রহ একটুও কমেনি। আমি যখন ওই ফুলগুলোকে অনেক কাছ থেকে দেখি, তখন আমার বড় দুঃখ হয়। মনে হয় ওই বেচারারা কত আগ্রহ নিয়ে ফোটে, কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকে ওপরের দিকে, মানুষের দেখার আশায়; কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা যে, এই ফুলগুলোকে দেখেও দেখি না। অনেক সময় জানিও না যে, এই ধরনের এত ফুল আমাদের পায়ের নিচে অবলীলায় মাড়িয়ে আমরা নিজেদের গন্তব্যের দিকে চলে যাই। ওরা আশাও করে না। মানুষ তো কাজে-কর্মে যাবেই। ওরা হয়তো ভাবে যে, মানুষগুলো আমাদের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না? আমরা কত সাগ্রহে ওদের জন্য ফুটি। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি সামান্য স্বীকৃতির আশায়।
ওই দিন ওই বুনোফুলের ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ মনে হলো যে, খবরের কাগজে পড়েছি, সম্প্রতি আমাদের রাজেন্দ্রপুরের উদ্ভিদ উদ্যানে একটি 'প্রজাপতি পার্ক' তৈরি করা হয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে রাজেন্দ্রপুর উদ্যান খুব বেশি দূরে নয়। ভাবলাম, যাই, দেখা করেই আসি প্রজাপতিদের সঙ্গে। রাজেন্দ্রপুর পেঁৗছে গেটে প্রহরীদের কাছে জিজ্ঞেস করতেই তারা সদয় অনুমতি দিল আমায়। দীর্ঘদিন পরে আমি রাজেন্দ্রপুর পার্কে এলাম। ভারি ভালো লাগল। এখনও বর্ষাকাল আসেনি। তবে কী যেন একটা আছে প্রকৃতির মধ্যে যে, ওরা ঠিকই বুঝে যায়, কোন ঋতু যাচ্ছে আর কে আসছে। তাই বর্ষার আগমনের খবর পেয়েই ক্ষুদ্র চারা থেকে শুরু করে বৃহৎ বৃক্ষ_ সবই পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে উঠেছে। ভাওয়ালের মতো লাল মাটির অঞ্চলে একটি বিশেষ বুনোফুল সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়, যা 'ইন্ডিয়ান রোডডেন্ড্রন' নামে পরিচিত। দেখলাম ফুটে আছে সেই ফুল তার অসাধারণ বেগুনি বর্ণে, চারদিকে। লোকমুখে জিজ্ঞেস করে করে পেঁৗছে গেলাম প্রজাপতি উদ্যানে। এই উদ্যানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে এবং তত্ত্বাবধানে অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওখানে প্রবেশ এখনও তত সহজ হয়ে ওঠেনি। মোবাইলে এর তত্ত্বাবধায়কদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে হলো। তারপর অনুমতি পাওয়া গেল ভেতরে প্রবেশ করার। অতি অল্প জায়গা নিয়ে রচনা করা হয়েছে এই প্রজাপতি উদ্যান। জানা-অজানা নানা ফুলসজ্জা রচিত হয়েছে, যার অনেকগুলো ফুলই আমাদের অতি পরিচিত। আমি জানতাম না যে, এই ফুলগুলো প্রজাপতিদের অত্যন্ত প্রিয়। তা-ই হবে। কেননা সারা উদ্যান ঘুরে যার দেখা মেলেনি, সেই রঙবেরঙের প্রজাপতিরা, দেখতে পেলাম নেচে নেচে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। কত রঙের ছোটখাটো নানা ফুলে ভরা এ বাগান। আর কত ধরনের ছবির মতো দেখতে প্রজাপতি। আমি একাগ্রচিত্তে একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। বড় ভালো কাজ হয়েছে এই উদ্যানটির প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের বাগান করতে হলে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য একটু উর্বর জায়গাকে তৈরি করে নিয়ে সেখানে বিশেষ শ্রেণীর ফুল এবং গাছ লাগাতে হয়। তাহলেই অবাক কাণ্ড, প্রজাপতিরা সব ভিড় করে আসে সেই বাগানে! আমাদের মধ্যে যাদেরই এই ধরনের সামান্য জায়গা আছে, তারা হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, জেলা পর্যায়ে প্রতিটি শহরে সরকার সামান্য উদ্যোগেই এমন উদ্যান রচনা করতে পারেন।
ছবি তুলতে তুলতে কখন যে ঘেমে নেয়ে উঠেছি, বলতে পারব না। ভাবলাম বিশ্রামের প্রয়োজন। অতএব, একটি বড় শালগাছে হেলান দিয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। কত উদ্ভট ধরনের চিন্তাই না মাথায় ভিড় করে আসে! এই যে আজকে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে এই বিকেল পর্যন্ত এমন নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের এক অভিজ্ঞতা, তার তুলনা মেলা ভার। প্রচণ্ড তাবদাহে শরীরী যে যন্ত্রণা, তাকে কত সহজে দূরে সরিয়ে রেখে একেবারে মনের আনন্দে সেই সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ কাজে-অকাজে সময় কাটিয়ে দিলাম। অথচ শহরে যখন থাকি, ইট-পাথরের জঙ্গলে, অনেক সময় তাপানুকূল পরিবেশে, তখন প্রায় ভুলেই যাই যে, এমন সুন্দর সব অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আমাদেরই এই প্রায় অবাসযোগ্য শহরের চারদিকে। মাঝে মধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের এই শহরেরও ভেতর-বার আছে। প্রায় অন্দরমহল-বহির্মহলের মতোই। অর্থাৎ আমরা যারা অন্দরমহলে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তারা বহির্মহলে যেতে ভয় পাই। সেখানে নিরাপত্তার অভাববোধ করি বিভিন্ন কারণে। মনে হয় কেবল যে আমরা দুর্জনের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি তা-ই নয়, আবহাওয়ার বড় বেশি নিয়ন্ত্রণ বহির্মহলে। তাই সেই আক্রমণ আমাদের বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, অন্দরমহলের এই নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে আমরা যদি চলে যেতে পারি বাইরের নিসর্গ নিয়ন্ত্রিত ভুবন দেখতে, তাহলে হয়তো অনেক সহনীয় হয়ে যেতে পারে আমাদের সদা শঙ্কাময় জীবন। কেবলই 'নেই' যেখানে রাজত্ব করে অবলীলায়, সেখানে বাইরের প্রকৃতি আমাদের এই প্রত্যয় দিতে পারে যে, কিছুই হারিয়ে যায়নি। সবই আছে।
হঠাৎ মনে হয় আজকের তোলা ছবিগুলো দেখি। এখনকার ডিজিটাল যুগে ক্যামেরার চাকতি ঘুরিয়েই সব ছবি দেখা যায়। এক এক করে ছবিগুলো দেখি আর নিজেই নিজের কাজে মুগ্ধ হই। কত রঙিন, কত প্রাণবন্ত এই বনের ছবি! তবুও আমার মনে হয় যে, এই বনের ছবি ক্যামেরার চেয়ে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক শ্রেয়। কারণ তাতে করে কেবল 'কী পাইনি' তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে আমরা সদাই উৎকণ্ঠিত থাকি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বলা যায়, 'এই যদি পেলাম, তাহলে সবই তো পেয়ে গেলাম।' সেক্ষেত্রে রঙিন ছবিগুলো আমাদের আশাব্যঞ্জক এক ইশারায় ব্রতী করতে পারে বৈকি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সবই নির্ভর করে মানুষের চিন্তা, চেতনার ওপর। তখনই সেই অমোঘ বাক্য, যা রবীন্দ্রকাব্যে আমরা পড়েছি, তা মূর্ত হয়ে দেখা দেয়_ 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে...।' আমরা নিজের মধ্যেই, শত হতাশা পরিবৃত হয়েও আশায় দীপ্ত এক ভুবন আবিষ্কার করি। এই সুখ থাকতে, সর্বত্র ছড়িয়ে, কেন নিজের ভেতরেই ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হই আমরা?
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments