ইউরোপ-অভিবাসীবিরোধী রাজনীতি কীভাবে মূল স্রোতে এল by স্লাভো জিজেক

সম্প্রতি ফ্রান্স থেকে রোমা জনগোষ্ঠী বা জিপসিদের বের করে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ইউরোপজুড়ে। উদারনৈতিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শীর্ষ রাজনীতিকেরাও এতে শামিল হয়েছেন। প্রতিবাদ শুধু বামপন্থী রাজনীতিকদের মধ্যেই সীমিত থাকেনি।


তবু রোমাদের বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। ইউরোপীয় রাজনীতির বৃহৎ অবয়বের অতি ক্ষুদ্র দৃশ্যমান অংশ এই যাযাবর জনগোষ্ঠী।
এক মাস আগে ব্যাংকের নির্বাহী থিলো সারাজিন একটি বই লিখে জার্মানিতে আলোড়ন তুলেছিলেন। সারাজিনকে রাজনৈতিকভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। তাঁর বইয়ের সিদ্ধান্ত হলো, খুব বেশি অভিবাসীদের তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে দেওয়া হচ্ছে বলেই জার্মান জাতিগত বোধ আজ হুমকিতে। যদিও বইটির শিরোনাম জার্মানি ডাজ অ্যাওয়ে উইথ ইটসেলফ (জার্মানি নিজেকে শেষ করে ফেলছে) তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে, কিন্তু বইটির ব্যাপক প্রভাব থেকে ধারণা করা যায় বহু মানুষকে বইটি স্পর্শ করতে পেরেছে।
এমন ঘটনাগুলোকে পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক জগতের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বিন্যাসের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দুটি প্রধান দলের প্রাধান্য দেখা যেত: একটি মধ্য-ডানপন্থী দল (ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট, লিবারেল-কনজারভেটিভ, পিপলস) আর একটি মধ্য-বাম দল (সোশ্যালিস্ট, সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট)। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের কাছে দল দুটির আবেদন ছিল। এ ছাড়া ছোট ছোট কিছু দল (প্রতিবেশবাদী, কমিউনিস্ট) অল্পসংখ্যক ভোটার আকৃষ্ট করতে পারত।
পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ইউরোপের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে ভিন্ন ধরনের মেরুকরণ ঘটছে। এখন প্রাধান্যে থাকছে একটি মধ্যপন্থী দল, যা বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সমর্থক। সাধারণত দলটির একটি উদারনৈতিক রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে (উদাহরণস্বরূপ, গর্ভপাত, সমকামীদের অধিকার, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণু)। এই দলের প্রধান বিরোধী একটি অভিবাসীবিরোধী লোকরঞ্জনবাদী দল, যা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রান্তিক জায়গায় এ দলটি প্রকাশ্য বর্ণবাদী নব্য ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পোল্যান্ড। সাবেক কমিউনিস্টরা দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর এখন পোল্যান্ডের প্রধান দুটি দল হলো, প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কের ‘মতাদর্শবিরোধী’ মধ্যপন্থী লিবারেল পার্টি এবং কাজিনস্কি ভ্রাতাদের রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও হাঙ্গেরিতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থাতে আমরা কেমন করে এলাম?
কল্যাণরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে আশাবাদ জিইয়ে রেখেছিল। তখন আর্থিক ব্যয়সংকোচনের পদক্ষেপকে সাময়িক বলে চালানো হতো আর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো যে শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সেই আশাবাদের অবসানের পর এখন আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে সংকট কিংবা বলা যায় এক ধরনের অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এ অবস্থার আনুষঙ্গিক প্রয়োজন হিসেবে এসেছে নানা ধরনের কৃচ্ছ্রতামূলক পদক্ষেপ (সুবিধাদি কমানো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা সংকোচন, চাকরি আরও ক্ষণস্থায়ী করে তোলা)। সংকট জীবনযাপনেরই একটি ধরনে পরিণত হচ্ছে।
১৯৯০ সালে ইউরোপের দেশগুলোতে কমিউনিস্ট শাসন ভেঙে পড়ার পর আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করি, যেখানে বিরাজনৈতিকীকৃত বিশেষজ্ঞদের শাসন আর স্বার্থের সমন্বয় হয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচর্চার প্রধান ধরন। এ ধরনের রাজনীতিতে আবেগানুভূতি সঞ্চার এবং জনগণকে সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করার একমাত্র পথ নানা বিষয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি: অভিবাসী, অপরাধ, ঈশ্বরহীন দুনিয়ায় বিকৃত যৌনাচার, পরিমিতিহীন রাষ্ট্র (যেখানে উচ্চ কর ও নিয়ন্ত্রণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়), প্রতিবেশগত বিপর্যয়, আর ব্যক্তিকে হয়রানির মতো বিষয়ে আতঙ্ক ছড়ানো (রাজনৈতিক শুদ্ধতা হলো আতঙ্ক ছড়ানোর রাজনীতির একটি উদারনৈতিক ধরন)।
এমন রাজনীতি সর্বদা নির্ভর করে অগণিত বিভ্রমকে কাজে লাগানোর ওপর। আতঙ্কিত নারী-পুরুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতে পারাই তাদের ভরসার জায়গা। এ জন্য, নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকের বড় ঘটনা ছিল অভিবাসীবিরোধী রাজনীতি মূল স্রোতে চলে আসা এবং অবশেষে উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর সঙ্গে এ রাজনীতির নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন করা। ফ্রান্স থেকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া থেকে হল্যান্ড—সব কটি দেশে এখন নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ে গর্ববোধ করার নতুন চেতনায় বড় দলগুলো এমন ভাবনাকেও গ্রহণযোগ্য মনে করে যে অভিবাসীরা অতিথি। আর আশ্রয়দাতা সমাজের মৌল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে অভিবাসীদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ‘এটা আমাদের দেশ। এ দেশকে ভালোবাসো, নয়তো বিদায় হও।’—এই তাদের বার্তা।
এ ধরনের লোকরঞ্জনবাদী বর্ণবাদের কারণে প্রগতিশীল উদারপন্থীরা আতঙ্কিত। তবে, নিবিড়ভাবে দেখলে দেখা যাবে, তাদের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী সহিষ্ণুতা এবং ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কেমন করে অভিবাসনবিরোধীদের চিন্তার সঙ্গে একটি জায়গায় মিলে যায়: অন্যদের যথাযথ দূরত্বে রাখতে হবে। উদারপন্থীদের কথা এ রকম: ‘অন্যদের উপস্থিতি ঠিক আছে, আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আমার নিজের জগতে তাদের খুব বেশি অনুপ্রবেশ করা চলবে না। করলে তা হবে আমার ওপর উৎপীড়ন। আমি ইতিবাচক পদক্ষেপ পুরোপুরি সমর্থন করি, কিন্তু কোনোমতেই উচ্চ স্বরে র‌্যাপসংগীত শুনতে প্রস্তুত নই।’ উৎপীড়িত না হওয়ার অধিকার এই প্রলম্বিত-পুঁজিবাদী সমাজে ক্রমশ কেন্দ্রীয় মানবাধিকার হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই অধিকার অন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার অধিকার। যে সন্ত্রাসীর ভয়ানক পরিকল্পনা ঠেকাতে হবে, তার স্থান গুয়ানতানামো (এই শূন্যস্থানটি আইনের শাসনের আওতার বাইরে); মৌলবাদী মতাদর্শিক নেতাকে চুপ করিয়ে দিতে হবে, কারণ সে ঘৃণা ছড়ায়। এরা সমাজের বিষাক্ত উপাদান, আমার শান্তি বিনষ্টকারী।
আজকের বাজারে, আমরা নানা ধরনের পণ্য পাই যেগুলোর ক্ষতিকর উপাদান বাদ দেওয়া। ক্যাফেইন ছাড়া কফি, চর্বি ছাড়া ক্রিম, অ্যালকোহল ছাড়া বিয়ার। এ তালিকা অনেক বড় হতেই থাকে: ভার্চুয়াল সেক্সের কথা ভাবুন—সেক্স ছাড়াই সেক্স? হতাহতের ঘটনা ছাড়াই (অবশ্যই নিজের পক্ষে) যুদ্ধের যে মতবাদ দিলেন কলিন পাওয়েল, সেখানে তো যুদ্ধ ছাড়াই যুদ্ধ। সমকালীন নব-সংজ্ঞায়নে রাজনীতি হয়েছে বিশেষজ্ঞের দ্বারা শাসনের শিল্প। এখানেও তো রাজনীতি ছাড়াই রাজনীতি। ফলে আমরা আজকের সহিষ্ণু উদারনৈতিক সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদিতার দিকে ধাবিত হয়েছি, যেখানে পাওয়া যাচ্ছে অন্য ছাড়া অন্যের অভিজ্ঞতা।
এভাবে নিষ্ক্রিয়করণের কৌশলকে সবচেয়ে ভালোভাবে সূত্রায়িত করেছেন ফরাসি ফ্যাসিবাদী তাত্ত্বিক রবার্ট ব্রাসিলাস, ১৯৩৮ সালে। তিনি নিজেকে ‘উদার’ ইহুদিবিরোধী মনে করতেন। তিনি যুক্তিসংগত ইহুদিবিরোধিতা তত্ত্বের প্রবক্তা। ‘চার্লি চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র দেখে আমরা হাততালি দিতে পারি। চ্যাপলিন অর্ধেক ইহুদি। প্রুস্তের প্রশংসা করতে পারি। তিনিও অর্ধেক ইহুদি। ইয়েহুদি মেনুহিনও বাহবা পেতে পারেন। তিনি ইহুদি।...আমরা কাউকে হত্যা করতে চাই না, কারও ওপর সংঘবদ্ধ নির্যাতন চালাতে চাই না। কিন্তু আমরা এটাও মনে করি যে সহজাত ইহুদিবিরোধিতা থেকে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়া ঠেকানোর সর্বোৎকৃষ্ট পথ হলো যুক্তিসংগত ইহুদি-বিরোধিতার আয়োজন।’
ইউরোপের সরকারগুলো যেভাবে ‘অভিবাসী হুমকি’ মোকাবিলা করছে, তাতে কি একই মানসিকতা প্রকাশ পাচ্ছে না? প্রত্যক্ষ লোকরঞ্জনবাদী বর্ণবাদ সঠিকভাবেই ‘অযুক্তিসংগত’ এবং গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, তারা ‘যুক্তিসংগতভাবে’ বর্ণবাদী সুরক্ষা ব্যবস্থা অনুমোদন করছে, কিংবা আজকের ব্রাসিলাসরা (এদের কেউ কেউ আবার সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট) যেমন বলছে, ‘আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপীয় খেলোয়াড়, এশীয় চিকিৎসক, ভারতীয় সফটওয়্যার প্রোগ্রামারদের নৈপুণ্যের আমরা প্রশংসা করতে পারি। আমরা কাউকে হত্যা করতে চাই না, কারও ওপর সংঘবদ্ধ নির্যাতন চালাতে চাই না। কিন্তু আমরা এটাও মনে করি যে সহজাত অভিবাসী-বিরোধী প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ থেকে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা ঘটার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো যুক্তিসংগত অভিবাসীবিরোধী সুরক্ষা ব্যবস্থা।’
নিজের চারপাশ থেকে বিষাক্ত উপাদান সরিয়ে ফেলার এই স্বপ্নের ভেতর প্রত্যক্ষ বর্বরতার পথ আড়াল করে মানবিক চেহারার বর্বরতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
স্লাভো জিজেক: স্লোভেনীয় দার্শনিক।

No comments

Powered by Blogger.