রশ্মি প্রযুক্তির চিকিৎসা নিয়ে ছেলেখেলা! by তৌফিক মারুফ

'দেশে রেডিওথেরাপি দেওয়ার পরও কোনো কাজ না হওয়ায় ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে নিয়ে গেলাম ভারতে। সেখানে চিকিৎসকরা জানালেন আগের চেয়ে আরো ক্ষতি হয়েছে। হয়তো সঠিকভাবে থেরাপি দেওয়া হয়নি। শুরু হয় নতুন করে চিকিৎসা।'


চিকিৎসা করাতে গিয়ে এমন বিপত্তির মুখে পড়ার কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি আরো বলেন, 'দেশে ফিরে ওই হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যাঁরা রেডিওথেরাপি দিয়েছিলেন তাঁরা আসলে উপযুক্ত ও দক্ষ ছিলেন না।'
দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বেশির ভাগ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি কয়েকটি অভিজাত হাসপাতালে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার কাজে এসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশির ভাগ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিই হচ্ছে রশ্মিভিত্তিক প্রযুক্তির। বিশেষ করে ক্যান্সার, হৃদরোগ, এইচআইভি চিকিৎসার ক্ষেত্রে এসব রশ্মিনির্ভর প্রযুক্তির ওপর বেশি ঝুঁকে পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও এসব যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে আনাড়ি হাতে। ফলে রোগীদের ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া এ প্রযুক্তি ব্যবহারের আইনকানুনও মানা হচ্ছে না যথাযথভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি এক ধরনের ছেলেখেলার মতো।
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কমিশনার ড. শাহানা আফরোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, রশ্মিভিত্তিক যেকোনো যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে অবশ্যই আণবিক শক্তি কমিশনের লাইসেন্স নিতে হবে। আগে এ বিধির খুব একটা প্রয়োগ দেখা না গেলেও এখন পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন দেশে যেসব রশ্মিভিত্তিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে এর মধ্যে রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং ডায়াগনস্টিক ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ শতাংশের লাইসেন্স রয়েছে। অন্যদেরও লাইসেন্সের আওতায় আনার কাজ চলছে।
ড. শাহানা আরো বলেন, 'বিধি অনুসারে স্বাস্থ্য সেক্টরের যেকোনো রেডিয়েশন মেশিনারিজের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই পিওর মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট (চিকিৎসা পদার্থবিদ) থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর হচ্ছে না।'
জার্মানভিত্তিক 'উন্নয়নশীল দেশে চিকিৎসা পদার্থবিদ প্রকল্প'-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক গোলাম আবু জাকারিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, রশ্মি দিয়ে চিকিৎসায় একদিকে যেমন কোনো মানুষের দেহের ক্যান্সারের কোষ মারা যায়, অন্যদিকে কোনো সুস্থ কোষে রশ্মি পড়লে সেখানে ক্যান্সার হতে পারে। এত দিন কনভেনশনাল পদ্ধতির এ রেডিওথেরাপি দেওয়া হতো বলে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার চিকিৎসায় আরোগ্য কম হতো। তবে কনফরমাল পদ্ধতির রেডিওথেরাপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর এখন আশপাশের কোষ ও অঙ্গ নিরাপদ রেখে শুধু ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোতে রশ্মি দেওয়া হয়। এ জন্য অবশ্যই দক্ষ মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট দরকার। তা না হলে রোগীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ এটা অত্যন্ত নিখুঁত পরিমাপের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়।
এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলেন, অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট, রেডিওথেরাপিস্ট ও টেকনিশিয়ানের সমন্বয়ে টিম দরকার। এ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট রশ্মি প্রয়োগের জন্য টিপিএস ব্যবস্থায় ছক তৈরি করবেন, রেডিওথেরাপিস্ট সিটিস্ক্যানারের মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করবেন এবং মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট ও রেডিওথেরাপিস্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে টেকনিশিয়ান রশ্মি প্রক্ষেপণ করবেন।
চিকিৎসা পদার্থবিদ অধ্যাপক গোলাম আবু জাকারিয়া জানান, প্রতি ইউনিট লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটরের জন্য দুজন মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট প্রয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এটা আইন করে ঠিক করা আছে। তবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ক্ষেত্রে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান করা হয়নি। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এর আগেই যে যার মতো করে এই স্পর্শকাতর চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করে দিয়েছে এ দেশে।
দেশের একজন খ্যাতিমান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, রশ্মিভিত্তিক চিকিৎসা নিয়ে দেশে যা চলছে তা ছেলেখেলা ছাড়া কিছুই নয়। এত বিপজ্জনক একটি প্রযুক্তি নিয়ে কেন সরকার হেলাফেলা করছে, তাও বোধগম্য নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসারে দেশে মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে কমপক্ষে ১৫০টি ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার, কিন্তু আছে মাত্র ১৫টির মতো। এসব কেন্দ্রে ক্যান্সার চিকিৎসার যন্ত্র আছে ২১টি। এসবের মধ্যে শক্তিধর রশ্মিভিত্তিক কোবাল্ট ৬০ এবং লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি সরকারিভাবে নতুন আরো পাঁচটি আইআর-১৯২ এবং ১১টি লিনিয়ার প্রযুক্তির যন্ত্র কেনার জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রোগ শনাক্তকরণের কাজে এখন রশ্মিভিত্তিক বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। তবে এগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
সূত্র মতে, এসব যন্ত্রপাতির জন্য দেশে কমপক্ষে ৬০০ মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট এবং এক হাজার রেডিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন। কিন্তু আছে মাত্র ৬০-৭০ জন রেডিওথেরাপিস্ট আর ২০ জনের মতো মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট। সরকারিভাবে একজনও নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই যন্ত্র সরবরাহ করেছে তারা তাদের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে কোথাও কোথাও মেডিক্যাল ফিজিসিস্টও দিয়েছে। এরা যন্ত্র সরবরাহকারী ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় বেশি সক্রিয় থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শিফায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, রেডিওথেরাপির জন্য আপাতত জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ছয়টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে নিয়োগবিধি না হওয়ায় এসব পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। নিয়োগবিধি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় আছে। এ ছাড়া সারা দেশের অন্য কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে পদ সৃষ্টির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে আনাড়ি লোকদের দিয়ে এসব যন্ত্র চালানোর ফলে সব সময়ের জন্যই ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, 'উপযুক্ত লোক দিয়ে এসব অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা না হলে বিপদ তো হতেই পারে। তবে যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠানেই এখনো জনবল নিয়োগ দিতে পারছি না, তাই বেসরকারি পর্যায়ে এসব মেশিন কিভাবে চলছে না চলছে তা মনিটরিং করা যাচ্ছে না।'
বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের নিউক্লিয়ার সেফটি অ্যান্ড রেডিয়েশন কন্ট্রোল ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, রেগুলেটরি গাইড অন রেডিয়েশন প্রটেকশন ইন রেডিওথেরাপি নামে নির্দেশিকায় জনবল নিয়োগ ও দায়িত্ব চ্যাপ্টারের ৬.১.৩ ধারায় বলা হয়েছে, রেডিওথেরাপি যন্ত্রের সঙ্গে দক্ষ মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট থাকতে হবে। যাঁদের ফিজিক্যাল সায়েন্স অথবা এমবিবিএস ডিগ্রির সঙ্গে যেকোনো অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট ডিগ্রি নেওয়া থাকবে তাঁরাই মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট হিসেবে গণ্য হবেন।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ফিজিকস সোসাইটির সভাপতি ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফিজিকস অ্যান্ড বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. হাসিন অনুপমা আজহারী কালের কণ্ঠকে বলেন, মেডিক্যাল ফিজিকস (চিকিৎসা পদার্থবিদ্যা) চারটি শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসাসেবা প্রদান ও প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। এগুলো হচ্ছে রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনস্টিক, নিউক্লিয়ার মেডিসিন এবং মেডিক্যাল হেলথ পদার্থবিদ্যা। মেডিকেল ফিজিকসে যাঁদের বিএসসি, এমএসসি বা পিইচডি ডিগ্রি আছে এবং যাঁরা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ওই চারটি শাখায় কাজ করেন তাঁরাই মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট হিসেবে পরিচিত।

No comments

Powered by Blogger.