বর্ষণ বিপর্যয়-পাহাড়ে লাশের মিছিল কি থামবে না?
গ্রীষ্মের তাপদাহে দগ্ধ বাঙালি যদিও বর্ষার জন্য অপেক্ষা করে থাকে; ভারসাম্যহীন প্রকৃতিতে ঋতুটি কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে, তার নজির কিন্তু এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে অন্তত ১শ' জনের প্রাণহানি কেবল শোকের নয়, ক্ষোভেরও।
নিহতের কেউ কেউ পাহাড়ি ঢল, দেয়ালচাপা ও বিদ্যুৎস্পর্শের শিকার হয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগেরই প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ধস। বস্তুত কয়েক বছর ধরে বর্ষাকাল এলেই পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড় ধসের আতঙ্ক দেখা দেয়। সংবাদমাধ্যমে আগাম সতর্কবাণীও ছাপা হয়; কিন্তু পরিস্থিতি তথৈবচ। আমাদের মনে আছে, ২০১০ সালের জুনের মাঝামাঝি কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার কয়েকটি এলাকায় পাহাড় ধসে সেনা সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। তারও আগে ২০০৭ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামের লেবুবাগান এলাকায় ১২৭ জনের এবং ২০০৮ সালের আগস্টে মতিঝর্ণা এলাকায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল পাহাড় ধসের কারণেই। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, সামনের দিনগুলোতে আরও কিছু মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ শিরোনাম হবে। আমাদের প্রশ্ন_ পাহাড়ে পাহাড়ে এই লাশের মিছিল কি চলতেই থাকবে? এই প্রশ্ন যেমন কর্তৃপক্ষের কাছে, তেমনি যারা পাহাড় কাটে; যারা মানুষের আশ্রয়হীনতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা ফাঁদে, তাদের প্রতিও। এসব মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় আমরা কেউই এড়াতে পারি না। আমাদের সামষ্টিক নির্লিপ্ততারই মাশুল গুনছে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষরা। অস্বীকার করা যাবে না যে, পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক নানা কারণ রয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের এসব অঘটনের জন্য প্রকৃতিকে দায়ী করার অবকাশ সামান্যই। এই পরিস্থিতিকে যদি কতিপয় লোভী মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকৃতির প্রতিশোধ আখ্যা দেওয়া যায়_ অত্যুক্তি হবে কি? আমরা দেখছি, গত তিন দশকে কেবল চট্টগ্রামেই তিন শতাধিক পাহাড় কাটা পড়েছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারেও। পাহাড় কাটার নেপথ্য চক্র সাময়িক সুবিধার জন্য স্থায়ী বিপর্যয় ডেকে আনছে। তারা ভুলে যায় যে, পাহাড় কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, পরিবেশগত ভারসাম্যও রক্ষা করে। এর বনজ ও কৃষিজসম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যগত গুরুত্বও ভুলে যাওয়া চলবে না। পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধস তো বটেই, ভূমিকম্পের শঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে যে জলাবদ্ধতা সাম্প্রতিককালে প্রকট হয়ে উঠছে, তার কারণও পাহাড় বিনাশী তৎপরতা। কারণ বন ও পাহাড় উজাড় হলে ভূমিক্ষয় বাড়ে এবং তাতে নালা, খাল ও নদী ভরাটের হার বাড়ে। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরেরও স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বৃষ্টিবাহিত পলি। এখনই সতর্ক না হলে আমাদের আরও বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গত কয়েক দিনের বর্ষণে মৃতদের জন্য আমরা গভীর শোক ও বেঁচে যাওয়াদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যাতে যথার্থ পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে দাবিও জানাচ্ছি। পাহাড় ধসের ঘটনার পরপরই স্থানীয় প্রশাসন যেভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু ধসের আগে আরও কম তৎপরতাতেই যে বেশি সুবিধা পাওয়া যেত, তাও মনে করিয়ে দিতে চাই। আত্মঘাতী এ তৎপরতা আর চলতে দেওয়া যায় না।
No comments