জলবায়ু সম্মেলন-আমি কেন কানকুনে যাচ্ছি? by মেরি রবিনসন

বিশ্ব এখন চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে মেক্সিকোর কানকুনে আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও জলবায়ুজনিত চরম মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের সক্ষমতা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই প্রশ্ন তুলছেন। তার পরও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদের সবাইকে এই ফোরামের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে।


জাতিসংঘের সক্ষমতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু আমি তাঁদের ভুল ভাঙাতে চাই এই বলে, কোনো উদ্যোগেরই রাতারাতি পরিবর্তন এনে দেওয়া সম্ভব নয়। আর এখন এসব বিতর্কের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এ কাজটি করতেই আমি কানকুনে যাচ্ছি, আর সেখানে গিয়ে আমার প্রথম কাজ হবে, রাজনৈতিক নেতাদের মনে করিয়ে দেওয়া, যেন তাঁরা একটি ফলপ্রসূ সমাধানের জন্য তাঁদের নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দেন। আমরা তাঁদের কাছে জলবায়ুর ন্যায্যতার দাবি করছি।
কয়েক দশক ধরে অক্সফামসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো সেসব মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে চলেছে। প্রতি রাতে যারা পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়, বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটিরও বেশি। সংগঠনগুলোর ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতা আসতে শুরু করেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এক আঘাতে মুহূর্তের মধ্যেই এত অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
একদিকে অনাবৃষ্টি, ঠিক তার পাশেই প্রলয়ঙ্করী বন্যা, এই ২০১০ সালে প্রকৃতির এমনই নির্মম আচরণ মনে করিয়ে দিয়েছে তার অনাগত হুমকি হবে আরও ভয়াবহ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতি আরও বেশি মোকাবিলা করতে হবে।
এর মধ্যে প্রকৃতির কিছু বিরূপ প্রভাব এমন অঞ্চলে আমরা দেখেছি, যা সেখানকার দারিদ্র্য ও অস্থিতিশীলতাকে আরও বেশি নাড়া দিয়েছে।
পাকিস্তান আমাদের সামনে এমন একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ভয়াবহ এক বন্যা লাখ লাখ পাকিস্তানির সহায়-সম্বল একেবারে ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে। খাদ্য আর সুপেয় পানির অভাব তাদের আরও মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তুলেছিল। সেখানে আমরা দেখতাম, জলবায়ুর নির্মম আচরণে দুর্গত মানুষের যে ক্ষতি হয়, বিশ্ববাসীর মানবিক সাহায্য তার খুব কম অংশই লাঘব করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই এর সমাধান বৈশ্বিকভাবেই হতে হবে। এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নারী, আদিবাসী জনগণ ও ঝুঁকির শিকার দেশগুলোর মানুষকে সাধারণত যুক্ত করা হয় না। কার্যকর সমাধান বের করতে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে। আর জাতিসংঘ হচ্ছে এসব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সবচেয়ে উপযুক্ত ফোরাম। আলোচনার মাধ্যমে একটি মতৈক্যে পৌঁছানো এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্বের দেশগুলোর কার্যকর সমঝোতা আমাদের আরও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে, যা কেবল আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান সম্ভব।
পারস্পরিক সমঝোতা, বোঝাপড়া যা-ই বলি না কেন, গত কয়েকটি আলোচনায় এর অগ্রগতি হতাশাজনক। অনেক দেশের মধ্যেই এ নিয়ে সদিচ্ছার অভাব দেখা গেছে। এত বাধা সত্ত্বেও সম্প্রতি কিছু আলোচনায় সত্যিই ভালো অগ্রগতি এসেছে। যেসব দেশ অধিক পরিমাণে কার্বন নির্গমন করে (যার মধ্যে কোনো উন্নয়নশীল ও জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশ নেই), সেসব দেশকে জাতিসংঘের অধীনে একটি আইনি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসার আর কোনো বিকল্প নেই।
কানকুন সম্মেলনকে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় দরিদ্র মানুষের কল্যাণে একটি বৈশ্বিক তহবিল গড়ে তুলতে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমি এমন একটি তহবিল গড়ে তোলার কথা বলছি, যা আসলে দরিদ্র দেশ ও ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। ফলে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে অনুন্নত দেশগুলোর কৌশলগত আস্থার পরিবেশ তৈরি করবে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও আলোচনার দুয়ার খুলে দেবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এমন একটি তহবিল গড়ে তোলা, যা কোনো অপচয় ও অপব্যবহার ছাড়াই যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার, যখন দরকার ঠিক তখনই তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করা হবে।
কিছুদিন আগে জাতিসংঘের একদল অর্থনৈতিক নীতি গবেষক একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, করদাতাদের ওপর বাড়তি কোনো চাপ বা বর্তমান উন্নয়ন সাহায্যের কোনো ব্যবহার ছাড়াই এই তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব। তাঁদের মতে, অধিক পরিমাণে কার্বন নির্গমনকারী আন্তর্জাতিক জাহাজ ও বিমান সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের ওপর বাড়তি কিছু করারোপ করেই বিলিয়ন ডলারের তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল ও এর প্রভাব কমাতে বিনিয়োগনীতি তৈরিতে রাজনৈতিক নেতাদের আগ্রহ খুব বেশি দিন চলতে দেওয়া যাবে না। তাঁদের বুঝতে হবে, এমন একটি তহবিলই পারে দ্রুত বিপদ কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তুলতে। বিশ্বনেতাদের একটি চুক্তি করে একে বাস্তব রূপ দিতে এগিয়ে আসতে হবে।
জলবায়ুর ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে কানকুন থেকে একটি সফল চুক্তি আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থতার প্রান্ত থেকে টেনে তুলতে পারে। কেবল এই বিশ্বাস থেকেই আমি সেখানে থাকব।
মেরি রবিনসন: অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের অনারারি প্রেসিডেন্ট। আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট (১৯৯০-৯৭) এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার (১৯৯৭-২০০২)।

No comments

Powered by Blogger.