শ্রমবাজারে বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের যথেষ্ট কদর আছে_এটি বহুশ্রুত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান থাকলেও অন্যতম কারণ হচ্ছে, সরকার ও জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।


প্রবাসের শ্রমবাজার আমাদের রেমিট্যান্স অর্জনের অন্যতম একটি প্রধান খাত।
দৃশ্যত জনশক্তি রপ্তানি খাত উন্নয়নে সরকার নানা পদক্ষেপের কথা বললেও বাস্তবে এর প্রতিফলন আশাব্যঞ্জক নয়। তা ছাড়া দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বাংলাদেশ অনেক দেশের শ্রমবাজার হারাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত। এর মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের এই উদ্বেগজনক রূপ ক্রমেই পুষ্ট হয়, তাহলে শুধু দুর্ভাবনাই নয়, নানাবিধ বিপর্যয়ের ছোবলেও আমাদের নতুন করে আক্রান্ত হতে হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব হবে বহুমুখী। দেশে দক্ষ শ্রমিক গড়তে বিলম্বে হলেও সরকারের নতুন কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, যা অত্যন্ত প্রয়োজন। এক পরিসংখ্যান সূত্রে প্রকাশ, ২০০০ সালে বিদেশে প্রফেশনাল জনশক্তি ছিল ৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে তা কমে শূন্যের কোটায় ঠেকে। অন্যদিকে অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যাও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নিকট অতীতেও কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পরিলক্ষিত হয়েছে, কিন্তু আমরা তা কোনো কাজে লাগাতে পারিনি। আশার কথা, নারী জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে এদিকে ঢুকে পড়েছে কতিপয় অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারক, যাদের দ্বারা নারীরা প্রতারিত হচ্ছেন এবং দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে আমাদের দক্ষ নারী জনশক্তির চাহিদা আছে। কিন্তু দক্ষ জনশক্তি আমরা এখন পর্যন্ত (নারী ও পুরুষ) উল্লেখযোগ্য হারে গড়ে তুলতে পারিনি। পেশাদারদেরও এ ব্যাপারে নীতিমালা ও দূরদর্শী কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ দক্ষ ও পেশাদার জনশক্তি রপ্তানি করতে পারলে রেমিট্যান্স অর্জনের চিত্রটা আরো অনেক অনেক বেশি পুষ্ট হতো। একটা কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বর্তমান শ্রমবাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে অভিবাসন ব্যয় হ্রাস, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি, অভিবাসনের পর কর্মীদের সহযোগিতা দান এবং দূতাবাসগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো জরুরি। বর্তমান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নিতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে কালবিলম্ব না করে। পাশাপাশি জনশক্তি রপ্তানি খাতে যে দুর্নীতি চক্র তৎপর রয়েছে, এর মূলোৎপাটন করতে হবে। বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিকে অবশ্যই স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত করতে হবে। পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার। দু-একটি শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা যে আকস্মিক বিপদ ডেকে আনতে পারে, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই আছে। আমাদের অনেক দূতাবাসের কর্মকাণ্ড নেতিবাচকভাবে ঘুরেফিরেই আলোচনায় আসছে। দূতাবাসগুলোতে কর্মরতদের অদক্ষতার বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত। তাঁরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সরকার যদি এ ব্যাপারে অধিকতর তৎপর হয়, তবে আমাদের শ্রমবাজারের বিবর্ণ চিত্র মুছে ফেলা দুরূহ নয়। কারণ বাংলাদেশের দক্ষ-আধাদক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের শ্রমের মজুরি বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় কম এবং বাংলাদেশের কর্মীরা দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান_এই সুনামটুকু আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে এখন পর্যন্ত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.