চারদিক-ঠিকানাবিহীন চিঠি by ফারহানা ইসলাম
আজ ২৬ নভেম্বর। অতুল তোমার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ তুমি ২৩-এ পা দিতে। কিন্তু তুমি বেঁচে নেই। চলে গেছ না-ফেরার দেশে। চিকিৎসকদের প্রচণ্ড অবহেলায় আজ আমরা তোমাকে হারিয়েছি। হয়তো অতটুকু জীবনই তুমি নিয়ে এসেছিলে।
আজ অর্ণবের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ঘাতক ট্রাক অর্ণবকে বাঁচতে দেয়নি। মাত্র ১৯ বছর বয়সে অর্ণব সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছে তোমার কাছে। কী কঠিন সময় পার করছি আমরা এই সন্তানহারা মা-বাবা আর স্বজনেরা। আলোর আম্মা, ফয়সালের আম্মা আরও কত সন্তানহারা মা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। এই সুন্দর পৃথিবীর কোনো সুন্দরই আজ আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে না। তোমাদের হারিয়ে আজ আমরা জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছি। তোমাদের হাজারো স্মৃতি আমাদের প্রতি মুহূর্তে আনমনা করে রাখে। খুব লজ্জা করে তুমিবিহীন পৃথিবীতে কেন বেঁচে আছি, এই ভেবে। আমাদের তো যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। তোমরা কেন বাঁচতে পারলে না। পৃথিবীর রং, রস কিছুই তো তোমরা উপভোগ করতে পারলে না। ভুল চিকিৎসায়, সড়ক দুর্ঘটনায়, নৌকাডুবি—আরও বিভিন্ন কারণে আর কত মায়ের কোল খালি হবে? আর কত মা দিনরাত চোখের জল ফেলে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে ফিরবে।
এখনো বিশ্বাস হয় না অতুল, তুমি নেই। তুমি চলে গেছ। হাজারো মানুষের ভিড়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াই। কান পেতে রই কলবেলের শব্দ শুনব বলে। ‘মা’ ডাক শোনার জন্য আনচান করে ওঠে মন। তোমার ঘর, তোমার বিছানা আমাকে ভালো থাকতে দেয় না। যেদিন তুমি চলে গেছ সেদিনই আমি মরে গেছি। বেঁচে আছে শুধু আমার এই নশ্বর দেহ। বড় কষ্ট বাবা, সন্তান হারিয়ে কোনো মা-ই বেঁচে থাকতে পারে না, এটা সম্ভব নয়। এই জগৎ-সংসারের কোনো উপকারই আর আমাদের দিয়ে হবে না। তবুও রোজ ভোর হয়, পাখি ডাকে, দিন পেরিয়ে রাত হয়; আর ভাবি, কবে দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে বলব, আমাকে একা রেখে এভাবে চলে এলে? হয়তো বাঁচতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারলে না।
তোমাকে অনেক বড় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তোমাকে ফিরে পেলাম না। ভার্সিটিতে পরীক্ষা শেষ করে বের হয়েই তুমি অসুস্থ বোধ করো। প্রচণ্ড গরমে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তোমার বন্ধুরা আমাকে ফোন করল। পাগলের মতো ছুটলাম বনানীর দিকে। প্রচণ্ড যানজটে আমি আটকে গেলাম। তোমার বন্ধুদের ফোন করে বললাম, দেরি কোরো না; হাসপাতালে নিয়ে যাও। ওরা তা-ই করল। একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমি পৌঁছালাম এক ঘণ্টা পর। গিয়ে দেখলাম তোমাকে ইমার্জেন্সিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বিনা অক্সিজেনে, বিনা চিকিৎসায়। আমি পাগলের মতো চিকিৎসককে বললাম, ছেলের অবস্থা কী? চিকিৎসক বলল, আপনারা বাইরে গিয়ে বসেন, আমরা দেখছি। দুই ঘণ্টা পর বলল, আমরা সিটি স্ক্যান করব। নিয়ে গেল স্ক্যানিং রুমে। বের হয়ে বলল ব্রেন স্ট্রোক। ‘অপারেশন থিয়েটার’ খালি নেই, এই অজুহাতে আরও দু-তিন ঘণ্টা পার হলো। তারপর অপারেশন করল, তারপর সব শেষ। আমার সাজানো বাগান এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেল।
আমি বাকশূন্য হলাম, আমি স্তব্ধ পাথর হলাম। প্রচণ্ড বেদনায় নীল হলো আমার অনুভূতি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টের মুখোমুখি হলাম। একটি প্রশ্ন আছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? উত্তর, ‘পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ’। আসলে কি তুমি একাই লাশে পরিণত হলে? না আমরা সবাই হলাম। তোমার বাবা, আমি, হিমেল, অয়ন। প্রচণ্ড রকম সুখী একটি পরিবার এক নিমেষে ধ্বংস হলো, আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার সবকিছু তছনছ হয়ে গেল!
বড় কষ্ট বাবা এই বেঁচে থাকা! কষ্ট হয় সকাল নয়টায় তুমি যখন ভার্সিটিতে যেতে, কষ্ট হয় বিকেলটায়, যখন তুমি বাসায় ফিরে আসতে, এসে বলতে, মা ভাত দাও। কষ্ট হয় ফোন বেজে উঠলে, মনে হয় কোথায় তুমি আর কোথায় আমি। কত কষ্টের কথা বলব অতুল! কত হাজার স্মৃতি তোমাকে ঘিরে। সন্তানহারা কিছু মা আমাকে খুঁজে বের করেছেন, আমিও তাঁদের খুঁজে পেয়েছি। সবার কষ্টের রং এক। আনন্দের নানা রং হয় কিন্তু কষ্টের রং একটাই, নীল। সবাই আমরা হাতড়ে ফিরি আমাদের হারানো সন্তানকে। অর্ণবের আম্মুর বিশ্বাস, একদিন অর্ণব ফিরে আসবে, মাকে ছুঁয়ে কথা বলবে। তাই অর্ণবের ঘরে নিদ্রাহীন রাত কাটান। মেডিকেল-পড়ুয়া আলোর আম্মু আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ছেলের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেন, ফয়সালের আম্মু ড্রয়িংরুমে বাঁধানো ছেলের বিরাট ছবির সঙ্গে কথা বলেন সারা দিন, আরও কত মায়ের কত রকমের পাগলামি।
আসলে আমরা কেউ স্বাভাবিক নই, এই তো রোজ তোমার গোছানো ঘরটা আবার গোছাই। তোমার গিটার, তোমার কম্পিউটার, তোমার জামাকাপড় তেমনই আছে। শুধু তুমি নেই! তোমার পছন্দের রান্নাগুলো আর রান্না করা হয় না। তুমি অনেক জোরে গান শুনতে। সব সময় বলতাম, আস্তে বাজাও, প্রতিবেশীরা বিরক্ত হবে। আজ কান পেতে রই সেই গান শোনার জন্য। কেউ আর গান বাজায় না। তুমিবিহীন এই পৃথিবী আজ আমাকে আর টানে না। তবুও তোমার অপেক্ষায় থাকি।
এখনো বিশ্বাস হয় না অতুল, তুমি নেই। তুমি চলে গেছ। হাজারো মানুষের ভিড়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াই। কান পেতে রই কলবেলের শব্দ শুনব বলে। ‘মা’ ডাক শোনার জন্য আনচান করে ওঠে মন। তোমার ঘর, তোমার বিছানা আমাকে ভালো থাকতে দেয় না। যেদিন তুমি চলে গেছ সেদিনই আমি মরে গেছি। বেঁচে আছে শুধু আমার এই নশ্বর দেহ। বড় কষ্ট বাবা, সন্তান হারিয়ে কোনো মা-ই বেঁচে থাকতে পারে না, এটা সম্ভব নয়। এই জগৎ-সংসারের কোনো উপকারই আর আমাদের দিয়ে হবে না। তবুও রোজ ভোর হয়, পাখি ডাকে, দিন পেরিয়ে রাত হয়; আর ভাবি, কবে দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে বলব, আমাকে একা রেখে এভাবে চলে এলে? হয়তো বাঁচতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারলে না।
তোমাকে অনেক বড় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তোমাকে ফিরে পেলাম না। ভার্সিটিতে পরীক্ষা শেষ করে বের হয়েই তুমি অসুস্থ বোধ করো। প্রচণ্ড গরমে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তোমার বন্ধুরা আমাকে ফোন করল। পাগলের মতো ছুটলাম বনানীর দিকে। প্রচণ্ড যানজটে আমি আটকে গেলাম। তোমার বন্ধুদের ফোন করে বললাম, দেরি কোরো না; হাসপাতালে নিয়ে যাও। ওরা তা-ই করল। একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমি পৌঁছালাম এক ঘণ্টা পর। গিয়ে দেখলাম তোমাকে ইমার্জেন্সিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বিনা অক্সিজেনে, বিনা চিকিৎসায়। আমি পাগলের মতো চিকিৎসককে বললাম, ছেলের অবস্থা কী? চিকিৎসক বলল, আপনারা বাইরে গিয়ে বসেন, আমরা দেখছি। দুই ঘণ্টা পর বলল, আমরা সিটি স্ক্যান করব। নিয়ে গেল স্ক্যানিং রুমে। বের হয়ে বলল ব্রেন স্ট্রোক। ‘অপারেশন থিয়েটার’ খালি নেই, এই অজুহাতে আরও দু-তিন ঘণ্টা পার হলো। তারপর অপারেশন করল, তারপর সব শেষ। আমার সাজানো বাগান এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেল।
আমি বাকশূন্য হলাম, আমি স্তব্ধ পাথর হলাম। প্রচণ্ড বেদনায় নীল হলো আমার অনুভূতি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টের মুখোমুখি হলাম। একটি প্রশ্ন আছে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? উত্তর, ‘পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ’। আসলে কি তুমি একাই লাশে পরিণত হলে? না আমরা সবাই হলাম। তোমার বাবা, আমি, হিমেল, অয়ন। প্রচণ্ড রকম সুখী একটি পরিবার এক নিমেষে ধ্বংস হলো, আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার সবকিছু তছনছ হয়ে গেল!
বড় কষ্ট বাবা এই বেঁচে থাকা! কষ্ট হয় সকাল নয়টায় তুমি যখন ভার্সিটিতে যেতে, কষ্ট হয় বিকেলটায়, যখন তুমি বাসায় ফিরে আসতে, এসে বলতে, মা ভাত দাও। কষ্ট হয় ফোন বেজে উঠলে, মনে হয় কোথায় তুমি আর কোথায় আমি। কত কষ্টের কথা বলব অতুল! কত হাজার স্মৃতি তোমাকে ঘিরে। সন্তানহারা কিছু মা আমাকে খুঁজে বের করেছেন, আমিও তাঁদের খুঁজে পেয়েছি। সবার কষ্টের রং এক। আনন্দের নানা রং হয় কিন্তু কষ্টের রং একটাই, নীল। সবাই আমরা হাতড়ে ফিরি আমাদের হারানো সন্তানকে। অর্ণবের আম্মুর বিশ্বাস, একদিন অর্ণব ফিরে আসবে, মাকে ছুঁয়ে কথা বলবে। তাই অর্ণবের ঘরে নিদ্রাহীন রাত কাটান। মেডিকেল-পড়ুয়া আলোর আম্মু আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ছেলের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলেন, ফয়সালের আম্মু ড্রয়িংরুমে বাঁধানো ছেলের বিরাট ছবির সঙ্গে কথা বলেন সারা দিন, আরও কত মায়ের কত রকমের পাগলামি।
আসলে আমরা কেউ স্বাভাবিক নই, এই তো রোজ তোমার গোছানো ঘরটা আবার গোছাই। তোমার গিটার, তোমার কম্পিউটার, তোমার জামাকাপড় তেমনই আছে। শুধু তুমি নেই! তোমার পছন্দের রান্নাগুলো আর রান্না করা হয় না। তুমি অনেক জোরে গান শুনতে। সব সময় বলতাম, আস্তে বাজাও, প্রতিবেশীরা বিরক্ত হবে। আজ কান পেতে রই সেই গান শোনার জন্য। কেউ আর গান বাজায় না। তুমিবিহীন এই পৃথিবী আজ আমাকে আর টানে না। তবুও তোমার অপেক্ষায় থাকি।
No comments