স্মরণ-একজন শহীদ জননীর কথা by সেলিনা আখতার

একাত্তরের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অবাক বিস্ময়ে তারা প্রত্যক্ষ করেছে স্বৈরশাসক এরশাদের দীর্ঘ নয় বছরের নির্যাতন, নিষ্পেষণ ও সীমাহীন দুর্নীতি। দেখেছে পেশাজীবীদের আন্দোলন কীভাবে গণ-আন্দোলনে এবং পরে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।


আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরিরা কীভাবে নিঃশঙ্কচিত্তে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
প্রতিবছর মিলন দিবসে এ লেখাটি লিখতে বসে হূদয়ের গহিনে অব্যক্ত ব্যথাগুলো আমার সমগ্র অস্তিত্বকে ওলটপালট করে দেয়। অবিরত অশ্রুজলে ভাসতে থাকি, লেখনী স্তব্ধ হয়ে যায়, কলম থেমে যায়, কথা ফুরিয়ে যায়। মন কেঁদে বলে, ‘কোথায় চলে গেলি বাবা! কেন চলে গেলি এমন অকালে, অসময়ে!’ লোকে বলে, তোমাকে হারিয়ে আমি নাকি গরীয়সী জননী হয়েছি। একজন সন্তানহারা মা, তার শূন্য হূদয়ে এমন গৌরব ধারণ করে স্বস্তির জীবন কাটাতে পারে কি?
একজন শহীদের মা হিসেবে আমি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের শহীদের হত্যার বিচার চাই। এই বাংলার মাটিতে আমি সন্তানের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। হূদয়ের গভীরে পুঞ্জীভূত বেদনা ২০ বছর ধরে সযত্নে লুকিয়ে রেখে আমি জনগণের কাছে, প্রতিটি সরকারের কাছে মিলনের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে আসছি। ২০টি বছর আমি নীরবে-নিভৃতে কেঁদে চলেছি, কিন্তু আমার সন্তান হত্যার বিচার পাইনি। ২০ বছর আগে একটি প্রহসনমূলক বিচার হয়েছিল, যে বিচারে মিলন হত্যাকারীকে শনাক্ত করা যায়নি, সাক্ষীর অভাবে।
স্বৈরাচার এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে জেহাদ, নূর হোসেন, রাওফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ার, তাজুল আর সর্বশেষ ডা. মিলনসহ আরও নাম না জানা অনেক দেশপ্রেমিক তরুণকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য সব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য হলেও কেবল এ হত্যাগুলোর সূত্র ধরেই এরশাদের বিচার হওয়া উচিত এবং বিচার করা সম্ভব।
জেনারেল এরশাদ সময় ও সুযোগ বুঝে সাপের মতো খোলস বদলান। সম্প্রতি টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নূর হোসেন কোনো বিখ্যাত নেতা বা ব্যক্তি ছিল না। কে বা কারা তাঁকে হত্যা করেছে, তিনি জানেন না। আর ডা. মিলন কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিল না। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এরশাদ মিথ্যাচার করলেন অবলীলায়। ডা. মিলন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশাযোগে পিজি হাসপাতালে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি সভায় যোগদান করতে যাওয়ার পথে, টিএসসি চত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। সে সময় এরশাদ একটি গণস্বার্থবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করে। দেশের সমগ্র চিকিৎসক সমাজ এই স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের দাবিতে সে সময় আন্দোলনরত। ডা. শামসুল আলম খান মিলন চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ছিল চিকিৎসক সমাজের সামনের সারিতে। এই আন্দোলনে ডা. মিলন আপসহীন নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল বলেই এরশাদ সরকারের রোষানলে পড়ে।
মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় ১৯৮১ সালে মিলন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। সে বছর মিলন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়। মজিদ খান শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৫ সালে তিন পেশাজীবীর আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়। ওই বছর এরশাদ সরকারের অবৈধ এমএলআর-৯ অনুযায়ী মিলনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ১৯৮৫ সাল থেকেই মূলত এরশাদ সরকারের কুদৃষ্টি পড়ে মিলনের ওপর। তাই চাকরি ক্ষেত্রে তাকে নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়। এমফিল ডিগ্রি লাভের জন্য আইপিজিএমআরে ভর্তি হলেও পাঁচ মাস পর ডেপুটেশন বাতিল করা হয় অনৈতিকভাবে। চিকিৎসক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ও সহজলভ্য করার লক্ষ্যে তৎকালীন বিএমএ মিলনের নেতৃত্বে বারবার আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এসব নিশ্চয়ই এরশাদের অজানা থাকার কথা নয়। এমন একজন রাজনীতিসচেতন ও সংগ্রামী মানুষের কথা জেনেও কি এরশাদ সাহেব বলবেন, ডা. মিলন কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিল না, তাকে তিনি চিনতেন না বা তাকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়নি?
জেনারেল এরশাদ কয়েকবার বলেছেন, ডা. মিলন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। তাঁর এ উক্তিটিও অসত্য। প্রত্যক্ষদর্শী ও সাংবাদিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২৭ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত টিএসসি চত্বরে কোনো গোলাগুলি হচ্ছিল না। ডাকসু চত্বরের সম্মুখে ছাত্ররা এরশাদবিরোধী মিছিল করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। এ কথাগুলো তৎকালীন ছাত্রনেতাদের ভাষ্য থেকে জানতে পেরেছি। মিলনের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, তার জীবনপ্রদীপ কেড়ে নিয়েছিল একটি মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেলের বুলেট। এই অস্ত্র কাদের হাতে থাকে, এটা নিশ্চয়ই এরশাদের জানা।তাই দেশবাসীর কাছে আমার জিজ্ঞাসা, জেনারেল এরশাদকে কি ডা. মিলন হত্যাকারীরূপে চিহ্নিত করা যায় না?
প্রতিটি জাতীয় অর্জনের অন্তরালে রয়েছে কত না মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ, স্বামীহারা কত বধূর বেদনাবিধুর অশ্রুজল, কত পিতৃহারা সন্তানের বুকের হাহাকার। তথাপি এ জাতি বারবার অশ্রু মুছে, শক্তি সঞ্চয় করে, আশায় বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছে আলোকিত ভবিষ্যতের আশায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বারবার জনগণের সে আশা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে কিছু স্বার্থান্বেষী, অর্থলিপ্সু মানুষের কারণে। হিসাবের খাতা খুলে কেবল রক্ত খরচের হিসাবটাই দেখা দেয়, অর্জনের পাতা প্রায় শূন্যের কোঠায় পড়ে থাকে।
যুবক মিলনের চিন্তাচেতনাজুড়ে ছিল এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তি। তাই আপন ভুবনের পারিপার্শ্বিকতার প্রতি মিলন ছিল উদাসীন। সে নিজ জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের সবটুকু উপেক্ষা করে, জীবনকে গতিময় করেছে রাজপথে, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের দৃঢ় সংকল্পে। সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে কোনো আপস ছিল না তার চরিত্রে, ছিল না সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ কোনো দিন। মিলনের কাছে আপন সমৃদ্ধির চেয়ে, মায়ের দাবির চেয়ে, দেশের সমৃদ্ধির দাবি, অবহেলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের দাবি ছিল অনেক বেশি, অনেক বড়।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলার সন্তানেরা মিলনের রক্তস্নাত রাজপথকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছিল, এ দেশের বুক থেকে পেশিশক্তি নির্মূল করবে। কথা দিয়েছিল গণতান্ত্রিক নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির। তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল, এ দেশের হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য নিয়ে যারা পুনরায় ছিনিমিনি খেলার প্রয়াস পাবে, তাদের ক্ষমা করবে না। আমি আমার বিদগ্ধ অস্থির অন্তর নিয়ে, তাদের এই সংগ্রামপ্রত্যয়ী অঙ্গীকারগুলোর বাস্তব রূপায়ণ দেখার আশায় উন্মুখ হয়ে আছি এবং থাকব। যত দিন তারা তাদের এই অঙ্গীকারগুলোর বাস্তব রূপায়ণে ব্যর্থ হবে, তত দিন এ দেশের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিপন্নই থেকে যাবে।
সেলিনা আখতার: নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ডা. মিলনের মা।

No comments

Powered by Blogger.