মিডিয়া ভাবনা-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নীতিমালা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
গত ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের সূত্র ধরে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটির বিষয় ছিল প্রিন্ট মিডিয়া। আজ এর দ্বিতীয় কিস্তি লিখছি ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্পর্কে। প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা’।
সেদিনের গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য প্রথম আলোয় গত ৩ নভেম্বর বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলো অতি সংক্ষেপে আজ এখানে নিবেদন করছি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নের দাবি জোরদার হয়েছে। কিন্তু দুই বছরেও তা অগ্রসর হয়নি। নীতিমালা তৈরি হওয়ার আগেই সরকার কোনো প্রকাশ্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১১টি টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দিয়েছে। মনে করা হয়, এসব লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার আগের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমালোচিত নীতিই অনুসরণ করেছে। এটা দিনবদলের লক্ষণ নয়। সম্প্রচার-নীতিমালা নিয়ে তথ্যমন্ত্রী সুযোগ পেলেই নানা কথা বলেন। কিন্তু এ জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি এখনো গঠন করেননি। কবে কমিটি গঠন করা হবে, কবে তারা কাজ করবে, কবে তারা খসড়া প্রণয়ন করবে, কবে তা আলোচনার জন্য প্রকাশ করা হবে, কবে তা চূড়ান্ত করা হবে তা একমাত্র তথ্যমন্ত্রীই ভালো জানেন। অবশ্য তথ্য মন্ত্রণালয় যদি গোপনে শুধু আমলাদের দিয়ে ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নে কাজ করে থাকে, তা আমার জানার কথা নয়। তা ছাড়া এ ধরনের নীতিমালা এককভাবে আমলাদের তৈরি করার কথা নয়, উচিতও নয়। কারণ আমলারা বিশেষজ্ঞ নন। এ দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ে সরকারের যত সমালোচনা হচ্ছে তা বন্ধ করার একমাত্র পথ হলো একটি গ্রহণযোগ্য সম্প্রচার-নীতিমালা প্রণয়ন করা। যে নীতিমালায় মোটামুটি প্রাসঙ্গিক সব বিষয় সম্পর্কে নির্দেশনা থাকবে। এখন বিচ্ছিন্নভাবে লাইসেন্স প্রদান, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া, বিটিভির খবর চাপিয়ে দেওয়া, পরোক্ষ চাপ দেওয়া, বিটিভির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি প্রসঙ্গ আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। একটা নীতিমালার আলোকেই তা করতে হবে।
প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলই কমবেশি ‘রাজনীতি’ করছে। তার ফল তারা রাজনৈতিকভাবে পেয়েছে ও পাবে। আমাদের বর্তমান দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। বন্ধ করতে হলে আগে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিশুদ্ধ করতে হবে। সেটা খুব কঠিন কাজ। পাঁচ-দশ বছরে তা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমি আশা করব, তথ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে আর বক্তব্য না দিয়ে ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে তাদের কাজ শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেবেন। সেটাই এখন সময়ের দাবি। ইতিমধ্যে বহু সময় নষ্ট হয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা বলতে টিভি ও বেতারের মালিকেরা কী বুঝেছেন তা নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করা দরকার। শুনেছি তাঁদের একটি ‘ফোরাম’ রয়েছে। এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই ফোরাম বহু কাজ করতে পারে। যেমন, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে একটা সর্বসম্মত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, প্রত্যেক চ্যানেলের পৃথক সম্পাদকীয় নীতিমালার পাশাপাশি একটা কমন নীতিমালা প্রণয়ন ও তা মেনে চলার অঙ্গীকার করা, সরকারের অবাঞ্ছিত নির্দেশ, গাইডলাইন ও পরামর্শ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা, বিজ্ঞাপন প্রচার নীতিমালা ঠিক করা, নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক করা ইত্যাদি। যেসব নীতিমালা এই ফোরাম চূড়ান্ত করবে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। যাতে কেউ নীতিমালা লঙ্ঘন করলে দর্শক-শ্রোতারা তাদের মনে করিয়ে দিতে পারেন; ফোরামও যেন ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রথম আলোর গোলটেবিল আলোচনায় বিভিন্ন বক্তা বলেছেন, এখন নবীন টিভি সাংবাদিকেরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই টিভি চ্যানেলে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের আরও উচ্চ বেতনে অন্য চ্যানেল ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন গীতিআরা নাসরীন বলেছেন, ‘বিভাগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের কোর্স সমাপ্তির আগেই ছাত্রছাত্রীদের চাকরি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।’ টিভি অনুষ্ঠান ও টিভি সাংবাদিকতা কোন দিকে যাচ্ছে তা এসব মতামত বা মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। দুর্বলদের ভিড়ে কিছু যোগ্য ছেলেমেয়েও টিভি চ্যানেলে কাজ করছে, এটা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। তবে কোনো ডিগ্রিই গণমাধ্যমে কাজ করার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রশিক্ষণ কে দেবে? সরকারের ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ (নিমকো) এ ব্যাপারে আদর্শ প্রতিষ্ঠান নয়। তা ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার নানা বিড়ম্বনা রয়েছে। ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন। আমার প্রস্তাব, টিভি ও বেতারের মালিকেরা নিজেদের উদ্যোগে একটি ছোট প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে পারেন। যেখানে চাকরিপ্রার্থীরা মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে ছয় মাসের একটি ফাউন্ডেশন কোর্স সম্পন্ন করবে। শুধু কৃতকার্য প্রার্থীরাই কোনো টিভি/বেতার চ্যানেলে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে।
এর সঙ্গে গবেষণা বিভাগে থাকবে নানা ‘অনুষ্ঠান মতামত জরিপ’ ও ‘অনুষ্ঠান চাহিদা জরিপ’ কর্মসূচি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণ খরচ দিয়ে তাদের ‘অনুষ্ঠান’ সম্পর্কে দর্শক/শ্রোতার মতামত জরিপ করিয়ে নেবে। জরিপের ফলাফল প্রকাশও করা যায়, গোপনও রাখা যায়। এটা চ্যানেলের ব্যাপার। টিভি/বেতার চ্যানেল তাদের ভবিষ্যৎ অনুষ্ঠান পরিকল্পনার জন্য ‘চাহিদা জরিপ’ও করতে পারে। দর্শক-মতামত বা চাহিদা জরিপের কর্মপদ্ধতির ওপর চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ পেশাদারি পদ্ধতিতে পরিচালনা করবে। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আগেই প্রশ্নমালা, দর্শক গ্রুপ, বয়স, স্থান, সংখ্যা অনুমোদন করে দেবে।
সরকার, বিবিসি বা কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর সর্বদা নির্ভরশীল না থেকে এ দেশের টিভি/বেতারের মালিকেরা নিজেরাই একটি সম্পূর্ণ পেশাদার ‘প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ গড়ে তুলতে পারে। বিবিসি, ডয়সে ভেলে বা ভারতীয় টিভি চ্যানেল থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ সব সময়ই থাকবে। সরকার যদি জমি দেয় বা একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দেয় তা ভেঙে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়া কোনো বিরাট প্রকল্প নয়। তবে এখনই একটি ভাড়াবাড়িতে তা শুরু করা যেতে পারে। জাতীয় প্রেসক্লাবকে সরকার জমি ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারলে টিভি মিডিয়ার জন্যও সরকার এ রকম সহযোগিতা করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এখনো প্রিন্ট মিডিয়ানির্ভর। প্রেস কাউন্সিলের আইন ও নীতিমালাও যুগোপযোগী নয়। এই আইন ও নীতিমালা সংস্কারের কাজ চলছে বলে শুনেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক, মিডিয়া বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের নেতা ও একাডেমিক জগতের মতামত নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস কাউন্সিল আইন ও নীতিমালা সংশোধন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি পৃথক বিভাগ করার উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত। টিভি বা বেতারের খবর বা অনুষ্ঠানের কারণে কোনো দর্শক বা শ্রোতা যদি অসম্মানিত হন, তাহলে তিনি যেন সুবিচার পেতে পারেন বা দোষী ব্যক্তির যেন শাস্তি হয়, প্রেস কাউন্সিলকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। টিভি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম। প্রেস কাউন্সিল সক্রিয় না হলে টিভি মিডিয়ার অপব্যবহার হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ইতিমধ্যে কিছু অপব্যবহার হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেখা গেলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা বা পার্শ্ববর্তী সাত রাজ্যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না। অনেকবার এ নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখেছি, তথ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এই জট খোলা সম্ভব হবে।
পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল প্রচার না করা সার্কচেতনার পরিপন্থী। আমরা ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, সীমান্ত হাট, ব্যবসার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ কত বড় বড় সহযোগিতামূলক কাজ শুরু করছি। অথচ টিভি চ্যানেল দেখানোর মতো একটা খুব সামান্য কাজ ভারত করতে দিচ্ছে না। এটা খুবই নিন্দনীয়। যারা এ জন্য দায়ী (সরকার নয়), তারা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বিরোধী, তাদের চিহ্নিত করা দরকার। তবে আমি আশাবাদী, তথ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন এবার উদ্যোগী হলে বিষয়টির একটা সমাধান হবে।
অনেকে বলতে পারেন, ‘ইলেকট্রনিক মিডিয়া একান্তই প্রাইভেট সেক্টরের বিষয়। সেখানে এত নীতিমালার চাপাচাপি করছ কেন? মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তারা যা খুশি তা করবে।’ এ রকম বক্তব্য আসতেই পারে। মনে রাখা দরকার, মিডিয়া একটা ব্যবসা হলেও তা আলু-পটোলের ব্যবসার মতো নয়। আলু-পটোলে ভেজাল দিলে অল্প লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু মিডিয়া প্রভাবিত করে কোটি কোটি মানুষকে। মিডিয়া খুব শক্তিশালী একটি অস্ত্র। তাই এই অস্ত্রের ব্যবহার জানতে হবে। যারা এই অস্ত্রের ব্যবহার জানে না তাদের শেখাতে হবে। যাদের এই অস্ত্রের অপব্যবহার করার আশঙ্কা থাকে তাদের আদৌ এই অস্ত্র কিনতে দেওয়া উচিত হবে কি না তা সরকারকে দেখতে হবে। কাজেই নানাভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে সরকারের দৃষ্টি রাখতে হয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণ বা খবরদারির জন্য নয়। মিডিয়া একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তবে সেই স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতাও থাকতে হবে। যারা দায়িত্বশীল নয়, তাদের মুখে স্বাধীনতার দাবি মানায় না।
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া একটি বিকাশমান শিল্প। এখনো তার প্রাথমিক অবস্থা। সামনে রয়েছে দীর্ঘ পথ। তাই এখনই এই বিকাশমান শিল্পকে ঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নানা সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে আর বক্তব্য বা গোলটেবিল নয়, এবার কাজ করার পালা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নের দাবি জোরদার হয়েছে। কিন্তু দুই বছরেও তা অগ্রসর হয়নি। নীতিমালা তৈরি হওয়ার আগেই সরকার কোনো প্রকাশ্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ১১টি টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দিয়েছে। মনে করা হয়, এসব লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার আগের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমালোচিত নীতিই অনুসরণ করেছে। এটা দিনবদলের লক্ষণ নয়। সম্প্রচার-নীতিমালা নিয়ে তথ্যমন্ত্রী সুযোগ পেলেই নানা কথা বলেন। কিন্তু এ জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি এখনো গঠন করেননি। কবে কমিটি গঠন করা হবে, কবে তারা কাজ করবে, কবে তারা খসড়া প্রণয়ন করবে, কবে তা আলোচনার জন্য প্রকাশ করা হবে, কবে তা চূড়ান্ত করা হবে তা একমাত্র তথ্যমন্ত্রীই ভালো জানেন। অবশ্য তথ্য মন্ত্রণালয় যদি গোপনে শুধু আমলাদের দিয়ে ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নে কাজ করে থাকে, তা আমার জানার কথা নয়। তা ছাড়া এ ধরনের নীতিমালা এককভাবে আমলাদের তৈরি করার কথা নয়, উচিতও নয়। কারণ আমলারা বিশেষজ্ঞ নন। এ দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ে সরকারের যত সমালোচনা হচ্ছে তা বন্ধ করার একমাত্র পথ হলো একটি গ্রহণযোগ্য সম্প্রচার-নীতিমালা প্রণয়ন করা। যে নীতিমালায় মোটামুটি প্রাসঙ্গিক সব বিষয় সম্পর্কে নির্দেশনা থাকবে। এখন বিচ্ছিন্নভাবে লাইসেন্স প্রদান, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া, বিটিভির খবর চাপিয়ে দেওয়া, পরোক্ষ চাপ দেওয়া, বিটিভির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি প্রসঙ্গ আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। একটা নীতিমালার আলোকেই তা করতে হবে।
প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলই কমবেশি ‘রাজনীতি’ করছে। তার ফল তারা রাজনৈতিকভাবে পেয়েছে ও পাবে। আমাদের বর্তমান দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। বন্ধ করতে হলে আগে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিশুদ্ধ করতে হবে। সেটা খুব কঠিন কাজ। পাঁচ-দশ বছরে তা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমি আশা করব, তথ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে আর বক্তব্য না দিয়ে ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে তাদের কাজ শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেবেন। সেটাই এখন সময়ের দাবি। ইতিমধ্যে বহু সময় নষ্ট হয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা বলতে টিভি ও বেতারের মালিকেরা কী বুঝেছেন তা নিজেদের মধ্যে একটু আলোচনা করা দরকার। শুনেছি তাঁদের একটি ‘ফোরাম’ রয়েছে। এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই ফোরাম বহু কাজ করতে পারে। যেমন, মিডিয়ার স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা সম্পর্কে একটা সর্বসম্মত সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, প্রত্যেক চ্যানেলের পৃথক সম্পাদকীয় নীতিমালার পাশাপাশি একটা কমন নীতিমালা প্রণয়ন ও তা মেনে চলার অঙ্গীকার করা, সরকারের অবাঞ্ছিত নির্দেশ, গাইডলাইন ও পরামর্শ সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা, বিজ্ঞাপন প্রচার নীতিমালা ঠিক করা, নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক করা ইত্যাদি। যেসব নীতিমালা এই ফোরাম চূড়ান্ত করবে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। যাতে কেউ নীতিমালা লঙ্ঘন করলে দর্শক-শ্রোতারা তাদের মনে করিয়ে দিতে পারেন; ফোরামও যেন ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রথম আলোর গোলটেবিল আলোচনায় বিভিন্ন বক্তা বলেছেন, এখন নবীন টিভি সাংবাদিকেরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই টিভি চ্যানেলে চাকরি পাচ্ছেন। শুধু চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের আরও উচ্চ বেতনে অন্য চ্যানেল ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন গীতিআরা নাসরীন বলেছেন, ‘বিভাগের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের কোর্স সমাপ্তির আগেই ছাত্রছাত্রীদের চাকরি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।’ টিভি অনুষ্ঠান ও টিভি সাংবাদিকতা কোন দিকে যাচ্ছে তা এসব মতামত বা মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। দুর্বলদের ভিড়ে কিছু যোগ্য ছেলেমেয়েও টিভি চ্যানেলে কাজ করছে, এটা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। তবে কোনো ডিগ্রিই গণমাধ্যমে কাজ করার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসসহ দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ।
এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রশিক্ষণ কে দেবে? সরকারের ‘জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট’ (নিমকো) এ ব্যাপারে আদর্শ প্রতিষ্ঠান নয়। তা ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার নানা বিড়ম্বনা রয়েছে। ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন। আমার প্রস্তাব, টিভি ও বেতারের মালিকেরা নিজেদের উদ্যোগে একটি ছোট প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে পারেন। যেখানে চাকরিপ্রার্থীরা মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে ছয় মাসের একটি ফাউন্ডেশন কোর্স সম্পন্ন করবে। শুধু কৃতকার্য প্রার্থীরাই কোনো টিভি/বেতার চ্যানেলে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবে।
এর সঙ্গে গবেষণা বিভাগে থাকবে নানা ‘অনুষ্ঠান মতামত জরিপ’ ও ‘অনুষ্ঠান চাহিদা জরিপ’ কর্মসূচি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণ খরচ দিয়ে তাদের ‘অনুষ্ঠান’ সম্পর্কে দর্শক/শ্রোতার মতামত জরিপ করিয়ে নেবে। জরিপের ফলাফল প্রকাশও করা যায়, গোপনও রাখা যায়। এটা চ্যানেলের ব্যাপার। টিভি/বেতার চ্যানেল তাদের ভবিষ্যৎ অনুষ্ঠান পরিকল্পনার জন্য ‘চাহিদা জরিপ’ও করতে পারে। দর্শক-মতামত বা চাহিদা জরিপের কর্মপদ্ধতির ওপর চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা ইনস্টিটিউট সম্পূর্ণ পেশাদারি পদ্ধতিতে পরিচালনা করবে। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আগেই প্রশ্নমালা, দর্শক গ্রুপ, বয়স, স্থান, সংখ্যা অনুমোদন করে দেবে।
সরকার, বিবিসি বা কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর সর্বদা নির্ভরশীল না থেকে এ দেশের টিভি/বেতারের মালিকেরা নিজেরাই একটি সম্পূর্ণ পেশাদার ‘প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ গড়ে তুলতে পারে। বিবিসি, ডয়সে ভেলে বা ভারতীয় টিভি চ্যানেল থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ সব সময়ই থাকবে। সরকার যদি জমি দেয় বা একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দেয় তা ভেঙে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়া কোনো বিরাট প্রকল্প নয়। তবে এখনই একটি ভাড়াবাড়িতে তা শুরু করা যেতে পারে। জাতীয় প্রেসক্লাবকে সরকার জমি ও আর্থিক সহায়তা দিতে পারলে টিভি মিডিয়ার জন্যও সরকার এ রকম সহযোগিতা করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এখনো প্রিন্ট মিডিয়ানির্ভর। প্রেস কাউন্সিলের আইন ও নীতিমালাও যুগোপযোগী নয়। এই আইন ও নীতিমালা সংস্কারের কাজ চলছে বলে শুনেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক, মিডিয়া বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের নেতা ও একাডেমিক জগতের মতামত নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস কাউন্সিল আইন ও নীতিমালা সংশোধন ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য একটি পৃথক বিভাগ করার উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত। টিভি বা বেতারের খবর বা অনুষ্ঠানের কারণে কোনো দর্শক বা শ্রোতা যদি অসম্মানিত হন, তাহলে তিনি যেন সুবিচার পেতে পারেন বা দোষী ব্যক্তির যেন শাস্তি হয়, প্রেস কাউন্সিলকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। টিভি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম। প্রেস কাউন্সিল সক্রিয় না হলে টিভি মিডিয়ার অপব্যবহার হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ইতিমধ্যে কিছু অপব্যবহার হয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক ভারতীয় টিভি চ্যানেল দেখা গেলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা বা পার্শ্ববর্তী সাত রাজ্যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখা যায় না। অনেকবার এ নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি পত্রিকায় দেখেছি, তথ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এই জট খোলা সম্ভব হবে।
পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল প্রচার না করা সার্কচেতনার পরিপন্থী। আমরা ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, সীমান্ত হাট, ব্যবসার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ কত বড় বড় সহযোগিতামূলক কাজ শুরু করছি। অথচ টিভি চ্যানেল দেখানোর মতো একটা খুব সামান্য কাজ ভারত করতে দিচ্ছে না। এটা খুবই নিন্দনীয়। যারা এ জন্য দায়ী (সরকার নয়), তারা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বিরোধী, তাদের চিহ্নিত করা দরকার। তবে আমি আশাবাদী, তথ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন এবার উদ্যোগী হলে বিষয়টির একটা সমাধান হবে।
অনেকে বলতে পারেন, ‘ইলেকট্রনিক মিডিয়া একান্তই প্রাইভেট সেক্টরের বিষয়। সেখানে এত নীতিমালার চাপাচাপি করছ কেন? মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তারা যা খুশি তা করবে।’ এ রকম বক্তব্য আসতেই পারে। মনে রাখা দরকার, মিডিয়া একটা ব্যবসা হলেও তা আলু-পটোলের ব্যবসার মতো নয়। আলু-পটোলে ভেজাল দিলে অল্প লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু মিডিয়া প্রভাবিত করে কোটি কোটি মানুষকে। মিডিয়া খুব শক্তিশালী একটি অস্ত্র। তাই এই অস্ত্রের ব্যবহার জানতে হবে। যারা এই অস্ত্রের ব্যবহার জানে না তাদের শেখাতে হবে। যাদের এই অস্ত্রের অপব্যবহার করার আশঙ্কা থাকে তাদের আদৌ এই অস্ত্র কিনতে দেওয়া উচিত হবে কি না তা সরকারকে দেখতে হবে। কাজেই নানাভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে সরকারের দৃষ্টি রাখতে হয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণ বা খবরদারির জন্য নয়। মিডিয়া একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তবে সেই স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতাও থাকতে হবে। যারা দায়িত্বশীল নয়, তাদের মুখে স্বাধীনতার দাবি মানায় না।
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া একটি বিকাশমান শিল্প। এখনো তার প্রাথমিক অবস্থা। সামনে রয়েছে দীর্ঘ পথ। তাই এখনই এই বিকাশমান শিল্পকে ঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নানা সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে আর বক্তব্য বা গোলটেবিল নয়, এবার কাজ করার পালা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।
No comments