স্মরণ-তুমি রবে নীরবে: স্মৃতিতে ও সত্তায় by মামুনুর রশীদ

কিছু কিছু মানুষ ঢাকার বাইরে থেকেও তাঁদের অস্তিত্বকে বারবার জানান দিয়েছেন বড় বড় কর্মের মধ্য দিয়ে। তাঁদের মধ্যে একজন রহমান রক্কু; আসল নাম আবদুর রহমান, ডাকনাম রক্কু। কর্মক্ষেত্র টাঙ্গাইল এবং কিঞ্চিৎ ঢাকা।
অদ্ভুত তাঁর জীবনলিপি। জন্মেছিলেন এক রক্ষণশীল পরিবারে, যেখানে একমাত্র নিয়তি ছিল মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া।


কিন্তু একটুখানি সচেতন হওয়ার পরই তিনি মাদ্রাসার জানালা পেরিয়ে স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তি হয়েই ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী, সেই সঙ্গে নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েই দ্রুত মওলানা ভাসানীর নৈকট্য লাভ করেন। ষাটের দশকের সেই গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েই ঊনসত্তরের ১১ দফার আন্দোলনে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নবনাট্য আন্দোলনে শরিক হয়ে উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার, মনোজ মিত্রের চাকভাঙ্গা মধু, ইডিপাস এবং সারা দেশে সাড়া জাগানো টাঙ্গাইলের নাটক কুমারখালির চরের নির্দেশনা দেন যৌথভাবে। তাঁর বন্ধু ফারুক কোরেশী ছিলেন সৃজনকর্মের অংশীদার।
এ কথা নতুন করে বলার নয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলন পেয়েছিল নতুন মাত্রা। শিল্পকে ভালোবেসে অনেকেই নাটককে করেছিলেন আশ্রয়স্থল। অর্থাভাব সেই ভালোবাসার আবেগকে নষ্ট করতে পারেনি। এই আবেগ রাজধানী থেকে ছড়িয়ে গিয়েছিল দেশের সর্বত্র। আমাদের নাটক যে আজ এত দূর এগিয়েছে, তার পেছনে সেই সময়কার লড়াকু নাট্যজনদের রয়েছে সাহসী ভূমিকা।
রুক্কু ছিলেন নাটক-অন্তঃপ্রাণ। আমাদের দেশে সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। রুক্কু ঢাকার বাইরে থেকেই নিজের শৈল্পিক মনকে বিকশিত করতে চেয়েছেন। পেরেছেনও। টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ছাড়াও শহর ও শহরের বাইরের নানা নাট্যদলে নাটক নির্দেশনা ও সাংগঠনিক কাজ করেন। এভাবে তিনি অসংখ্য নাটকের ছিলেন ছায়া নির্দেশক। সারা দেশের নাট্যকর্মীদের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
এক সড়ক দুর্ঘটনায় রহমান রক্কুর দুই মেয়ে ও জামাতা নিহত হওয়ার পর তাঁর পরিবারে নেমে আসে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। এ সময় তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং বেশ কিছু টেলিভিশন নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার কাজ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে যান টাঙ্গাইলেই। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি টাঙ্গাইলে নানা ধরনের নাট্যোৎসবের আয়োজন করেন। এসব নাট্যোৎসবে নিয়মিতভাবে ঢাকার ও বিভিন্ন জেলার নাট্যদলকে আমন্ত্রণ করতেন। ঢাকার নাট্যদলগুলো ঢাকার বাইরে নাটক করে অভিজ্ঞতা লাভ করত, ঢাকার বাইরের দর্শক-শ্রোতাও ঢাকার নাটক দেখার সুযোগ পেতেন।
আবদুর রহমান রুক্কুর কর্মচাঞ্চল্যে মুগ্ধ হতেন ঢাকার এবং ঢাকার বাইরের নাট্যকর্মীরা। শুধু নাট্যকর্মী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। সে সময় তাঁর গৃহে আমন্ত্রিত নাট্যকর্মীদের যেভাবে আপ্যায়ন করা হতো, তা সবার কাছেই একটা মধুর স্মৃতি হয়ে থাকত। এ কাজে তাঁর অভিনেত্রী স্ত্রী খুবই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনিও প্রয়াত। শুধু নাটক আর রাজনীতি নয়; তিনি টাঙ্গাইল পাঠাগার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জীবনের শেষে এসে পুরোপুরি তিনি করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ই মৃত্যুবরণ করেন। আগামীকাল ৩০ নভেম্বর তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। টাঙ্গাইলের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব রহমান রক্কু স্মৃতি নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছে। ১ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নাট্যোৎসবে ঢাকায় আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটার ও লোকনাট্যদল নাটক পরিবেশন করবে। সেই সঙ্গে রক্কু প্রতিষ্ঠিত আরএন ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত একটি পদকও প্রদান করা হবে।
রাজধানীকেন্দ্রিক এ দেশে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে নাটকের জন্য কত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী যে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে গেছেন, তার খোঁজখবর রাখার আমরা প্রয়োজন বোধ করি না। অথচ তারাই ঢাকার বাইরে অবস্থান করেও দেশের সর্বত্র জ্বালিয়ে রেখেছিলেন সংস্কৃতির দীপশিখা। তাঁদের কথা আলোচনায় এনে আমরা আমাদের দায় মোচন করতে পারি। আবদুর রহমান রক্কুকে স্মরণ করার মাধ্যমে হয়তো সেই কাজটির সূচনা হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.