স্মরণ-স্বাপ্নিক এক তরুণের বিদায় by নূর কামরুন নাহার

ডিসেম্বর, ২০০৯। বিজয়ের মাস। এ মাসে সব সময়ই অন্য এক আবেগ অনুভব করি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর আমার জন্য আরও একটু অন্য রকম। মাত্র তিন মাস আগে বহুদিনের পুরোনো কর্মক্ষেত্র ছেড়ে নতুন কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছি। মনটা এখনো অস্থির, চঞ্চল।


ঠিক এ সময়েই লেখক-সাংবাদিক হারুন হাবীব আমাকে সম্পৃক্ত করলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আত্মজৈবনিক উপন্যাস উদ্বাস্তু সময় ও সোনালী ঈগল-এর প্রকাশনা এবং মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনীর বিশাল আয়োজনে। ওই আয়োজনেই জানতে পারি ‘একাত্তরের যাত্রী’ সম্পর্কে। জানতে পারি, সংগঠনটির সভাপতি হারুন হাবীব, সাধারণ সম্পাদক ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম, যাঁকে ডলার নামেই চেনে সবাই।
ডিসেম্বরের পর আবার দেখা হয় মার্চের শেষে। একাত্তরের যাত্রী আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। এবার শুধু দেখা নয়, এই তরুণকে জানার সুযোগ হয় আমার। শিল্পকলা একাডেমীর সবুজ লনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করি, একাত্তরের যাত্রীর পরিবারের সদস্যদের একাত্মতা আর একাগ্রতা, সৌহার্দ্য আর চিন্তার সৌকর্য, সততা ও নিষ্ঠা। একাত্তরের যাত্রী পরিবারের সৌন্দর্য ও আলোক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় খালেদ শামসুল ইসলাম ডলারের খোলসে আরেক ডলার। যে ডলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত, সৃষ্টির তাড়নায় বিক্ষত, আর অসম্ভব সুন্দর এক বিশাল হূদয় নিয়ে মানুষের জন্য প্রতিমুহূর্তে বিচলিত। একাত্মতা বোধ করি চিন্তায় ও মননে। উদ্দীপনা অনুভব করি। একাত্তরের প্রতি আগ্রহ, অনুরাগ এবং কাজ করার প্রবল আকুতিতে শুভাকাঙ্ক্ষী থেকে একাত্তরের যাত্রীর সক্রিয় সদস্যে পরিণত হই।
ফলে ডলার ভাই পরিণত হন একজন সহকর্মী হিসেবে। সহযাত্রী হিসেবে শুরু হয় আমাদের পথচলা। একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একক লক্ষ্য অর্জনে আমরা এগিয়ে চলি। গত আড়াই বছরে তিল তিল করে গড়ে ওঠে আমাদের অসামান্য সুন্দর সম্পর্ক। একাত্তরের যাত্রীর আমরা কজন—হারুন হাবীব, শামীম আমিনুর রহমান, রিয়াজুল হাসান, নুরুল আনোয়ার, অসিত আচার্য, এ আর কে রীপন, রিয়াদ রহমান এক পরিবারের সদস্যে পরিণত হই।
একাত্তরের যাত্রীর সদস্যরা একে একে আয়োজন করি ‘একাত্তরের কবিতা’, ‘একাত্তরের আকাশ সৈনিক’, ‘একাত্তরের নারী’। এসব কাজ করতে গিয়ে বহুবার আমরা একত্র হয়েছি, কেটেছে সুন্দর আর কর্মময় বেশ কিছু সময় আর স্মৃতির ঝুলি ভরেছে অনন্যমধুর স্মৃতিতে। প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ছিল একাত্তরের যাত্রীর মাসিক সভা। দেখা হওয়ামাত্রই ডলার ভাই হাত বাড়িয়ে ধরতেন বাদামের ঠোঙা। শিল্পকলা একাডেমীর সবুজ চত্বরে বিশাল আকাশ মাথার ওপর রেখে বিকেল পাঁচটার পর বসতাম আমরা এই সাত-আটজন। কফি কর্নার থেকে নিতাম ধোঁয়া ওঠা কফি। তারপর আমাদের কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনার বীজ বোনা। শেষ বিকেলের স্বর্ণালিরেখা মুছে গিয়ে নবীন সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হতেই ফিরতে হতো প্রাত্যহিক জীবনের আবশ্যিকতায়। মাঝের এই দু-এক ঘণ্টাই ছিল অন্য রকম স্বপ্ন বোনার সময়, আমাদের সারা মাসের রসদ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি চিফ হিসেবে ডলার ভাই বসতেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্লিনিক ভবনে। আমার কর্মস্থল বিদ্যুৎ ভবনের তিনতলায়। মন্ত্রণালয়ের একেবারে পাশেই। জরুরি কাজের প্রয়োজনে শামীম ভাই, অসিতদা, ডলার ভাই, কল্লোল একত্রে চলে আসতেন আমার অফিসে। ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ আর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাঁর ব্যস্ততা ছিল প্রচণ্ড। সঠিক সময়ে প্রায়ই আসতে পারতেন না। দুটো বললে বেজে যেত চারটা। এ নিয়ে আমাদের অনেক হাস্যরসিকতাও হতো। কিন্তু আমরা জানতাম, কাজের ব্যাপারে তাঁর কোনো আপস নেই।
পড়ালেখার প্রতি অদম্য আগ্রহ ছিল তাঁর। পত্রিকায় আমার যেকোনো লেখা বের হলেই লেখার ইচ্ছার কথা জানাতেন। ভেতরে সৃষ্টির তুমুল আলোড়ন ও যন্ত্রণা, অন্যদিকে জীবন আর জীবিকার রূঢ় বাস্তবতা ও ব্যস্ততা তাঁকে নিষ্পেষিত করত। এত সাহিত্যপ্রীতি, কর্ম ও সৃষ্টির প্রতি এত প্রবল আকুতি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি।
অসম্ভব স্বপ্নচারী ছিলেন তিনি। অনেক পরিকল্পনা ছিল তাঁর, আপাদমস্তক ছিলেন প্রগতিশীল। তারুণ্য ছিল সব চিন্তা আর কাজে, একাত্তর ছিল চেতনার রঙে। খুব গুছিয়ে পরিকল্পনা করে যে কাজ করতে পারতেন, তা নয়। বরং তাঁর মধ্যে ছিল বিক্ষিপ্ততা আর অস্থিরতা, কিন্তু কাজ করার ছিল ব্যাপক উচ্ছ্বাস আর আগ্রহ। অনেক কিছু করতে চাইতেন। একসঙ্গে অনেক কাজ, অনেক বড় বড় পরিকল্পনা আর স্বপ্ন।
তাঁর মতো এত বিনয়ী, ভদ্র, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ খুব কমই দেখেছি। তাঁর চেহারাতেই ছিল স্বপ্নালু এক গাঢ় কোমলতা আর সরলতা। তাঁর দুটো চোখেই ছিল জীবনের প্রতি প্রগাঢ় এক ইতিবাচক দৃষ্টি। তাঁর সেই বিনয়াবনত কোমল মায়াবী চেহারা আর কখনোই দেখব না। কখনোই শুনব না একটু নিচু কণ্ঠের বিনয় আর শ্রদ্ধার সেই ‘আপা’ ডাক। গত ৫ মে থেকে তিনি আর নেই। মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়—এ এক অনন্ত রহস্য। আমাদের প্রিয় ডলার ভাই এখন কোথায় আছেন জানি না। সব সময় মানুষ আর জনকোলাহলের মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন। তিনি কি এখন একা, নাকি যূথবন্দী হয়ে দেখছেন নতুন কোনো স্বপ্ন? জানি না, তবে এটা নিশ্চিত জানি, আজীবন তিনি বন্দী হয়ে থাকবেন আমাদের মনের ফ্রেমে। তিনি ছিলেন সহযাত্রী। তিনি আছেন। তিনি থাকবেন।
নূর কামরুন নাহার
nurquamrunnaher@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.